মোর্তেজ মাস্টার হত্যা মামলা
১৮ বছর পরে সাজা সিপিএমের ৭ নেতা-কর্মীর
দীর্ঘ ১৮ বছর অপেক্ষার পরে রায় হল মাড়গ্রামের প্রভাবশালী ব্লক কংগ্রেস নেতা মোর্তেজ আলি হত্যা মামলার। মঙ্গলবার আদালত ওই খুনে সাত জনকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয়। রামপুরহাট আদালতের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক গুরুপদ মণ্ডল ওই সাজা শোনান। এক লোকাল কমিটি সম্পাদক ও দুই প্রাক্তন পঞ্চায়েত প্রধান-সহ দোষীরা প্রত্যেকেই সিপিএমের নেতা-কর্মী।
মামলার সরকারি আইনজীবী উত্‌পল মুখোপাধ্যায় বলেন, “১৯৯৫ সালের ওই ঘটনায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছিল। মামলা চলাকালীন কচি আব্বাসি ও নবু শেখ নামে দুই অভিযুক্ত মারা যান। বাকি ১৭ জনের মধ্যে ১০ জন উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ দিন বিচারক দোষীদের কেবলমাত্র ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা শোনান।”
জেলে যাওয়ার পথে। রামপুরহাট আদালতে ছবিটি তুলেছেন অনির্বাণ সেন।
সাজাপ্রাপ্তেরা হলেন মাড়গ্রাম থানার বুধিগ্রামের বাসিন্ধা সিপিএমের রামপুরহাট ২ জোনাল সদস্য তথা দলের বুধিগ্রাম লোকাল কমিটির সম্পাদক বানু শেখ, মাড়গ্রাম থানার খামেড্ডা গ্রামের বাসিন্দা বুধিগ্রাম লোকাল কমিটির সদস্য তথা বুধিগ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান মোজাম্মেল হক (সেন্টু), মাড়গ্রামের বাসিন্ধা মাড়গ্রাম ২ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান দুলু শেখ, মাড়গ্রামের চার সিপিএম কর্মী পানু শেখ, নুর নবি, শুকুর শেখ এবং ফজর শেখ। সরকারি আইনজীবী আরও জানিয়েছেন, বিচারক একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৫ হাজার টাকা করেও জরিমানা করেছেন। জরিমানা অনাদায়ে বিচারক আরও ছ’মাস জেল হাজতের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রথম দিকে ওই খুনের মামলায় সাক্ষী মিলছিল না। পরে যাঁরা সাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁরা বহু ক্ষেত্রেই টালবাহানা করেছিলেন। এমন বেশ কিছু জটিলতা তৈরি হওয়াতেই এই মামলাটির বিচার হতে এতদিন লেগেছে বলে সরকারি আইনজীবী জানিয়েছেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৯৫ সালের ১৮ জুন রাতে মাড়গ্রামের খেঁদাপাড়ায় একটি নালার মধ্যে থেকে মাড়গ্রাম ১ পঞ্চায়েতের প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধান মোর্তেজ আলি-র (৫০) ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। গ্রামের বাগানপাড়ার বাসিন্দা মাড়গ্রাম হাই মাদ্রাসার শিক্ষক মোর্তেজ আলি এলাকার প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। এলাকায় তিনি ‘মোর্তেজ মাস্টার’ নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, পঞ্চায়েত সমিতির অনাস্থাকে ঘিরেই তাঁদের নেতাকে সিপিএমের দুষ্কৃতীরা খুন করে। ঘটনা হল, ওই বছর জুন মাসে সিপিএম পরিচালিত রামপুরহাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে নিহত ওই নেতার নেতৃত্বেই অনাস্থা এনেছিল কংগ্রেস। তারপরেই গ্রামের মধ্যে খুন হয়ে যান মোর্তেজ মাস্টার।
