ডলার নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেই গোকুলে বাড়ছিল পাউন্ড। টাকার দুর্বল বোলিংয়ের সুযোগে মঙ্গলবার একেবারে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে ফেলল ব্রিটিশ মুদ্রাটি। মঙ্গলবার একটা সময় এক পাউন্ড কিনতে ১০০ টাকা ৫২ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। দিনের শেষে অবশ্য কিঞ্চিৎ কমে পাউন্ডের দাম দাঁড়ায় ৯৯ টাকা ৪ পয়সা।
পিছিয়ে ছিল না ডলারও। সোমবার ১৪৮ পয়সা পড়ার পর এ দিনও মার্কিন মুদ্রার তুলনায় আরও নামল টাকার দাম। কেন্দ্র, শিল্প, আমজনতার মেরুদণ্ডে আশঙ্কার ঠাণ্ডা স্রোত বইয়ে এক সময় ডলারের দাম উঠছিল ৬৪.১৩ টাকায়। শেষ পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হস্তক্ষেপে পাউন্ডের মতো ডলারের দামও কিছুটা কমে। দাঁড়ায় ৬৩ টাকা ২৩ পয়সায়। সেটাও অবশ্য নতুন রেকর্ড।
দেশে ডলার আসার পথ সুগম করতে এ দিন শেয়ার ও ঋণপত্রের (বন্ড) বাজারে অনাবাসী ভারতীয়দের টাকা ঢালার পথ আরও প্রশস্ত করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। কিন্তু সেই দাওয়াই কতটা কাজে আসবে, সেই সন্দেহ যাচ্ছে না। পাশাপাশি প্রশ্ন উটছে, কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের এত পদক্ষেপ আর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও টাকার এমন নড়বড়ে দশা কেন? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রথমত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া ভারতীয় অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে বাজারে ঘোর অনাস্থার মনোভাব তৈরি হয়েছে। আর তার জেরেই ছড়িয়েছে আতঙ্ক। যা কমিয়েছে টাকার জোর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মন্দার মেঘ সরিয়ে মার্কিন অর্থনীতির পুরোদস্তুর ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত। যা আবার চড়চড় করে বাড়িয়েছে ডলারের চাহিদা। এই ত্র্যহস্পর্শেই আপতত জেরবার ভারতের অর্থনীতি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে ভারতীয় অর্থনীতির যা যা সমস্যা, তার কোনওটাই নতুন নয়। বৃদ্ধির হার থমকে রয়েছে অনেক দিন থেকেই। মূল্যবৃদ্ধি আজ তিন বছর ধরেই চড়া। বড় মাপের সংস্কার শিকেয়। বেশ কয়েক বার উৎপাদন কমেছে শিল্পের। সরকারের দিকে অভিযোগের আঙুল উঠছে দুর্নীতি আর নীতিপঙ্গুত্ব নিয়ে। আর এই সবের সঙ্গে গোদের উপর বিষফোড়ার মতো যোগ হয়েছে চলতি খাতে বাণিজ্য লেনদেনে চড়া ঘাটতি।
দেখা যাচ্ছে, দেশে যত ডলার আসছে, বেরিয়ে যাচ্ছে তার তুলনায় অনেক বেশি। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও এই ঘাটতি কিছুতেই কমাতে পারছে না কেন্দ্র কিংবা রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। বরং এ নিয়ে তারা যত আশ্বাস দিচ্ছে, ততই সংশয়ী হয়ে পড়ছেন লগ্নিকারীরা। ডলারের পায়ে বেড়ি পরানোর চেষ্টা হলে, শিল্পমহল আশঙ্কা করছে, বোধহয় ফিরে আসছে আশির দশক। পুঁজি ফের পরাধীন হল বলে। তাই হিতে বিপরীত হচ্ছে কেন্দ্র ও রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অধিকাংশ ঘোষণাতেই। |
আসলে চলতি খাতে ঘাটতিতে রাশ টানতে দেশ থেকে ডলার যাওয়া কমাতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়াতে হবে ডলার আসার অঙ্ক। ডলার আনার অন্যতম রাস্তা হতে পারত প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ। কিন্তু কেন্দ্র দু’দফায় বিমান পরিষেবা, বিমা, খুচরো ব্যবসা-সহ বহু ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির পথ প্রশস্ত করলেও, বিনিয়োগ সে ভাবে আসেনি। টাকার দাম পড়ায় সুযোগ ছিল রফতানি বৃদ্ধির। কিন্তু হালফিলে সামান্য বাড়লেও ওই রেখচিত্রও সে ভাবে ওঠেনি।
