ফুটপাতের একটি ছাউনি মাত্র, কিন্তু নিজের আইডিয়ায় তাকে গড়ে তুলেছেন কার্তিকবাবু। চার দিকে কোনও প্লাস্টিক শিট কিংবা তেরপল দিয়ে বানানো দেওয়ালের আপাত সুরক্ষা নেই। বরং ছোট ছোট পিচবোর্ড বা প্লাস্টিকের টুকরো জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে পরদা। কোনওটায় লেখা তাঁর থিয়োরি, কোনওটায় তাঁর সৌরমণ্ডলের মডেল, কোনওটায় আমজনতার উদ্দেশে বক্তব্য, আবার কোনওটায় বিজ্ঞানীদের প্রতি তির্যক মন্তব্য। নিজের তত্ত্ব দিয়েই নিজের ঘর গড়েছেন তিনি। আক্ষরিক ভাবেই নিজের আইডিয়ার ভেতর বেঁচে রয়েছেন। যেন সেই বিদেশি ছবিতে দেখা পাদরির ঘর, যে ঘরের দেওয়াল জুড়ে সাঁটা বাইবেলের পাতা। যেন এক বর্ম, এক রক্ষাকবচ যেন এ ঘরে কোনও ক্রমেই না ঢুকে পড়তে পারে শয়তান! এ পৃথিবীতে অন্তত একটি ঘর আছে, যে ঘরে পৃথিবী স্থির, তাকে কেন্দ্র করে ঘুরে চলেছে সূর্য!
সাংবাদিকতার সূত্রেই বছর পাঁচেক আগেও এক বার গিয়েছিলাম ওঁর বাড়ি। হাওড়া শহরে। মনে আছে, পাকা বাড়ি। সামনে কিছুটা জমি। সে সব ছেড়ে এই ফুটপাত কেন? উত্তরে বুঝলাম, নেপথ্যে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর পারিবারিক সমস্যা। হয়তো রয়েছে তাঁর এই একান্ত ব্যক্তিগত ‘সত্য’-র পিছনে সব কিছু ভুলে ছুটে চলাও। এই ‘পাগলামি’ আর কাঁহাতক সহ্য করা যায়! প্রতি মাসে পেনশনের কয়েক হাজার টাকাও নাকি তিনি আর হাতে পান না। জোটে মোটে পাঁচশো টাকা। ‘ইচ্ছে করলে কোর্টে যেতে পারতাম, কিন্তু সে আমি পছন্দ করি না।’ তা হলে চলে কী করে? হাসতে হাসতে বুঝিয়ে দিলেন কার্তিকবাবু ‘মাসে পাঁচশো মানে, দিনে সতেরো টাকার মতো করে দাঁড়াচ্ছে। মোটামুটি খরচ ওতেই চলে যায়। দু’টাকা লাগে সকালে চা খেতে, দু’টাকা লাগে পায়খানা করতে। নস্যির জন্য সামান্য খরচ। বাকি টাকায় রান্নাবান্না। এ ছাড়াও তো বই বিক্রির টাকা থেকে লাভ থাকে।’ আমার বেসিক-পিএফ-ইএমআই-মুদিখানার জটিল সুদকষায় অভ্যস্ত মস্তিষ্কে এত সরল পাটিগণিত ঢুকছিল না। তিনি বলতে থাকেন ‘মা মারা যাওয়ার পরে গ্রামের বাড়িটাও বিক্রি করে দিই এক আত্মীয়কে। সেখানেও আশি হাজার পাঁচশো টাকা পাওনা। আড়াই বছর হয়ে গেল, কিন্তু আমি চুপ করে আছি, দেখি কবে দেয়। এখন যদি আমি ঝগড়ার মধ্যে যাই, আমার প্রচারের কাজটায় ভাটা পড়ে যাবে।’
আমি একটু কেয়ারিং হয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘কিন্তু ফুটপাতে এ ভাবে থাকাটা কতটা সেফ?’ কার্তিকবাবু বলেন, ‘আমি তো এ সব খুলে রেখেই চলে যাই। তবে হ্যাঁ, আমার মোবাইলটা এখান থেকেই চুরি হয়ে গিয়েছে। তার পর দুজন আমাকে ফ্রি-তে ফোন দিতে চেয়েছে, বইমেলায়। আমি নিইনি। কেননা, যার ইন্টারেস্ট থাকবে, সে আমার কাছে আসবে। আমি যদি এত পরিশ্রম করে থাকি, এত পয়সা খরচ করে থাকি, সে দুটো মিনিট আর দশ-বিশ টাকা খরচ করে আসতে পারবে না? আমি রাস্তায় থাকি, এখানে অনেক পাতাখোর গাঁজাখোর ঘুরে বেড়ায়। তাদের এক দিন কম পড়লে, হয়তো আমাকে মেরে দিয়ে ফোনটা নিয়ে চলে যাবে। তখন, আমার এই আবিষ্কারের কী হবে? ফোন-টোন আমার চাই না। তবু, রাতে শোওয়ার সময় আমি মাথার কাছে একটা ছুরি নিয়ে শুই...’
