পুরোপুরি জলেই গেল বৃষ্টিটা!
রবিবার রাত থেকে অঝোর ধারে বর্ষণ হয়ে চলেছে কলকাতায়। পথ-ঘাট ভেসে গিয়েছে, উপচে পড়েছে পুকুর। কিন্তু এত বৃষ্টিতেও লাভের লাভ কিছু হচ্ছে না। কারণ, জলটা ধরে রাখতে পারছে না মহানগর। বৃষ্টির জল ভূস্তরের গভীরে পৌঁছচ্ছে না। উল্টে বিপুল জলরাশি নিকাশি বেয়ে চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। মিশে যাচ্ছে নোনা জলে। ভূগর্ভের তেষ্টা মিটছে না।
পাতাল-জলের ভাঁড়ারে সঙ্কট ও দূষণের জন্য গভীর নলকূপের যথেচ্ছাচারের দিকে আগেই আঙুল তুলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। বলেছেন, বহুতলের দল অসংখ্য গভীর নলকূপ বসিয়ে নির্বিচারে জল তুলে নেওয়ায় কলকাতায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর হু হু করে নামছে। পরিণামে ভরা গ্রীষ্মে তো বটেই, এমনকী শীতেও জলকষ্টে ভুগছে শহরের বড় অংশ। সঙ্গে থাবা বসিয়েছে আর্সেনিকের দূষণ। ভূ-বিজ্ঞানী ও জল-বিজ্ঞানীদের মতে, কলকাতায় যা বৃষ্টি হয়, তার সমস্ত জল ভূস্তরে মিশে যেতে পারলে শুদ্ধ জলের জন্য দু’শো মিটার পর্যন্ত খুঁড়তে হতো না। মাটির অল্প নীচেই সুস্বাদু, বিশুদ্ধ জল মিলত। আর্সেনিক-দূষণও এড়ানো যেত।
|
মঙ্গলবারের কলকাতা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক। |
কিন্তু বৃষ্টির জল কলকাতা ধরে রাখতে পারে না কেন?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্কুল অফ ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং’ বিভাগের অধিকর্তা আশিস মজুমদারের ব্যাখ্যা: এমনিতে যেখানে খোলা জায়গা, পুকুর, ডোবা ইত্যাদি যত বেশি, মাটিতে জল ঢোকার প্রবণতাও তত বেশি। কলকাতায় জলাশয় বা খোলা জায়গার সংখ্যা দিন দিন কমছে। সঙ্কটের এটা একটা কারণ। তবে খোলা জায়গা যথেষ্ট থাকলেও কলকাতার ক্ষেত্রে খুব কিছু লাভ হতো কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে। কী রকম?
আশিসবাবুর দাবি, অনেকাংশে প্রাকৃতিক কারণেও বৃষ্টির জল কলকাতার ভূগর্ভে বেশি ঢুকতে পারে না। কারণ কলকাতার মাটির ছ’মিটার নীচের কাদা-মাটির স্তর ভেদ করে পরবর্তী স্তরে পৌঁছনো বৃষ্টির জলের পক্ষে কঠিন। কিছুটা পৌঁছতে পারলেও অধিকাংশই কাদা-মাটির স্তরের উপর থেকে নিকাশি খাল, নালা মারফত বেরিয়ে যায়। কলকাতার অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠের প্রায় ছ’মিটার উপরে হওয়ায় স্বাভাবিক ভাবেই যাবতীয় নিকাশি সাগরমুখী। তাই এ শহরে বৃষ্টি থেকে পাওয়া বিশুদ্ধ ও মিষ্টি জলের ৯০ ভাগ ভূগর্ভে সঞ্চিত হওয়ার বদলে সমুদ্রের লবণাক্ত জলে মিশে যায়।
মানে এত যে বৃষ্টি হল, পুরোটাই বয়ে গেল?
কার্যত তা-ই। আশিসবাবু জানাচ্ছেন, কেএমডিএ-র মোট এলাকা ১ হাজার ৮৮৭ বর্গ কিলোমিটার। রবিবার রাত থেকে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত গড়ে ১০ সেন্টিমিটার বৃষ্টি হয়ে থাকলে অঙ্কের হিসেবে ১৯ কোটি ঘনমিটার জল আকাশ থেকে পড়েছে। কেএমডিএ এলাকায় খোলা জায়গা সাকুল্যে ১০%। সে ক্ষেত্রে সর্বত্র একই হারে বৃষ্টি হলে কেএমডিএ-এলাকায় ১ কোটি ৯০ লক্ষ ঘনমিটার জল মাটির নীচে শুদ্ধ জলের পরিমাণ বাড়াতে পারত। কিন্তু কলকাতা ও আশপাশের ভূস্তরের ছ’মিটারের মধ্যে কাদামাটি এসে যাওয়ায় বৃষ্টির জল বালির স্তর পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। খুব বেশি হলে এর ১০% প্রকৃত অর্থে ভূস্তরের ‘ভাল’ জলের সঙ্গে মিশছে, অর্থাৎ মাত্র ১৯ লক্ষ ঘনমিটার। সব মিলিয়ে পুনর্ব্যবহারযোগ্য রূপে মাটির নীচে সঞ্চিত হচ্ছে মোট বৃষ্টির বড়জোর ১%!
