রবিবাসরীয় প্রবন্ধ ২...
ইউ আর অনন্তমূর্তি
মার প্রথম বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৪ সাল নাগাদ। এন্ডেন্ডু মুগিয়াডা কাঠে। নামটা খানিক চড়া। তখন সত্যি বলতে কী, অতটা বুঝিনি। কারণ আমি তো সেই সময় রবীন্দ্রনাথ আর শেলির মতো রোম্যান্টিক কবিদের প্রভাবাধীন। এবং মনের এমন সৃষ্টিশীল অবস্থায় অতিরঞ্জন মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমার বইয়ের নামের এই উগ্র ভাবটাকে যদি ইংরেজিতে অনুবাদ করা যায়, তা হলে এর আক্ষরিক অর্থ দাঁড়াবে, ‘নেভার, নেভার এন্ডিং স্টোরি’।
শেলির একটা প্রভাব আমার ওপর ছিলই। কিন্তু তখন থেকেই ধীরে ধীরে টি এস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড-এর মতো আধুনিক লেখকরা আমার চেতনাকে আচ্ছন্ন করতে শুরু করেছেন। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে, আমার মতো এক তরুণ লেখক, কুড়ির কোঠায় যার বয়স, তার কল্পনার জগত্‌ তখন নিয়ন্ত্রণ করছেন দুজন মানুষ।
এক জন, সদ্য কেমব্রিজ-ফেরত অধ্যাপক সি ডি নরসিমহাইয়া। তিনি সেই সময় এফ আর লিভিস দ্বারা গভীর ভাবে অনুপ্রাণিত। মাইসোরে অনার্স ক্লাসগুলোয় তিনি আমাদের পড়াতেন। চমত্‌কার ছিল সে সব ক্লাস। নিছক পুঁথিগত বিদ্যে থেকে অনেক দূরে। ক্লাস-শেষে আমরা বন্ধুরা মিলে দল বেঁধে কফি খেতে যেতাম ইন্ডিয়ান কফি হাউসে। জায়গাটা ছিল শহরের একেবারে মধ্যিখানে। পুরো রাস্তাটা হাঁটতে হাঁটতে আমরা হইহই করে আলোচনা করতাম, ওই দিনের ক্লাসে যা পড়া হল, যা জানা গেল, তা নিয়ে। কফি হাউসের খোলামেলা পরিবেশে সেই আলোচনা আরও জমে উঠত।
বাঁশের চেয়ারগুলো টেনে বসে এক কাপ কফির অর্ডার করতাম, যাকে দুটো ভাগ করে খাওয়া হত। তার পর চলত জোর বিতর্ক। এই সমস্ত মিটিংগুলোয় সভাপতিত্ব করতেন গোপালকৃষ্ণ আডিগা। ইনিই সেই দুজন মানুষের অন্য জন, যাঁর জোরদার প্রভাব ছিল আমার ওপর। আডিগা স্থানীয় এক কলেজে ইংরেজি পড়াতেন। পুরনো ঘরানার ইনি এক জন বিখ্যাত কবি। কিন্তু নিজের সত্তার বিরুদ্ধে যাওয়ার, বা বলা ভাল, নিজের সত্তাকে পেরিয়ে যাওয়ার, এক দুরন্ত সাহস ও ক্ষমতা ছিল তাঁর। পরবর্তী কালে তিনি এক জন আধুনিক কবি হয়ে উঠেন বীতশ্রদ্ধ, রাগী এবং ব্যঙ্গ-প্রিয়।
ওই সব দিনে আমি ছিলাম সোশ্যালিস্ট। চেয়েছিলাম শেলির স্বপ্নকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমাদের বাড়ির কাছে একটি গ্রামে কৃষকদের লড়াইয়ের, আন্দোলনেরও অংশী হয়েছিলাম আমি। তা সত্ত্বেও, আমার লেখা গল্পগুলো কখনওই রাজনৈতিক ছিল না। কারণ, এক জন সাচ্চা সোশ্যালিস্ট হওয়ার দরুন, সোভিয়েত ইউনিয়নের ‘সোশ্যালিস্ট রিয়ালিজ্ম’ নিয়ে বিতর্কের সঙ্গে আমি পরিচিত ছিলাম। আমরা বিশ্বাস করতাম, সাহিত্যকে কখনও রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার বানানো উচিত নয়।
সাহিত্য সম্পর্কে এই নতুন ঘরানার দৃষ্টিভঙ্গি, যা আমার মতো মানুষরা অনুসরণ করতেন, তা ‘প্রগতিশীল’ তকমা পাওয়া সাহিত্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। সেই সময় প্রগতিশীল সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এক বিখ্যাত বামপন্থী লেখক, যাঁকে কন্নড়ে নিরঞ্জনা বলে ডাকা হত। আমার প্রকাশিত গল্পগুলি সম্পূর্ণ সাহিত্যধর্মীই ছিল। তবে আমি কিছু রাজনৈতিক প্রবন্ধও লিখেছিলাম। কিন্তু ওগুলো বাতিলও করে দিই। কারণ এলিয়ট-এর কবিতা ‘প্রিলিউড্স’ পড়ার পর আমার চেতনাজগতে এক বড় পরিবর্তন এসেছিল
‘দ্য উইন্টার ইভনিং সেটল্স ডাউন
উইথ স্মেল অব স্টেক ইন প্যাসেজ ওয়েজ
সিক্স ও ক্লক’

