রসনার আবেগে হার মানছে আইন, চোরা পথে বাংলা-ইলিশ
রাত দু’টো। নো-ম্যানস ল্যান্ডে এসে থামল ‘বিমান’। একে একে নামল চারটি পেটি। এক ‘পিস’ তুলে গন্ধ নিয়েই বোঝা গেল, সরেস জিনিস! ‘সব ঠিক আছে’ বলতেই লাইন-ম্যানেরা উঠে পড়ল নৌকোয়। সীমান্তরক্ষীরা হিসেব বুঝে নিলেন।
বাংলাদেশের পুটখালি সীমান্ত থেকে ইছামতী নদী পেরিয়ে পেটি নামল এ দেশের মাটিতে। থার্মোকলের পেটিতে বরফ-চাপা আঁশে ঝকঝকে হীরের দ্যুতি!
ভারত থেকে চোরাপথে বাংলাদেশে গরু যাচ্ছিল, যায়ও। অনেক দিন পর ফের বাংলাদেশ থেকেও ভারতে নতুন করে পাচার শুরু হয়েছে। হেরোইন বা সোনা নয়, বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাচার হচ্ছে ঝকঝকে রুপোলি ইলিশ। বাংলা-ইলিশ। উত্তর ২৪ পরগনার পেট্রাপোল সীমান্ত লাগোয়া জয়ন্তীপুরের যে সব চোরাপথ অব্যবহারে আগাছায় ভরে গিয়েছিল, এখন আবার পরিষ্কার করা হয়েছে সেগুলি।
ইলিশ-বিলাস: মানিকতলা বাজারে ইলিশের পসরা। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক
ইদানীং ফের পদ্মা-মেঘনায় প্রমাণ সাইজের ইলিশ উঠছে। কেজিখানেক ওজনের সেই মাছ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে যন্ত্রচালিত ভ্যান-রিকশায় (বাংলাদেশে যার নাম ‘বিমান’) চড়ে এ পারে ঢুকছে। কখনও জয়ন্তীপুরের কাঁটাতার পেরিয়ে, কখনও পুটখালির ইছামতী পেরিয়ে। আর এ এমনই এক চোরাপাচার, যা নিয়ে আপত্তি তুলছেন না এ-পারের কেউই!
গত বছর থেকে সরকারি ভাবে ইলিশ রফতানি বন্ধ করেছে বাংলাদেশ সরকার। যদিও নিষেধাজ্ঞা নেই অন্য মাছে। পেট্রাপোল সীমান্তে গিয়ে দেখা গেল, ২০ ট্রাকের মতো ভেটকি-পাঁঙাশ-পার্শে মাছ এসেছে বাংলাদেশ থেকে। এ পার থেকে যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশের রুই, কাতলা। প্রতিদিন প্রায় ১০ ট্রাকের মতো। ভারতীয় শুল্ক দফতরের ডেপুটি কমিশনার শুভেন দাশগুপ্ত বলেন, “পেট্রাপোল দিয়ে অনেক মাছই আমদানি-রফতানি হচ্ছে। শুধু গত বছর থেকে ভারতে ইলিশ রফতানিই বন্ধ করেছে বাংলাদেশ।”
এ নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। এ বারও রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে দৌড়োদৌড়ি করা হয়েছিল। ভারতের অন্যতম ইলিশ আমদানিকারক অতুল দাস জানাচ্ছেন, সুরাহা হয়নি। তাঁর কথায়, “কিছুতেই ইলিশ রফতানি করবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে ঢাকা।” কেন? বাংলাদেশ সরকারের যুক্তি, রফতানির জন্য ব্যাপক হারে খোকা ইলিশও ধরা হচ্ছিল। ফলে মার খাচ্ছিল ইলিশ উৎপাদন। গত কয়েক বছর মায়ানমার থেকে ইলিশ ঢুকছিল বাংলাদেশে। রফতানি বন্ধ করার পরে খোকা ইলিশ ধরাও বন্ধ হয়েছে। পদ্মা-মেঘনায় এখন আবার প্রমাণ সাইজের ইলিশ মিলছে। কিন্তু দেশের লোক আগে খাবে, তার পর তো ভিনদেশিদের পাত! তাই রফতানির প্রশ্ন নেই!
তবে দু’দেশের প্রশাসনেই একাংশের কিন্তু ধারণা, এটা কেবল কথার কথা। আসলে ইলিশ রফতানি বন্ধ হওয়ার পিছনে তিস্তা জলবণ্টন চুক্তি নিয়ে টালবাহানাই দায়ী বলে মনে করছেন বাংলাদেশের ইলিশ রফতানি-কারকেরা। বরিশালের অজিত দাস বললেন, বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে ইলিশ রফতানির ফাইল আটকে রয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর দফতর তা আটকে দিয়েছে। “সমস্ত টালবাহানাটাই হচ্ছে তিস্তা চুক্তির জন্য। ইলিশ তো জলে হয়। জল না দিলে ইলিশ দেব কী করে?”