তাই মহানগরে জলস্তরও উঠছে না। আবার খাস কলকাতায় ছ’মিটার গভীরতা পর্যন্ত যে জল জমা হচ্ছে, তা-ও কোনও কাজে লাগছে না। আশিসবাবুর কথায়, “প্রথমত কাদা-মাটির উপরের সেই জলস্তর প্রাকৃতিক কারণেই দূষিত। সেটাও আবার মিশে যাচ্ছে খাল-বিলে, নিকাশি নালায়। শেষমেশ গিয়ে পড়ছে সমুদ্রে।”
তা হলে কলকাতায় আশি থেকে দেড়শো মিটার গভীরে তুলনায় পরিষ্কার জল আসছে কোথা থেকে?
কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের প্রাক্তন অধিকর্তা শ্যামাপ্রসাদ সিংহরায় বলছেন, “এটা হল কলকাতাকে নদিয়ার দান।” তাঁর ব্যাখ্যা: নদিয়ার কৃষ্ণনগর, কল্যাণী বা হরিণঘাটায় ভূপৃষ্ঠের ঠিক নীচে রয়েছে বালি-মাটির স্তর, যা কি না সরাসরি বৃষ্টির জল শুষে নিয়ে পাঠিয়ে দেয় নীচের স্তরে। আর সেই জলই বিভিন্ন ভাবে চুঁইয়ে এসে জমা হয় কলকাতার ভূস্তরে। অর্থাৎ, নদিয়ার কিছু অঞ্চলে কত বৃষ্টি হল, তার উপরে নির্ভর করছে কলকাতার ভূগর্ভস্থ জলসঞ্চয়ের পরিমাণ।
অথচ গভীর নলকূপের আগ্রাসন ওই সঞ্চয়ে যে ভাবে থাবা বসাচ্ছে, তাতে সেখানেও বিপর্যয়ের সঙ্কেত স্পষ্ট। এমন কোনও ব্যবস্থা কি করা যায় না, যাতে নিজের বৃষ্টি দিয়েই নিজের জল-ভাণ্ডার রক্ষা ও তার বৃদ্ধিসাধন করতে পারে কলকাতা?
পারে। তবে কাগজে-কলমে। কলকাতার ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ’-এর প্রাক্তন অধিকর্তা তথা যাদবপুরের ‘স্কুল অফ ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর শিক্ষক অরুণাভ মজুমদারের বক্তব্য: প্রাকৃতিক ভাবে কলকাতার মাটির জলধারণের ক্ষমতা কম, খোলা জায়গাও কম। তাই এখানে কৃত্রিম ভাবে মাটির ৮০ মিটার নীচে বৃষ্টির জল ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভূস্তরে ওই জলের পরিমাণ যত বাড়বে, তত কলকাতার জলস্তর উঠে আসবে, কমবে আর্সেনিক-দূষণের আশঙ্কা।
বস্তুত বৃষ্টির জল ধরে ভূগর্ভে পাঠানোর জন্য কেন্দ্রীয় ভূতল পর্ষদ বেশ কয়েকটি প্রযুক্তির সুপারিশ করেছে। কিছু প্রকল্পে জলাধার বানিয়ে জল ধরে রাখার ব্যবস্থা। কোথাও পাইপ মারফত জল নামবে ৮০-১৫০ মিটার গভীরে। “আইনে পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে, কুড়ি হাজার বর্গমিটারের বেশি আয়তনবিশিষ্ট আবাসনে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের ছাড়পত্র আবশ্যিক। আর ওই ছাড়পত্র নিতে গেলে দু’টো শর্ত পালন করতেই হবে। এক, ছাদে পড়া বৃষ্টির জলের ৪০% জলাধারে জমাতে হবে। বাকি ৬০% পাঠিয়ে দিতে হবে মাটির নীচে, বিশুদ্ধ জলস্তরে।”জানাচ্ছেন অরুণাভবাবু।
এ হেন বিধি-নিয়ম বা প্রযুক্তি মজুত থাকলেও ইএম বাইপাস-সহ কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় বহু বড় আবাসন প্রকল্প অবশ্য তার ধার ধারছে না। অভিযোগ, সেখানে যেমন গভীর নলকূপ বসিয়ে যথেচ্ছ জল তোলা হচ্ছে, তেমন বৃষ্টির জল সংরক্ষণেরও বালাই নেই। অন্য দিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘোষিত ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পে গ্রামে-গঞ্জে বিস্তর পুকুর সংস্কার হলেও কলকাতায় তা সে ভাবে কার্যকর করা যায়নি বলে স্বীকার করেছেন খোদ মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “আমরা এখনও জল সংরক্ষণের বিধি বাধ্যতামূলক ভাবে প্রয়োগ করতে পারিনি। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নির্দেশের অপেক্ষায় আছি।”
কলকাতা পুরসভার নতুন বিল্ডিং রুলসেই কিন্তু বৃষ্টির জল সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতার নির্দিষ্ট উল্লেখ রয়েছে। তবু কেন তার প্রয়োগ হচ্ছে না, সে নিয়ে পুর-কর্তৃপক্ষের সদুত্তর মেলেনি।
|