রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ৩...
ল্যাজে পা
স্মার্ট নয়, এ একটি ওভারস্মার্ট ফোন। স্পয়েল্ট চাইল্ডের চেয়েও অবাধ্য। বেয়াদপ, বেয়াড়া, বদতমিজ, বদমাইশ নম্বর ওয়ান। টেকনোলজির ট্রিক ফটাফট উদ্ধার করে ফেলি বলে চাপা অহংকার ছিল, নতুন ফোন কেনার পর, ধূলিসাত্‌। যখন দোকানি নতুন ফোনটা ধরাল, বললাম, নতুন সেট, আনকোরা নিয়মকানুন। বেসিকগুলো বুঝিয়ে দিন। সে লজ্জা, ব্যঙ্গ ও তুচ্ছভাব মিলিয়ে একটা মোনালিসা-স্মাইল দিল, অলরেডি তো একটা এনট্রি লেভেল স্মার্ট হ্যান্ডসেট ব্যবহার করছিলেন, আপনাকে আর কী বোঝাব! আধ ঘণ্টা হাত বোলাবেন, ব্যস, এ ফোন আপনার কেনা গোলাম। স্মার্টফোন আলাদিনের জিন। যা চাই অ্যাপ্লিকেশন স্টোরে গিয়ে হুকুম করবেন, ভাল রেস্তরাঁর খোঁজ, ফিল্মের টিকিট, স্ক্যানিং মেশিন, চোর ধরার যন্ত্র-পুলিশ, হাজির করে দেবে।
প্রথমেই সে ফোন পকেটে ঢুকল না। পকেটের জানলা থেকে বেরিয়ে নিজের চকচকে চেহারা আধখানা দেখিয়ে দেখিয়ে চোরেদের নেমন্তন্ন করতে লাগল, এই দ্যাখ্ বড় ফোন দামি ফোন, আয় আয় নিয়ে যা। সতর্ক চোখে পকেট চেপে বাড়ি ফিরতেই বুঝলাম, আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। ফোন পালটাতে গিয়ে আমার জীবন বদলে গেছে।
সব ফোন নম্বর তো আগের হ্যান্ডসেটে ফেলে এসেছি। সেই পুরনো ফোনও হনুমানবিশেষ ছিল। নম্বর সেভ করতে গেলেই ভুরু কুঁচকে কৈফিয়ত তলব করত, কোত্থেকে চিনলে একে? তাতে আমি খাবি খেয়ে উত্তর দিলে, সে বুঝেসুঝে বিজনেস, ফ্রেন্ড, ক্লোজ ফ্রেন্ড, অ্যাকোয়েন্টেন্স এ সব আলাদা আলাদা বাক্সে নাম ও নম্বর তুলে গুছিয়ে রাখত। সে সব বাক্স তো পুরনো ফোনেই রয়ে গেছে।
তাকে ফের চালু করে নম্বর খুঁজতে গেলে আবার বেজায় অহংকারী নতুন ফোনটা থেকে সিম খুলতে হবে। কী জ্বালা। কিছু ক্ষণেই বুঝলাম একে শুধু জ্বালা নয়, জ্বালা গাট্টা কিংবা জ্বালাময়ী গাট্টা জাতীয় কিছু বলা উচিত। নতুন ফোনের মেটাল বডি, সে পুরো আয়রনম্যান। তার ওপরে দোকানি তাকে কভার না বডিস্যুট কী একটা পরিয়ে দিয়েছে। সে সব ভেদ করে কলকব্জা খুলে সিম বার করতে গিয়ে নেলপালিশ চটে, নখ ভেঙে ছাল উঠে মাংস খুবলে যাওয়ার উপক্রম। তবু এই স্মার্টফোন কোন গুপ্তকুঠুরিতে সিমটি লুকিয়েছে, হদিশ পেলাম না। অতএব রণে ভঙ্গ দিয়ে ভগবানের হাতে সব ছেড়ে বসে রইলাম।