‘আমার জীবনের কথা লিখে কী হবে, আমার তত্ত্বটা নিয়ে লিখুন।’ জানতে চেয়েছিলাম ওঁর পড়াশোনা কাজকর্ম সম্পর্কে। দ্বিতীয় বার অনুরোধে বলতে শুরু করলেন। জন্ম হাওড়ার আমতার আনুলিয়া গ্রামে। ১৯৪২ সালে। পড়াশোনা গ্রামেই। একটু বেশি বয়সেই ভরতি হন এআরবি হাইস্কুলে। ক্লাস থ্রি-তে। পয়সার দরকার, অতএব ক্লাস এইট-এই প্রথাগত শিক্ষায় ইতি। এলেন কলকাতা। কখনও মোটর-মেকানিকের কাজ, কখনও গড়িয়াহাটে আলু-পেঁয়াজ বিক্রি। এ সময়ই ডাক এল মিলিটারি থেকে। সেটা ১৯৬২। ভারত-চিন যুদ্ধ। প্রথমে উত্তরপ্রদেশের ফতেহ্গড়। রাজপুত রেজিমেন্টে কাটল দু’বছর। তার পর প্যারাশুট রেজিমেন্টের হাবিলদার। টানা পনেরো বছর। এই ’৬২ সালেই সন্ধে বা রাতে ডিউটির সময় সন্ধ্যাতারার দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতে হঠাত্ই মনে প্রশ্ন দানা বাঁধে। চার মাস পর্যবেক্ষণের পর জোরদার হয় সন্দেহ। স্রেফ এক হাত লম্বা একটি পাইপ জানালার সঙ্গে বেঁধে চলে নজরদারি। কখনও তা ধ্রুবতারার দিকে তাক করা, কখনও সপ্তর্ষিমণ্ডলের কোনও তারার দিকে, কখনও আবার দিনের বেলায় পাইপের ফুটোয় সূর্য! প্রাপ্ত ফলের ওপর নির্ভর করে চলতে থাকে বিশ্লেষণ। দেখতে দেখতে কেটে যায় বারো বছর। ১৯৭৪ সালে তিনি নিশ্চিত হন পৃথিবী স্থির, সূর্যই ঘুরছে তাকে কেন্দ্র করে।
হাত-টাত নেড়ে, প্রায় ডেমনস্ট্রেট করার ভঙ্গিতে বলে যাচ্ছিলেন কার্তিকবাবু। দেখছিলাম, এক জন সত্তরোর্ধ্ব মানুষেরও কী ভয়ংকর প্রাণশক্তি থাকতে পারে। সব সময় যেন ফুটছেন। ‘এই ছবিটায় আসতে আমার বারো বছর লেগে গেল। তার পর এই তত্ত্বকে যখন ভূগোল বইয়ের যে-কোনও প্রশ্ন করেছি, সব উত্তর পেয়ে গিয়েছি। এ বার আমি দেখলাম, আমার থিয়োরিটাকে দাঁড় করাতে গেলে আমাকে তো ইতিহাস জানতে হবে। আপনি যদি আমাকে টলেমির থিয়োরি জিজ্ঞেস করেন, আর আমি বলতে না পারি, তা হলে তো আমি বেওকুফ বনে যাব! সে সময় আগ্রা ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি আমাকে ফ্রি-তে নানা বইপত্র পড়ার সুযোগ দিল।’ চলল ক্লাস এইট ড্রপ-আউট ছাত্রের জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাস পাঠ। গ্যালিলিয়ো, অ্যারিস্টট্ল, কোপার্নিকাস, টলেমি, আর্যভট্ট...। একই সঙ্গে তিনি শুরু করে দিলেন প্রচার।