তার উপর বৃদ্ধি নিয়ে আশঙ্কা, টাকার দামে লাগাতার পতন ইত্যাদি কারণে শেয়ার বাজার থেকেও ক্রমাগত লগ্নি সরাচ্ছে বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি। ফিনশোর ইনভেস্টমেন্টের ডিরেক্টর লক্ষ্মণ শ্রীনিবাসনের মতে, “ওই সব সংস্থা শেয়ার বিক্রি করে পাওয়া টাকায় ডলার কিনছে। এবং তা পাঠিয়ে দিচ্ছে বিদেশের বাজারে লগ্নির জন্য।”
ফলে সব মিলিয়ে ক্রমশ কমছে ডলার আসা। অথচ শত চেষ্টাতেও তেল, গ্যাসের মতো প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি কমানো যাচ্ছে না। বরং ডলার যত চড়ছে, ওই আমদানি বিল মেটাতে খরচ হচ্ছে তত বেশি। তাই কিছুতেই রাশ টানা যাচ্ছে না চলতি খাতে ঘাটতিতে। লাগাম পরানো যাচ্ছে না টাকার পতনেও।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এমনিতেই এই পরিস্থিতি যথেষ্ট হতাশাজনক। কিন্তু তার থেকেও বেশি চিন্তার কারণ হল, এই পরিস্থিতি যে দ্রুত বদলাতে পারে, সেটাই বিশ্বাস করতে রাজি নয় বাজার। দেশের শিল্পমহলের এক বড় অংশ এবং বিদেশি লগ্নিকারীরা মনে করেন, তার জন্য বড় মাপের আর্থিক সংস্কারে হাত দেওয়ার যে কল্জে প্রয়োজন, আগামী বছরের লোকসভা ভোটকে পাখির চোখ করা এই সরকারের তা নেই। ব্যাঙ্কিং বিশেষজ্ঞ বি কে দত্তর মতে, “রাজনৈতিক ভাবে এই সরকার দুর্বল। ফলে বিমা, ব্যাঙ্ক, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ আনার পরিকল্পনা রূপায়িত করার মতো কোনও কার্যকরী সিদ্ধান্ত তারা নিতে পারেনি।” মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থা এসঅ্যান্ডপি জানিয়েছে, ভারতের ঋণ শোধের নিশ্চয়তা (ক্রেডিট রেটিং) সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচকই রাখছে তারা। চাকা ঘোরার প্রতি এই গভীর অনাস্থাই ক্রমশ আরও কঠিন অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে টাকাকে। |
টাকার পতন বা বেহাল অর্থনীতি নিয়ে
এই সরকারের কোনও মাথাব্যথা নেই।
চিন্তা শুধু গদি রাখার।
নরেন্দ্র মোদী |
পরিস্থিতি শোধরাতে ইতিমধ্যেই বেশ
কিছু পদক্ষেপ করেছে কেন্দ্র। সমস্যার
শিকড় আসলে চলতি খাতে ঘাটতি।
পি চিদম্বরম |
|
আবার এই অনাস্থা থেকেই জন্ম নিচ্ছে আতঙ্ক। অনেকেই মনে করছেন, টাকার দর যত পড়বে, আমদানি খরচ মেটাতে তত নাভিশ্বাস উঠবে তেল সংস্থাগুলির। আরও চওড়া হবে চলতি খাতে ঘাটতি। ফলে আরও বেশি করে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে অর্থনীতির। আর শুধু এই আতঙ্কের জেরেই হাতের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন অনেকে।
ভারতীয় অর্থনীতির এই সর্বনাশের জন্য মার্কিন অর্থনীতির পৌষ মাসকেই দায়ী করছেন অনেকেই। তাঁদের মতে, মার্কিন অর্থনীতি ছন্দে ফেরার ইঙ্গিত মেলায় এখন সে দেশে ডলার ঢালার জন্য ভারতের বাজার থেকে লগ্নি সরাচ্ছে বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলি। তবে অনেকেই আবার মনে করছেন, ভারতের অর্থনীতি ঘিরে এই আতঙ্কের অনেকটাই অযৌক্তিক। কেন্দ্রীয় আর্থিক বিষয়ক সচিব অরবিন্দ মায়ারাম যেমন এ দিন স্পষ্ট বলেছেন, “এই আতঙ্ক অযথা। দেশের অর্থনীতির চেহারা আসলে গত বছরের তুলনায় অনেকটাই ভাল।” বিশ্ব ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলেছেন, “অর্থনীতির যতটা বিবর্ণ ছবি এ দেশে তুলে ধরা হচ্ছে, ওয়াশিংটনে কিন্তু আদৌ তা মনে হয় না।”
গাঢ় অন্ধকারেও আশার রুপোলি রেখা দেখছেন আরও অনেক বিশেষজ্ঞও। তাঁদের মতে, পরিস্থিতির চাকা ঘোরাতে সরকার এখনই পূর্ণ সংস্কারের রাস্তায় হাঁটতে পারছে না ঠিকই। কিন্তু সংস্কার নিয়ে এই টানাপোড়েন নতুন কিছুও নয়। টাকা আসলে বিশ্ব বাজারের সামগ্রিক অবস্থার বলি। তাই অনাস্থা আর আতঙ্কের এই জট সরিয়ে টাকা ঘুরে দাঁড়াবে বলেই তাঁদের বিশ্বাস। |