কিন্তু এ দেশের বাঙালি তা মানবে কেন! আর গত এক মাস ধরে সেই তীব্র ইলিশ-রসনার সুযোগটাই নিয়েছে চোরা-কারবারিরা। খবর পৌঁছেছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে। বেনাপোল শুল্ক দফতরের এক কর্তা জানালেন, “সীমান্ত লাগোয়া যশোহরে ইলিশ বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। যশোহরবাসীর জন্য স্থানীয় বাজারে বিশেষ নজরদারিতে বিক্রি হচ্ছে মাছ।”
কিন্তু তাতেও রোখা যায়নি পাচার। রাতের অন্ধকারে ঢাকা-বরিশাল-খুলনা থেকে লুকিয়ে যশোহর হয়ে সীমান্তে চলে আসছে ইলিশ। সেই চোরা-পথের সুলুক নিতে বনগাঁর আংরাইল সীমান্তে পৌঁছতেই হইচই বাধিয়ে দিলেন পাচারকারীরা! “ইলিশ বাঙালির আবেগ। এটা নিয়েও আপত্তি?” সত্যি বলতে কী, শুল্ক দফতরের কর্তাদের একাংশের মনেও সেই আবেগেরই ঝিলিক। শুল্ক দফতরের ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর যুক্তি, “বাড়ির লোকের আব্দার রেখে এখনও বাংলা-ইলিশ নিয়ে যেতে পারিনি। তার আগেই এ সব লিখে ইলিশ আসা বন্ধ করার মানে হয়?”
আংরাইলে ইছামতীর ও-পারেই যশোহরের পুটখালি। বেশি ইলিশ আসছে এ পথেই। চোরাকারবারিদের কথায়, বরিশাল-ঢাকা-চাঁদপুর-পাবনা-বাঘেরহাট-খুলনা থেকে লুকিয়ে যশোহর ও সাতক্ষীরা সীমান্তে আসছে বাংলা-ইলিশ। যশোহরের সাদিপুর হয়ে এ দেশের জয়ন্তীপুর-গাঁতিপাড়া এবং সাতক্ষীরার ভোমরা-কালীগঞ্জ হয়ে ঘোজাডাঙা সীমান্ত দিয়ে এ পারে ঢুকছে ইলিশ।
এক সময়ে বাংলাদেশ থেকে নৌকোয় ইলিশ তুলে ইছামতীর এ পারে ছুড়ে দেওয়া হত। কাঁটাতারের তলা দিয়ে দু’হাতে ইলিশ আঁকড়ে দৌড়ে এ পারে দিয়ে যেত কিশোর-কিশোরীরা। দু’দেশের মধ্যে ইলিশ রফতানি শুরু হলে সেই ছোটাছুটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই রফতানি থমকে যেতেই আবার ফিরে এসেছে আগের রীতি। পুরনো স্মৃতি বলতে গিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন গোবরডাঙা বিএড কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আশুপ্রসাদ নাথ। তাঁর কথায়, “এক টাকায় দু’কিলো ওজনের দু’টি ইলিশ কিনতাম ঢাকায়। দেশভাগের পরেও কলেজ থেকে ফেরার পথে হাবরা বাজার থেকে ইলিশ কেনা হত। একটা ইলিশ এক বাড়িতে খেয়ে ফুরোবে না। তাই দু’জন শিক্ষক একটা ইলিশ কিনে ভাগাভাগি করে নিতাম।”
সেই রয়্যাল সাইজের ইলিশ অবশ্য এখন নেই। এখন কমবেশি ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মিলছে। ও-পার থেকে এ-পারের বাজারে আসতে দামেরও তফাত পড়ছে বেশ খানিক। বাংলা-ইলিশের ব্যাপারী অজিতবাবু জানালেন, বরিশালে ৭০০ টাকা কেজিতে যে ইলিশ বিক্রি
হচ্ছে, যশোহর সীমান্তে সেই মাছ আনতে হাজার টাকা কেজি পড়ে যাচ্ছে। দু’দেশের সীমান্ত রক্ষী ও লাইনম্যানদের কেজি প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে দিয়ে পড়ছে আরও ২০০ টাকা। এ দেশের চোরাকারবারিরা সেই মাছ কিনছেন বাংলাদেশের মুদ্রায় ১৩০০ টাকা, অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় হাজার টাকায়। বনগাঁ বা বারাসতের বাজারে তার দাম দাঁড়াচ্ছে ১২০০ টাকা। দরাদরি না করলে সেই ইলিশ বের হচ্ছে ঝাঁকার নীচে গুপ্তস্থান থেকে।
বেহালার বাজার থেকে ক’দিন আগে ১৪০০ টাকা কেজি দরে একটি ইলিশ বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামাশ্রী। ইলিশ ভাপা তৈরি করতে গিয়ে মাছ ভেজে ফেলায় রাঁধুনির চাকরিই যেতে বসেছিল! ইলিশ নিয়ে আবেগটা এখানেই।
চোরাই মাল কেনা, ব্যবহার করা অপরাধ। আর, চোরাই ইলিশ খাওয়া?
কুমিল্লায় জন্ম। পড়াশোনা, কর্মজীবনের শুরু ঢাকায়। এখন এ দেশের বাগুইআটির বাসিন্দা ১০১ বছরের ‘যুবক’ মনোহর আইচের কথায়, “মাছের আবার পাসপোর্ট কী? বাংলা-ইলিশ পাইলেই খামু!”

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.