দু’মাসের ছুটিতে বাড়ি ফিরতেন। হাজার কপি করে ছাপিয়ে নিতেন তাঁর তত্ত্ব। বিলোতেন স্কুলে স্কুলে। এ সময়ই উত্তরপ্রদেশের ‘অমর উজালা’ সংবাদপত্রে সবিস্তার ছাপা হল তাঁর গবেষণার কথা। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে তা আসতেই শুরু হল সমস্যা। বিনা অনুমতিতে সাক্ষাত্কার দেওয়ায় সার্ভিস রেকর্ডে পড়ল লাল কালির দাগ। আরও দু’বার রেড এন্ট্রির পর শো-কজ করা হল কার্তিকবাবুকে। ‘আমি বলে দিলাম, চাকরি করব না, আমি কোনও জবাব দিতে চাই না। আমার প্রচারেরও অসুবিধে হচ্ছিল। নিয়ম আছে, শো-কজের এক মাসের মধ্যে জবাব না দিলে অটোমেটিক আউট করে দেওয়ার। আমাকেও আউট করে দিল। আমি খুশিই হলাম। সেটা ১৯৭৯। ফিরে এলাম। এসে, এক বছর আমি আমার বই বিক্রি করে সংসার চালিয়েছি... চার ছেলেমেয়ে... সকাল সাতটায় বেরোতাম, বারোটায় বাড়ি ফিরতাম... খেয়েদেয়ে আবার বেরোতাম, রাত দশটায় ফিরতাম! তার পর, ১৯৮০ সালে আমি ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডে চাকরি পাই। রিটায়ার করি ২০০৫-এ। তখন পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলাম। আমার বউ...’ সেই সম্বলটুকুও হারানোর কথা বলতে থাকেন আবার। কিন্তু সেখানে কোনও আক্ষেপ বাসা বাঁধার সময় পায় না। কেন না, তত ক্ষণে আবার তিনি ঘুরে গিয়েছেন তাঁর তত্ত্বের দিকে। সেই তত্ত্ব প্রচারের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলতে শুরু করে দিয়েছেন।
‘এখন তো শুধু দু’ঘণ্টা লেকচার করি। বাসে বাসে। সকাল ন’টা থেকে এগারোটা। দু’ঘণ্টায় আমি পঞ্চাশ টাকার বিক্রি করে দেব। তাও তো এখন দাম কমিয়ে দিয়েছি। এক টাকা আর পাঁচ টাকা। আগে দশ টাকা ছিল, এখন পাতা কমিয়েছি। পুরো ইতিহাস দিলে আমার খরচ বেড়ে যাচ্ছিল। মানুষ তো মোদ্দা জিনিসটা জানতে চায়। ইতিহাস তারা জানতে চায়, যারা আমার সঙ্গে তর্ক করবে। তারা তো ইতিহাস পড়লেই জানতে পারবে, আমার বই পড়ার দরকার নেই। তা ছাড়া কিছু কিছু বিশেষ জায়গায় আমি এমনিতেই বিলি করি, পয়সা নিই না। ইংলিশ বইটা ফরেনারদের জন্য ফ্রি। তবে ফরেনাররা সবাই তো আর পণ্ডিত নয়, তাদের মধ্যেও আমাদের মতো গাধা আছে! কেউ হয়তো পড়তে চাইল না। নিল না-নিল, বয়ে গেল! যে নিল নিউ থিয়োরি: দ্য সান গোজ অ্যারাউন্ড দি আর্থ ওয়ান্স ইন আ ইয়ার, চ্যালেঞ্জ ফর অল সায়েন্টিস্ট অল ওভার দি ওয়ার্ল্ড ইংলিশে বলে দিলাম।’ এক লাখ টাকার চ্যালেঞ্জ। এক জন ফুটপাতবাসীর। তাঁর ফুটপাতের বাসার গায়েই একটা বোর্ডে বড় বড় করে লেখা!
