নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী জানাইলেন, তিনি জুন মাসে এক দিন ট্যাক্সি ড্রাইভার সাজিয়া ট্যাক্সি চালাইয়াছেন, যাহাতে যাত্রিগণের কথাবার্তা হইতে বুঝা যায়, তাঁহারা দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে কী ভাবিতেছেন। সদৃশ কাহিনি রূপকথায় বহু মিলিবে। হারুন অল রশিদ ছদ্মবেশ ধরিয়া বাজার-হাটে ঘুরিতেন, বিক্রমাদিত্যেরও অনুরূপ অভ্যাস ছিল। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীও এক সময় কাহাকেও না জানাইয়া হাসপাতাল পরিদর্শনে যাইতেন, তাহা ছদ্মবেশ-ধারণ কখনওই নহে, কিন্তু সকলের অজ্ঞাতে একটি বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ নিমিত্ত অকস্মাৎ হাজির হইয়া পড়ার মধ্যে নিজ রাজ্যের প্রকৃত চিত্রটি জানিবার তাড়না রহিয়াছে। প্রাচীন কালে নৃপতিগণ অনায়াসে ভিড়ে মিশিয়া যাইতেন, কারণ তাঁহাদের মুখমণ্ডল গণমাধ্যমে নিত্য আশি বার ঝলকাইত না। ইদানীং উহা অসম্ভব, তবু নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী কিঞ্চিৎ প্রয়াস করিয়াছিলেন। তাঁহার সানগ্লাস ও উর্দি সত্ত্বেও প্রায় সকল যাত্রীই চিনিতে পারিয়াছেন, কেহ বলিয়াছেন, ভালই হইল, তিনি উঁহাকে একটি চিঠি লিখিবার কথা ভাবিতেছিলেন, কেহ তৈল-নীতি লইয়া স্বল্প তর্ক করিয়াছেন, কেহ বলিয়াছেন, ‘আপনি গাড়ি কিন্তু আদৌ ভাল চালাইতেছেন না!’ প্রধানমন্ত্রীর মতানুযায়ী, ট্যাক্সিতে উঠিয়া লোকে খোলামেলা আলোচনা করে। কিন্তু পরিচয় গোপন রাখিবার অক্ষমতা তাঁহাকে সেই রাখঢাকবিহীন কথাবার্তা শুনিতে সাহায্য করিল বলিয়া মনে হয় না। তবে, গাড়ির অভ্যন্তরে পুরা সময়টিই ক্যামেরা চালু ছিল, ফুটেজ হইতে নির্বাচিত অংশ লইয়া একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি প্রস্তুত হইবে, যাহা সেপ্টেম্বরের নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীর প্রচার-অস্ত্র হিসাবে কাজে লাগিবে।
আপাত ভাবে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সাধারণ মানুষের মত জানিবার অসংখ্য সহজ উপায় রহিয়াছে। স্বৈরতন্ত্রে প্রজাগণ তাহাদের ক্ষোভ বা তৃপ্তি সরাসরি জানাইতে পারিত না, রাজার সংবাদ-সংগ্রাহকগণ যাহা বলিত, তাহাই বিশ্বাস করিয়া সম্রাটকে চলিতে হইত। কিন্তু গণতন্ত্রে গণ-ই চালিকা-শক্তি। তাহার কথায় কথায় গর্দান যাইবার ভয় নাই। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি আসিয়া মতামতের বন্যা ডাকিয়াছে। ফলে বহু উপায়ে মানুষ তাহার দাবি বা নালিশ জানাইতে পারে। কিন্তু সংজ্ঞা মানিয়া বাস্তব প্রবাহিত হয় না। নিঃসন্দেহে আজ বহু প্রতিবাদ ও বিরোধিতা প্রকাশ্য সভায় করা যায়, গণমাধ্যমে ভিন্নমত-উদ্যাপন নিয়মিত উৎসব। কিন্তু মানুষ নিজ বৈঠকখানায় যে সত্য উচ্চারণ করে, তাহা বহু গুণ শুদ্ধ। যেখানে কর্তৃপক্ষের নজরদারির বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা নাই, সেখানে তাহার নখ-দন্ত-পিত্ত এবং অসহায় দলিত চিত্ত, সকলই প্রকৃত উন্মুক্ত। বাস যখন নারকীয় জ্যামে ফাঁসিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, চায়ের দোকানে যখন তিক্ত উদ্গার জমিয়া উঠে, প্রশাসন ও রাজনীতিক সম্পর্কে মানুষ তখন যে ভাষায় হতাশা ব্যক্ত করেন, তাহার অগ্নি-আভাস কোনও মুদ্রিত অক্ষরে পাওয়া যাইবে না। যদি সংবাদপত্রের নিবন্ধ বা টেলিভিশন-ভাষণ হইতে সত্যই এই নগ্ন মতামত উপলব্ধি সম্ভব হইত, যুগে যুগে শাসক দল গো-হারা হারিয়া ফ্যালফ্যাল তাকাইত না। আসলে, তন্ত্র বদলাইয়াছে, মানুষ কিন্তু ক্ষমতাকে এখনও পূর্বের ন্যায়ই ভয় পায় ও ঘৃণা করে। কারণ সে জানে, কর্তৃপক্ষ তাহাকে স্বৈরাচারীর ন্যায়ই, কীটাণুকীট মনে করে। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের অংশী হইয়া, কোনও সাধারণ ভারতীয় কি সত্যই ভাবিতে পারে, সে এই সরকার চালাইতেছে ও নীতি নির্ধারণ করিতেছে? সে বরং ‘রাষ্ট্র ছুঁইলে অষ্টাশি ঘা’ নীতি মানিয়া কালাতিপাত করে। অতএব নেতা-নেত্রী জনতার অন্তরের কথাটি জানিতে চাহিলে, ট্যাক্সি-চালনা ভিন্ন উপায় নাই! |