প্রবন্ধ...
আত্মঘাতী বাংলা
কেউ বলে বিপ্লবী, কেউ বলে খিস্তিবাজ! ফ্যাতাড়ু-ভাষার ভবিষ্যৎটা তা হলে কী রকম? ‘কাঙাল মালসাট’ সিনেমার পর্দায় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে মার্শাল ভদি অবশ্য খিঁচিয়ে উঠছেন, ‘চাইলেই ফ্যাতাড়ু, চোক্তার এই সব টাইট্ল মেলে না।... খবরের কাগজে নেই, এফএমে নেই, টিভিতে নেই, ইন্টারনেটে নেই, ও সব বালের কোত্থাও নেই।’ শুনে উচ্ছ্বাসে, হাততালিতে ফেটে পড়ছে মাল্টিপ্লেক্সের দর্শক।
প্রকাশ্যে সেন্সরড খিস্তি শোনার অবদমিত আনন্দ? কিন্তু এ জিনিস নতুন নয়। গত কয়েক বছর ধরে ‘বাইশে শ্রাবণ’ থেকে অনেক ছবিতেই এই শব্দচ্ছটা। আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত রুচিশীল বাঙালি সংস্কৃতির শিউরে ওঠা!
এই রুচিশীল মধ্যবিত্তপনা ভাষাটার সাড়ে সর্বনাশ করে ছেড়ে দিচ্ছে না তো? ‘চিলেকোঠার সেপাই’ উপন্যাসে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস অক্লেশে লিখেছিলেন, ওসমান ছাদের ধারে পেচ্ছাব করতে গেল! পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিমান বাঙালি অবশ্য সব সময় প্রস্রাব করেন। ইংরেজিতে ‘শিট’ কিংবা বড় হাতের এফ-এর পর তিন তারা, কিছুতেই আপত্তি নেই। কিন্তু বাংলা ভাষায় নিতান্ত এক শারীরবৃত্তীয় কাজকেও তাঁরা তৎসম ভব্যতায় ঢেকে রাখতে চান। দ্বিভাষিক দ্বিচারিতা বললে ভুল হবে কি?
‘সেন্টার (ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস)’-এর সংস্কৃতিবিদ্যার অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ও চার পাশে এই দ্বিচারিতাই দেখছেন, “কলকাতার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে বাংলা ভাষার অবস্থা খুব খারাপ। এখানে বাংলা ভুল বললে কেউ লজ্জিত হয় না, ইংরেজি ভুল বললে লজ্জার একশেষ!” সাহিত্য অকাদেমির প্রাক্তন সচিব, মলয়ালম সাহিত্যিক সচ্চিদানন্দন আফশোস করছিলেন, “তরুণরা ক’জন আর মলয়ালম কাগজ বা বই-টই পড়ে! সবাই ইংরেজি পড়ে!” গোলকায়নের যুগে সর্বত্র এক হাল।
ইংরেজি অবশ্য কয়েক প্রজন্মের ভারতীয় ভাষা। সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের স্মৃতিকথায় একটি মজার ঘটনা আছে। ষাটের দশক। ঠিক হয়েছে হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা হবে। সংসদীয় কমিটির প্রধান গোবিন্দবল্লভ পন্থ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে রিপোর্ট পেশ করতে গিয়েছেন। নেহরু রিপোর্ট দেখে আগুন, “কী লিখেছেন? হিন্দির পাশে ইংরেজি হবে ‘সাবসিডিয়ারি’ ভাষা! দুর দুর! সাবসিডিয়ারি মানে ভ্যাসাল— সামন্ত প্রভুর ভাষা! ইংরেজি হল সামন্তদের ভাষা!” শেষে বিলে ‘সাবসিডিয়ারি’ কেটে ‘অ্যাডিশনাল’, ‘অ্যাসোসিয়েট’ ইত্যাদি শব্দ। নেহরু যদি ‘সাবসিডিয়ারি’ স্তর থেকে সে দিন ইংরেজিকে তুলে না আনতেন, আজ অবস্থা আরও খারাপ হত। বিশ্ববাজারে পাত্তা পেতে দ্রাবিড়-উৎকল-বঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে চিনা শিখতে হত। ইংল্যান্ড, আমেরিকাতেও আজকাল কেউ ফরাসি, জার্মান শিখতে চায় না, চিনা শেখার স্কুল ক্রমশ বাড়ছে। ভাষা ক্ষমতার বাহন।
মুসৌরি শহরের অদূরে একশো বছরের পুরনো ল্যান্ডোর ল্যাঙ্গুয়েজ স্কুল। সেখানে আজও অনেকে ভারতীয় ভাষা শিখতে আসেন। তিরিশ বছর আগেও বাংলা শেখানো হত। স্কুলের অধ্যক্ষ চিত্তরঞ্জন দত্ত বলছিলেন, “কোর্সটা তুলে দিতে বাধ্য হয়েছি। বিদেশিরা হিন্দি, উর্দু শিখতে চান। বাংলা শেখার এক জনও নেই।” রামমোহন-বিদ্যাসাগর-রবীন্দ্রনাথের ভাষার এই হাল? শিবাজীবাবুর বক্তব্য, “সাংস্কৃতিক বিগ্রহের আরাধনা এক জিনিস, ভাষা আর এক।”