পালটা বিরোধিতার মুখেও অনেক বার পড়তে হয়েছে। কখনও ফোনে হুমকি এসেছে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব! কখনও চিঠি। সে সব চিঠি নিজের বইতেও ছেপেছেন কার্তিকবাবু। তাঁর পাওয়া প্রথম চিঠিটি ১৯৮০ সালের ২৩ মার্চ লেখা। শুরুর দু’কথার পর প্রেরক লিখছেন ‘...আমার মনে হচ্ছে আপনি একটি দু’পেয়ে গরু। আচ্ছা, সত্যি করে বলুন তো, আপনার গাঁজা খাওয়া কি অভ্যাস আছে? আপনার যদি নেশায় গাঁজা কম পড়ে, তা হলে দয়া করে জানাবেন। আমরা আপনার মাথার ছিট ছাড়াবার জন্য সযত্নে গাঁজা পাঠিয়ে দেব।’ আবার, ৩/৪/৮১ তারিখে আর এক জন তাঁকে লিখছেন ‘...একটি কথা বারংবার জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা হয় যে আপনি কি রাঁচীর পাগলখানার একজন প্রাচীন সভ্য ছিলেন? তাহা না হইলে এই ধরণের মস্তিষ্কের উর্ব্বরতা কোথা হইতে আসিল? অতএব আমরা ইহাই সাব্যস্ত করিলাম যে, আপনি গাঁজা খাইয়া থিয়োরীটি উদ্ভাবন করিয়াছেন, অতএব আপনার প্রাপ্য পুরস্কার হলো একটি সুদীর্ঘ ঘুঁটের মালা।’ আবার প্রচারের সময় সরাসরি প্রতিবাদের সামনেও পড়তে হয়েছে। কেউ সরব হয়েছে বইমেলায় তাঁর ক্যানভাসিং-এর সময়, কেউ চলতি বাস থেকে তাঁকে নামিয়ে দিতে চেয়েছে। কখনও আবার প্রতিবাদ আরও দু-এক ডিগ্রি কড়া। ‘এক বার দু’জন আমাকে বলল, প্রোফেসরের কাছে নিয়ে যাব। বলে, লালবাজারে ধরে নিয়ে গেল। লালবাজার বলল এটা আমাদের আন্ডারে নয়। তার পর নিয়ে গেল হেয়ার স্ট্রিট থানায়। সেখানে ডায়েরি লিখল। অফিসার বলল ‘আরে, এনার একটা বক্তব্য আছে, বলছেন। আপনাদের ভাল লাগে শুনুন, না হলে শুনবেন না। আপনাদের তো জোর করে কেউ দিচ্ছে না বইটা।’ আমায় ছেড়ে দিল। আর এক বার হয়েছিল শিয়ালদার কাছে। এক জন প্রোফেসর জনা দশেক ছাত্র এনেছে। আমি তখন আমেরিকা থেকে আসা চিঠিগুলো ঝুলিয়ে রাখতাম। ওরা চেষ্টা করছিল কাগজগুলো ছিঁড়ে ফেলার। আমি ছিঁড়তে দিইনি, আমাকে ধাক্কা মেরে মেরে নিয়ে গেল শিয়ালদার কাছে একটা পুলিশ ফাঁড়িতে। অফিসারকে বললাম আমি একটা নতুন জিনিস আবিষ্কার করেছি, সেটাই প্রচার করছি, এরা আমায় ফালতু ধাক্কা মেরে এখানে নিয়ে এল। অফিসার বললেন দেখুন, আপনি একা, এরা দশ জন। আপনি আর আসবেন না এখানে। আমি বললাম ঠিক আছে। বলে, কেটে পড়লাম। আর যেতাম না ওখানে। এক বছর অন্তর এক দিন করে যেতাম, পর দিন দল বেঁধে এলেও আমাকে আর দেখতে পেত না!’
কে সি পাল-কে আমার তখন ফ্যাতাড়ু মনে হচ্ছে। রাষ্ট্রের কাছে একটা চোরা থ্রেট। পাগল-ছাগল ইমেজের একটা মানুষ রাসবিহারীর ফুটপাত থেকে গোটা বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। তাবত্ বিজ্ঞান যখন ‘ঘোরো ঘোরো ঘোরো’ বলে পৃথিবীর নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে, তিনি উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে এক কথায় ‘স্টপ’ বলে সব থামিয়ে দিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে আঙুল তুলে বলছেন, ‘একটা ছবি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিচ্ছে। আমি অনেক চেষ্টা করেছি আমার থিয়োরির ভুল ধরার, পারিনি। কারও ক্ষমতা নেই এর ভুল ধরার।’ তাঁর কথায় কথায় রাম-শ্যাম-যদুর মতো উঠে আসছেন টলেমি, কোপার্নিকাস, পিথাগোরাস, অ্যারিস্টট্ল, কেপ্লার। অনায়াসে কাউকে উড়িয়ে দিচ্ছেন, কেউ কিঞ্চিত্ নম্বরও পাচ্ছেন। ‘কোপার্নিকাস, গ্যালিলিয়ো ভুল করেছিলেন, সেই ভুলটাই এখন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ পড়ছে। আমার থিয়োরিটা যে দিন স্বীকৃতি পাবে, সে দিন পৃথিবীর পাঁচশো কোটি মানুষ আমার কথাটাই মানবে।’
ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম, একটা প্রশ্ন ওঁকে করা হল না দেওয়ালে, পোস্টারে উনি শুধু সাদা আর কালো রং-ই কেন ব্যবহার করেন? খরচের কারণে? না কি সাদা-কালোর বৈপরীত্যটা আসলে সত্য আর মিথ্যার মতোই বলে। একটা লড়াই ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইটের। হ্যাঁ বনাম না। চল্লিশ বছর হতে চলল, যে লড়াইয়ে তিনি একাই একটা পক্ষ। উলটো দিকে আমি, আপনি, মনমোহন সিংহ, বারাক ওবামা, বিড়লা তারামণ্ডল, কেনেডি স্পেস সেন্টার... সব্বাই। গোটা দুনিয়া। তবু এক দিন এক মুহূর্তের জন্যও এতটুকু দুর্বল হয়ে পড়েননি ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই প্রাক্তন সদস্যটি। তিনি জানেন, তাঁকে নিয়ে সর্বত্র ব্যঙ্গ করা হয়। আড়ালে নয়, সামনেই লোকে হাসে, বইমেলায় ঘিরে ধরে হ্যারাস করে, কখনও তাঁর প্রচার শুনে খিস্তি মেরে চলে যায়, তবু সমান তেজ নিয়ে লড়ে গিয়েছেন তিনি। সামান্য ট্যারা কথা, তা সে শাশুড়ির মুখ থেকেই হোক বা বসের মুখ থেকে বঙ্গললনা আর বাঙালি বীরপুঙ্গবদের আধরাতের ঘুম কেড়ে নেয়। সেই জাতে এমন এক মানুষ সত্যিই বিরলতম, যিনি হাজারও অপমান, যাবতীয় বাধা সত্ত্বেও নিজের প্রতিপাদ্যে অবিচল থাকতে পারেন বছরের পর বছর।
তত্ত্বটা ঠিক না ভুল, সত্যিই ‘নাসা’ এক দিন তাঁর কথা মেনে নেবে কি না, ছেড়ে দিন। সেই লোকটার কথা ভাবুন, যাঁর ছেলেমেয়েরা অবধি স্কুলে গিয়ে যা পড়ে আসছে, তা তাদের বাবার কথাকে সরাসরি প্রলাপ বলে প্রমাণ করে। তবু সেই লোকটা তাঁর বিশ্বাস থেকে এক চুলও নড়ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, সেই বিশ্বাসটা শুধু তক্তপোশে শুয়ে শুয়ে লালন করলে চলে না। সেটা প্রচারের জন্য গোটা শহর জুড়ে নিজের হাতে লেখাগুলো লিখতে হয়, পাতাগুলো নিজের গাঁটের কড়ি খসিয়ে ছাপতে হয়, বাস্তব পৃথিবীতে সরাসরি গলার শির ফাটিয়ে তা জোরে জোরে বলতে হয়। জীবনের প্রতিটি দিন মাস বছর মুহূর্ত, শরীর মন শক্তি আশা, সব এই একটা প্রোজেক্টে নিংড়ে নিংড়ে খরচা করে ফেলতে হয়। এবং এই সমস্তটাই করতে হয় পুরোপুরি জেনে, যে, পৃথিবীতে এক জনও তাঁর পক্ষে নেই, এক জনও না, এবং গলা দিয়ে রক্ত উঠে এলেও এক জনও তাঁর পক্ষে চলে আসার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। এই রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে একটা লোক একাত্তর বছর বয়সে এতটুকু অপ্রসন্ন নন। একটা কথাতেও কোনও হতাশা ধরা পড়ে না। ক্রোধ, ক্ষোভ, বিলাপ, আর্তনাদ যা প্রায় সব বাঙালি নিত্য ভাতে মেখে খায়, তা তাঁর মধ্যে প্রবেশাধিকারই পায়নি। তিনি জান লড়িয়ে দিচ্ছেন শুধু তাঁর তত্ত্বটা আঁকড়ে। অন্তত এই জায়গায়, ডেডিকেশন আর টেনাসিটির প্রশ্নে, তিনি আমাদের ইতিহাসের অতিমানবিক চরিত্রগুলির সঙ্গে তুলনীয় নন কি? তিনি লড়াইটা কি গ্যালিলিয়োর চেয়ে কম লড়ছেন? তিনি আরও অপেক্ষা করতে রাজি। তাঁর স্থির বিশ্বাস, এক দিন না এক দিন তিনি জিতবেনই। না, কথাটা ঠিক হল না তিনি জানেন, এই লড়াইয়ে সৃষ্টির আদি থেকেই তিনি জিতে রয়েছেন। তাঁর তত্ত্বই ষোলো আনা অভ্রান্ত, নির্ভুল। এই বিশ্বাসই তাঁর পুঁজি। এই বিশ্বাসে ভর করেই তিনি বেঁচে রয়েছেন। তাঁর এই বেঁচে থাকার চেয়ে বড় সত্যি আর কিছু নেই। আসলে কে কার চার দিকে ঘুরল, তাতে শেষ অবধি কিস্যু যায়-আসে না। |