বীরভূম এবং তার লাগোয়া বর্ধমানে একের পর এক খুনে যখন অনুব্রত-গোষ্ঠীর নাম কাঠগড়ায় উঠছে, তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় বললেন, “কাউকে প্রাণে মেরে রাজনীতির দরকার নেই। এই হানাহানি বন্ধ হওয়া দরকার।”
এর আগে বীরভূমের কসবা এবং খয়রাশোল। শুক্রবার বর্ধমানের ভাতার। অনেকটা যেন একই ধারায় বইছে ঘটনাক্রম।
এক, প্রথমে দলেরই লোককে গুলি করে মারায় অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা-কর্মীরা।
দুই, তিনটি ক্ষেত্রেই পরিবারের লোক প্রকাশ্যে বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডলের নাম বলেও পরে পিছিয়ে যান। কসবায় সাগর ঘোষ খুনের অভিযোগে অবশ্য পরে অনুব্রতর নাম ঢোকানো হয়েছে। কিন্তু পুলিশ তাঁকে ধরেনি। জেরাও করেনি।
তিন, সাগরবাবুর ছেলে, বিক্ষুব্ধ তৃণমূল কর্মী হৃদয় ঘোষ অনুব্রত-গোষ্ঠীর প্রার্থীর বিরুদ্ধে ‘নির্দল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। অনুব্রতর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ‘নির্দল’ দাঁড় করিয়েছিলেন খয়রাশোলের অশোক ঘোষ ও মঙ্গলকোটের কাশেম কাজি।
চার, একটি ঘটনাতেও মূল অভিযুক্তেরাগ্রেফতার হয়নি।
এ দিনই সিউড়িতে গিয়ে বারবার নানা ঘটনায় অনুব্রতর নাম জড়ানো প্রসঙ্গে বীরভূমের তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় বলেন, “এটা ওঁর ব্যক্তিগত ব্যবহারের প্রতিফলন কি না, উনি সত্যি ভাল মানুষ না সত্যি খারাপ, এগুলো বিচারযোগ্য এবং প্রমাণসাপেক্ষ।... মৃত্যুর সঙ্গে কে জড়িত, কারা জড়িত সে কথা আমি বলতে পারি না। কারণ, আমার কাছে প্রমাণ নেই। প্রশাসনের কাজ প্রশাসন করবে, তাদের দক্ষতা দেখাবে।”
শুক্রবার ভাতারের রাস্তায় গুলি করে মারা হয় কাশেম কাজিকে। এর পরেই তাঁর ভগ্নিপতি, পঞ্চায়েত ভোটে নির্দল প্রার্থী হয়ে দাঁড়ানো কাজি মানোয়ারুল হক অভিযোগ করেন, “নির্দল প্রার্থী দাঁড় করানোর পর থেকেই অনুব্রত মণ্ডলের লোকেরা ওকে নিশানা করেছিল। ওরাই ওকে খুন করেছে।” কিন্তু সে দিন তো নয়ই, শনিবার রাত পর্যন্ত মঙ্গলকোটের ভারপ্রাপ্ত নেতা অনুব্রতর নামে তাঁরা পুলিশে কোনও অভিযোগ করেননি। কাশেমের ভাই নাজিবুর রহমান বরং ‘অজ্ঞাতপরিচয় আততায়ী’দের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
অথচ জেলা পুলিশের সূত্র বলছে, খুনের সময় যিনি কাশেম কাজির মোটরবাইকের পিছনে বসেছিলেন, সেই খোরাই শেখ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে শুয়ে নির্দিষ্ট করে এক আততায়ীর নাম বলেছেন। সেই লোকটি গোষ্ঠী রাজনীতিতে কাশেম কাজির বিরুদ্ধ পক্ষ, অনুব্রত-অনুগামী শেখ বাসেদ আলির গোষ্ঠীর লোক বলে পরিচিত। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও মামলা রুজু করা হয়নি।
কসবায় সাগর ঘোষ খুনের পরে প্রথমে পুলিশ অনুব্রতর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিতে চায়নি। এই নিয়ে তোলপাড় হওয়ার পরে নামটি যোগ করা হয়। খয়রাশোলে অশোক ঘোষ খুনে মূল অভিযোগ অনুব্রত-অনুগামী ব্লক সভাপতি অশোক মুখোপাধ্যায়ের নামে। কিন্তু পুলিশ ধরেনি, উল্টে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে বলে নিহতের গোষ্ঠীর লোকেদের অভিযোগ। পুলিশের খাতায় আপাতত তিনি ‘পলাতক’। অশোক ঘোষের ছেলে বিশ্বজিৎ এই নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দ্বারস্থ হবেন বলেও জানিয়ে দিয়েছেন।
এ দিন কন্যা দত্তক নেওয়ার আইনি কাজ সম্পন্ন করতে সিউড়িতে এসে অনুব্রত-গোষ্ঠীর বিরোধী বলে পরিচিত শতাব্দী বলেন, “দেশটার নাম ভারতবর্ষ। এখানে তিন লক্ষ ২০ হাজার হত্যাকারী দৌড়ে বেড়াচ্ছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই।” বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ময়না-তদন্তের পরে মঙ্গলকোটের পূর্ব নওয়াপাড়া গ্রামে কাশেম কাজির দেহ ফেরে। ব্যাপক পুলিশ পাহারায় সন্ধ্যায় দেহটি কবর দেওয়া হয়েছে। |