আর কথায় কথায় আইকন তুলে ধরাতেই অক্ষমের আস্ফালন। কলকাতা শহর নিয়ে অমিত চৌধুরীর সাম্প্রতিক ‘ক্যালকাটা: টু ইয়ার্স ইন দ্য সিটি’ বইয়ে পার্ক স্ট্রিট থেকে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত অবধি অনেক প্রসঙ্গ। তাঁর পর্যবেক্ষণ, “বাংলা আগে কসমোপলিটান ভাষা ছিল। এখন প্রান্তিক ভাষার জাত্যভিমান।” জাত্যভিমান যে কত রকম! বছর কয়েক আগেও অনেকে কাঁদুনি গাইতেন, “বাচ্চারা এত হ্যারি পটার আর ভ্যাম্পায়ার সিরিজ পড়ে কেন? আমাদের ঠাকুমার ঝুলি, লীলা মজুমদার, সুকুমার রায় নেই?”
ইংরেজি ভাষায় ‘নো ফিয়ার শেক্সপিয়ার’ সিরিজ এখন বেশ জনপ্রিয়। আজকের ভাষায় শেক্সপিয়ার। হোরেশিয়ো সেখানে হ্যামলেটকে ‘হেল টু ইয়োর লর্ডশিপ’ বলে না। বলে, ‘হ্যালো, স্যার।’ বাঙালি চিন্তিত, ছেলেময়েরা এই ফাস্ট ফুডের পর কি আর আসল শেক্সপিয়ার খাবে? সুকান্ত চৌধুরী হেসে বললেন, “ইংল্যান্ড, আমেরিকায় যেখানে মাতৃভাষা ইংরেজি, সেখানে ক’টা লোক আসল শেক্সপিয়ার পড়ে বুঝতে পারে?” বাংলায় এই রকম এক্সপেরিমেন্ট? পাগল! বাঙালি ট্রাফিক সিগন্যালে রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনে।
অবস্থা কিন্তু এই রকম হওয়ার কথা ছিল না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজির অধ্যাপক স্বপন চক্রবর্তী জানালেন, বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাই প্রায় নতুন। চর্যাপদের উৎপত্তি নবম-দশম শতাব্দী নাগাদ। অন্য দিকে নবম শতাব্দীতে আলফ্রেড দ্য গ্রেটের সময় থেকে ইংরেজি ভাষাটাকে চেনা যায়। তার আগে নর্স, কেল্টিক অনেকেই প্রাচীন ভাষাটার ওপর দাবি করতে পারে। পুরনো বাংলার সঙ্গে মৈথিলির সম্পর্ক যেমন!
বাম রাজত্বের ইংরেজি হঠাও নীতি এই ঐতিহাসিক সম্পর্কেই ছেদ টেনে দিল। “ঘটনাটা মারাত্মক! নাইজিরিয়া, ভিয়েতনাম আজও নিজেদের ভাষার পাশাপাশি ফরাসি পড়ে। লাতিন আমেরিকার দেশগুলি নিজেদের ভাষার সঙ্গে স্প্যানিশ বা পর্তুগিজ শেখে,” বলছিলেন ‘কাঙাল মালসাট’-এর লেখক নবারুণ ভট্টাচার্য। অমিত চৌধুরীর সংযোজন: “ভ্রান্ত বাম-রাজনীতি আছে। উপরন্তু সরকারি স্তর থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেউই এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয় না।”
এতগুলি কারণেই হারিয়ে গেল শিকড়ের টান? নতুন গ্লোবালাইজ্ড প্রজন্ম ছুড়ে ফেলে দিল বাংলা বই? উত্তরে বঙ্কিমচন্দ্রের ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের আদর’ প্রবন্ধ থেকে ইংরেজিশিক্ষিত বাঙালি বাবু ও তাঁর ভার্যার সংক্ষিপ্ত কথোপকথন...

ভার্যা: ও কপাল! যে বইখানা অত ঘৃণা করচো... তোমার ইংরেজরাও অত করে না। ইংরেজরা তরজমা করিয়া পড়িতেছে।

ভার্যা: বিষবৃক্ষ।

ভার্যা: আর এক রকমের বিষ, যা তোমার জ্বালায় আমি একদিন খাব।

ভার্যা: গাছের ইংরেজি কী বল দেখি।

বাঙালি সে দিনও বাংলা পড়ত না। আজও পড়ে না। পাঠ-অভ্যাস একই, কিন্তু চরিত্র বদলে গিয়েছে। ‘বঙ্কিমী মজা’ আর নেই। গুরুবাদ আর সাংস্কৃতিক জাত্যভিমানই ভাষাটার অবলম্বন। আত্মঘাতী জাতির এমনটাই হওয়ার কথা ছিল!

ছবি: রণজিৎ নন্দী


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.