মোর্তেজ মাস্টার-হত্যা মামলায় মূলসাক্ষী হয়েছিলেন কংগ্রেসের সুজাউদ্দিন আহমেদ। বর্তমানে মাড়গ্রাম ১ পঞ্চায়েতের কংগ্রেস প্রধান সুজাউদ্দিনই ওই ঘটনায় সিপিএমের ১৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। এ দিন রায়ের পরে তিনি বলেন, “সিপিএমের দুষ্কৃতীরা মোর্তেজ মাস্টারকে নৃশংস ভাবে খুন করেছিল। এই রায়ে আমরা খুশি।” তাঁর দাবি, “সে দিন পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সদস্য গৌরী দাস অসুস্থ ছিলেন। মোর্তেজ মাস্টার, আমি এবং আরও তিন কংগ্রেস কর্মী তাঁকে দেখতে তাঁর খেঁদাপাড়ার বাড়িতে গিয়েছিলাম। রাত ৮টা নাগাদ বাড়ি ফেরার পথে সিপিএমের দুষ্কৃতীরা আমাদের উপরে বোমা, আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে।” পালানোর সময়ে মোর্তেজ মাস্টারের মাথায় গুলি লাগে। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয় বলে সুজাউদ্দিন জানিয়েছেন। বোমাবাজির পরে বেশ কিছুক্ষণ তাঁর খোঁজ মিলছিল না। পরে রাত বারোটা নাগাদ ঘটনাস্থল থেকে বেশ কিছুটা দূরে পার্শ্ববর্তী নালায় ওই নেতার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার হয়।
পুলিশ সূত্রের খবর, ওই ঘটনায় ৫ কংগ্রেস সমর্থক বোমার আঘাতে অল্পবিস্তর জখম হন। তাঁদের মধ্যে গুরুতর জখম মোজাম্মেল মোল্লাকে রামপুরহাট হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। পরের দিন সকালে উত্তেজিত জনতা গ্রামের ৬টি বাড়িতে আগুন লাগায়, ৮টি বাড়িতে লুঠপাট চালায়। ওই খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে উত্তেজিত জনতা শাকিল শেখ নামে এক যুবককে ধরে বেধড়ক পেটায়। এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি হয়। এমনকী পরিস্থিতির সামাল দিতে দুর্গাপুর থেকে অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনী নিয়ে আসা হয়।
এ দিকে ওই সময়ে রামপুরহাট ২ পঞ্চায়েত সমিতির যিনি সভাপতি ছিলেন, সেই কালাম মোল্লা বর্তমানে সিপিএমের রামপুরহাট ২ জোনাল সম্পাদক। তিনি মোর্তেজ মাস্টারের খুন হওয়াকে কংগ্রেসের পরিকল্পিত ঘটনা বলে দাবি করে বলেন, “কংগ্রেস আমার বিরুদ্ধে অনাস্থা এনেছিল। ভোটাভুটিতে জিততে ওরা আমাদের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য গৌরী দাসকে অপহরণ করে। পরে নিজেদের অর্ন্তকলহে পরিকল্পতি ভাবে ওরাই মোর্তেজ মাস্টারকে খুন করে। অথচ খুনের ঘটনায় আমাদের দলীয় কর্মীদের মিথ্যা মামলায় অভিযুক্ত করা হয়।” এ দিন রায়ের পরে জেলের পথে অন্যতম সাজাপ্রাপ্ত বানু শেখও দাবি করেন, “কংগ্রেস পরিকল্পিত ভাবে আমাদের ফাঁসিয়েছে।” তাঁরা এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন।
এ দিকে দলীয় নেতা খুনে এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন এলাকার কংগ্রেস বিধায়ক অসিত মাল। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক কারণেই মোর্তেজ আলি খুন হয়েছিলেন। বিচারব্যবস্থার প্রতি আমাদের আস্থা ছিল। আদালতের রায়ে আমরা খুশি।” এ দিন আদালতে উপস্থিত থাকতে পারেননি নিহতের ছেলে গিয়াসউদ্দিন আলি। দীর্ঘদিন ধরে বাবার খুনের মামলা লড়ছেন। আরও কঠিন সাজা প্রত্যাশা করলেও এই রায়েও নিজের সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সন্ধ্যায় তিনি ফোনে বলেন, “আমার মা-ই আসল লড়াই করেছেন। দু’ মাস আগে মারা গেলেন। মা এই রায় শুনে গেলে শান্তি পেতেন।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.