সে সময় সারা ভারত জুড়ে এই থিম নিয়ে প্রগতিবাদী আর আধুনিকপন্থীদের মধ্যে আলোচনা চলছিল। শেলির ছাত্র হিসেবে আমি এই দুইয়ের মধ্যে খুব গভীর ভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম এবং আধুনিক কবিতার বিরোধিতাও করি। টি এস এলিয়ট সম্পর্কে আমার ধারণা দাঁড়ায় এই যে, তিনি এক জন পিছিয়ে থাকা মানুষ এবং অবশ্যই প্রতিক্রিয়াশীল।
‘এন্ডেন্ডু মুগিয়াডা কাঠে’ প্রকাশিত হওয়ার আগে নিরঞ্জনা-র ঘরানা এবং আডিগা-র ঘরানা, এই দুই মেরুর তীব্র ও গভীর আলোচনা শুনতাম, নিজেও অংশ নিতাম। এক বার মনে হত, এই দল ঠিক কথা বলছে, পর মুহূর্তে মনে হত, ওই দলের প্রতিটি যুক্তিই একেবারে অকাট্য! শেষমেশ আমাকে অবশ্য জিতে নিল ‘আধুনিক’ সাহিত্যের ধারা, যার প্রতিনিধি আমার কাছে সবচেয়ে বেশি করে ছিল দুজন মানুষ এক জন শিক্ষক এবং অন্য জন অগ্রজপ্রতিম কবি-বন্ধু। ‘নব্য’ সাহিত্য আন্দোলনও (যা আমরা কয়েক জন মিলে গড়ে তুলেছিলাম), অতএব, সেই আশ্চর্য দোলাচলময় মথিত সময়ের ফসল, যে সময় কন্নড় ভাষার অনেক লেখকই রবীন্দ্রনাথ, ভারতীয়ার, কুভেম্পু ও বেন্দ্রে-র মহান উত্তরাধিকারের সমালোচক হয়ে ওঠার চেষ্টা করছিলেন। এই লড়াই আজও চলছে। কিন্তু এর ফলে আরও সমৃদ্ধ এবং আরও পরিণত ভাবে ওই পুরনো রোম্যান্টিক সাহিত্যকে ফের পাঠ করা হয়েছে।
গল্পগুলো লেখার পর আমি আডিগার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এই লেখাগুলোর মধ্যে ও দেখতে পেয়েছিল গদ্যের ক্ষেত্রে এক নতুন চেতনার জন্ম। আমার বন্ধু সিন্ধুভাল্লি অনন্তমূর্তি, যে নিজেও কন্নড় সাহিত্যের ছাত্র, ওর প্রকাশনা সংস্থা ‘সুরুচি’ থেকে বইটি ছেপে বের করে। ওদের প্রকাশনায়ও আমার বইটিই ছিল প্রথম।
এই বইয়ে, আমার অন্তত তিনখানি গল্পের কাঠামো বেশ জটিল। আজও পাঠকের মনে সেগুলির একটা জায়গা আছে, যদ্দূর জানি। গল্পগুলি হল এন্ডেন্ডু মুগিয়াডা কাঠে, যেখানে এক জন বৃদ্ধ এবং তাঁর স্ত্রী উনুনের উষ্ণতায় নিজেদের সেঁকে নিতে নিতে যৌবন এবং শৈশবের স্মৃতিচর্বণ করছেন। নেপথ্যে খেলে বেড়াচ্ছে তাঁদের নাতিনাতনিরা একই গল্পের পুনরাবৃত্তি। অন্য গল্পটি তায়ি (মা)। গল্পটা খুব নিষ্ঠুর এবং এ ধরনের নামকরণ দেখলেই যে ছবিটা চোখে ভাসে, আদৌ তা নয়। তৃতীয়টি হুলিয়া হেঙ্গারালু (বাঘের মেয়েলি যন্ত্রণা)। গল্পগুলো বেশ জনপ্রিয় হয়।
তার পর আমরা অন্তত পাঁচ জন এমন লেখককে পাই, যাঁরা, আমরা যাকে বলি ‘নতুন’ গল্প, তা লিখতে শুরু করেন। আমার কাছে এই সংগ্রহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এর মুখবন্ধটি, যেটি কবি আডিগা নিজে লিখে দিয়েছিলেন। সেই ভূমিকাটিতে তিনি জোর দিয়েছিলেন আমার গদ্যের আন্তরিকতার দিকটির ওপর, এবং গল্পগুলোর মধ্যে যে বিবরণ দেওয়া হচ্ছে, তাকে ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতার ওপর। তিনি সেখানে একটা চমত্‌কার বাক্য লিখেছিলেন: ‘অনন্তমূর্তি পরবর্তী কালে এর চেয়ে ভাল গল্প লিখতেও পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু ও ছেঁদো আবেগসর্বস্ব জিনিসপত্র লিখে, সেগুলোকে সাহিত্য বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা কিছুতেই করবে না।’
এই সব গল্পের বয়স এখন ষাট পেরিয়ে গিয়েছে। এগুলো আমায় স্মৃতিমেদুর করে তোলে। মনে পড়িয়ে দেয় আমার তারুণ্যের দিবাস্বপ্নের দিনগুলোর কথা, এবং বাস্তবের, বা বলা ভাল ‘বাস্তবতা’র সঙ্গে নিজেকে ও নিজের চিন্তা-ধরনকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সেই মারকাটারি ও উপভোগ্য লড়াইয়ের কথা।

লেখক মূল লেখাটি ইংরেজিতে লিখে পাঠিয়েছেন


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.