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরই বা কী করবেন? পৃথিবী তো চালাচ্ছে আইওএস, অ্যান্ড্রয়েড আর উইন্ডোজ। তাদের আদেশে আমার ফোন বা মেসেজ এলে কী সব কোম্পানি অ্যান্থেম বাজছে। ডলবি ডিজিটাল সাউন্ড। ফলে আমি এত ক্ষণ যে গমগমে আওয়াজটাকে টিভির এইচ ডি চ্যানেলের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ভেবে অ্যাপ্রিশিয়েট করছিলাম, সেটা নাকি আসলে আমার ফোন থেকে আসছিল! সব আননোন নম্বর। মেসেজও এসেছে, কাজের কথাও লেখা তাতে, কিন্তু কে লিখেছে সে তো টেকনো-ঈশ্বরই জানেন। আমার বর্তমান দেউলিয়া অবস্থা জানিয়ে মেসেজ ব্যাক করতে গেলাম, অবশ্যই পারলাম না। শেষে কনট্যাক্ট লিস্ট খুঁজে দেখতে গেলাম, আদৌ কারও নম্বর কি এই ফোনে উঠেছে? ও বাবা, সে আমাকে যা লিস্ট দেখাল রাস্তায় পাতলে বাগবাজার টু বাঁশদ্রোণী চলে যাওয়া যাবে। আমি যাদের চিনি, যাদের প্রতি মুহূর্তে প্রয়োজন হয়, ঠিক তারা ছাড়া বিশ্বসুদ্ধ সকলের ইমেল আইডি আর ফেসবুকের অ্যাকাউন্ট আমার কনট্যাক্ট লিস্টে জ্বলজ্বল করছে।
এই ধাক্কা সামলাতে না সামলাতে খেল দেখাল মেসেজিং অ্যাপ। যাকেই মেসেজ পাঠাতে যাই ফস করে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি এর সঙ্গে ভবিষ্যতে চ্যাট করতে চাও? বেখেয়াল হয়ে হ্যাঁ বললেই, গেল। এর পর যাকে যখনই এসএমএস করতে বসছি ও বুরাতিনোর থেকেও লম্বা নাক গলাচ্ছে। তুমি কি অমুকের সঙ্গে চ্যাট করবে? এ সবে বুদ্ধিশুদ্ধি গুবলেট হয়ে মাথা নেড়ে ফেললেই খতম। সেকেন্ডের ভগ্নাংশে কিছু ভাবার কিছু করার সুযোগ না দিয়ে এ-র মেসেজ বি-কে পাঠিয়ে, এর কথা ওকে বলে দিয়ে কেলোর কীর্তি বাঁধিয়ে চলে আসবে।
এসএমএস এ হামেশাই নিজে নিজে লোকজনকে পাঠিয়ে দেয়। আর আমি একটু এসএমএস করতে চাইলেই প্রবল অসহযোগিতা করে। অক্ষর বসাতে গেলে সব সময়ই কী এক আশ্চর্য কায়দায় পাশের অক্ষরটা লিখে দেয়। টাচ ফোন কিনলে নাকি নখ মুড়িয়ে রাখতে হয়। নইলে পদে পদে ভুল অক্ষরে আঙুল বসবে, লক্ষ লক্ষ টাইপো হবে, অমনি সবজান্তা ফোন নিজে থেকে ডিকশনারি খুলে ভুল ধরবে। ফোন করতে গেলে আর এক মারাত্মক টাচি ব্যাপার। ক্ষণে ক্ষণে ফোন হোল্ডে, নয়তো গুরুত্বপূর্ণ লোকের মুখের ওপর দড়াম করে বন্ধ। কান লেগে গেছে স্ক্রিনের টাচ অপশনে। যাব্বাবা! তা হলে কি টাচফোন কিনলে কান থেকে এক হাত দূরে সরিয়ে কথা বলব?
তার পর অনুভব করলাম, পৃথিবীর ষষ্ঠ মহাসমুদ্রটি ঘোষণা করার সময় এসে গিয়েছে। অ্যাপস্‌ ওশন। বাড়ি থেকে বেরোনো মাত্র দিব্যচক্ষে সে কোথায় জ্যাম কোথায় জেলি দেখে জানিয়ে দেয়। শুধু মাঝেমধ্যে কলকাতার বদলে কোপেনহেগেনের রাস্তা দেখাবে কি না কেন যে জিজ্ঞেস করে বুঝতে পারি না। কখনও চিড়িয়াখানা দেখায়, কখনও ডায়েরি লিখতে পরামর্শ দেয়, কখনও ফোনটাকে টেলিস্কোপ বানানোর দরকার আছে কি না জানতে চায়। অফিসে বাসে ট্রামে শ্মশানে আদালতে যেখানেই থাকি আমাকে ঘিরে স্যাটেলাইটের মতো প্রদক্ষিণ করে জিমেল, ইয়াহু, গুগ্ল প্লাস, ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ, লাইন্স, উই চ্যাট এবং না জানি আরও কারা কারা! যা খুশি তাই ছবি তোলার কোনও অধিকার নেই আমার। সব সময় টিপটপ পারফেক্ট ছবি তুলতে হবে। কারণ ছবি তোলামাত্র ফোন বলে, সে ওগুলো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে দিতে চায়। সারা ক্ষণ আমাকে খাটানোর প্ল্যান। মিক্সিং মেশিন ধরিয়ে বলে গান বাছো আর তাকে নিজের মতো রিমিক্স করো। তোমার হোমওয়ার্ক। সিনেমা, গান, বইয়ের লাইব্রেরি সবাই মিলে ব্রেনের বাইরে লাইন দেয়। কে আগে ঢুকবে! সকালে স্ক্রিন চেক করতে গেলেই বুকে দমাদ্দম হাতুড়ি। রোমিং মোড অন করবে কি না জানতে চাইছে। বিশাল একটা ঘড়ি আর এক তাড়া শহরের নাম দেখায়। ‘এগুলোর কোথাও যাচ্ছ নাকি আজ? হ্যাভ আ লাভলি ট্রিপ। কোথায় যাচ্ছ বলো, ডুয়াল ক্লক সেট করব।’
এখন বাইরে পাখি ডাকলে আমি মোবাইল দেখতে ছুটি। সেটাকেও এই শয়তান যন্ত্র চুরি করে নিজের নোটিফিকেশন সাউন্ড বানিয়েছে। এক সপ্তাহ ফোন ব্যবহার করেই এক ধাক্কায় ব্যালেন্স এক হাজার টাকা কমে গেল। খোঁজ করে জানা গেল, অ্যাপ্স ফ্রি ভেবে যত খুশি ডাউনলোড করেছি, তার পর তার আপডেটেড ভার্শন-এর রিকোয়েস্ট এসেছে। লোভে পড়ে হ্যাঁ বলেছি আর তখনই প্রাণের সুখে টাকা কেটেছে। তা ছাড়া অ্যাপ্লিকেশনের সাইড এফেক্টসে ফোনের হিস্ট্রি জিয়োগ্রাফিও বদলে গেছে। সে শুধু চেঁচিয়েছে, ‘এই চার্জ দাও চার্জ দাও। এত অ্যাপস্ ঘাঁটলে চার্জার সঙ্গে নিয়ে ঘুরবে। আমার ঘন ঘন ইলেকট্রিকের খিদে পায়।’ এ দিকে টাকা যে কাটছে, সিস্টেম যে বদলাচ্ছে সে সব বলার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
তা কেন বলবে? আমার ফোন তো নয়, আসলে তো ফোনের আমি। প্রথম মোবাইল ছিল আমার টিন-এজের খেলনা, এখন বড় হয়ে আমিই এই স্মার্টফোনের খেলনা। যা চলছে, ক’দিন পরেই নতুন একটা অ্যাপ আসবে আর এই নির্বুদ্ধি ও সর্বশক্তিধর ফোন তার মধ্যে আমাকে পুরে ওএলএক্স-এ বেচে দিয়ে আসবে। তার পর আমারই বাড়িতে আমার ফোন নিজে থেকে রজনীকান্তের সুপারহিট গান চালাবে। সেই যে, বুম বুম রোবটা!!!!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.