খুনের মামলায় এক দশক হাজিরা দিচ্ছে দলগাঁও
কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে উঠোনে ঝাড়ু দেওয়া। চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে স্বামী ও দুই ছেলের জন্য দুপুরের খাবার তৈরি। রান্না হয়ে গেলে স্নান। তার পরেই তড়িঘড়ি খান দু’য়েক রুটি কোনও মতে মুখে দিয়ে বাস ধরতে ছুটলেন দলগাঁও চা বাগানের শ্রমিক সাবিত্রী বরাইক।
এই ছবি গত সোমবারের। তবে এই ঘটনা ঘটে আসছে গত এক দশক ধরে। ২০০৩-এ ডুয়ার্সের দলগাঁও চা বাগানে ১৯ জনকে খুনের মামলায় অভিযুক্ত হন সাবিত্রী-সহ বাগানের শ্রমিক, বাসিন্দা মিলিয়ে ১১৩ জন। সে সময় রাজ্য তোলপাড় হয়েছিল ওই ঘটনায়। ওই মামলায় হাজিরা দিতে সাবিত্রীর মত সব অভিযুক্তই নিয়মিত আলিপুরদুয়ার আদালতে হাজিরা দিয়ে আসছেন। এই দশ বছরে অবশ্য মারাও গিয়েছেন অভিযুক্তদের সাত জন। সোমবার তাই আলিপুরদুয়ার গেলেন ১০৬ জন।
২০০৩ সালে ডুয়ার্সের ওই বাগানে ছিল সিটু নেতা তারকেশ্বর লোহারের ‘একচ্ছত্র দাপট’। তাঁর বিরুদ্ধে ‘অত্যাচার’ চালানোর অভিযোগ তুলে সরব হয়েছিলেন শ্রমিকেরা। বাগানের শিক্ষিত শ্রমিক ঘরের ছেলে থাকতেও তারকেশ্বরের ‘নির্দেশে’ বাগানের করণিক পদে তিন জনকে নিয়োগ করার অভিযোগ ওঠে। প্রবল ক্ষোভ দেখা দেয় বাগান জুড়ে। তা আঁচ করে হামলার আশঙ্কায় তারকেশ্বরও নিজের বাড়িতে বহিরাগতদের জড়ো করতে থাকেন বলে অভিযোগ।
আলিপুরদুয়ার আদালতের পথে। ছবি: রাজকুমার মোদক।
আশঙ্কা সত্যি হয় ওই বছরের ৬ নভেম্বর। ওই দিন সকালে বাগানের বহু মানুষ তরোয়াল, বল্লম নিয়ে বাগানের চা তৈরির কারখানার পিছন দিকে থাকা তারকেশ্বরের বাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। সে সময় বাড়ি থেকে গুলি এসে বাগানের বাসিন্দা এক স্কুলপড়ুয়ার গায়ে। আগুনে ঘৃতাহুতি হয় ওই ঘটনায়। জনতা ওই বাড়িতে আগুন দেয়। ঘর থেকে কিছু লোক বেরোতে চেষ্টা করলে তাদের কুপিয়ে জ্বলন্ত ঘরের আগুনে ফেলে দেয় উন্মত্ত জনতা। মৃত্যু হয় ১৯ জনের। পরিবার নিয়ে কোনও মতে পালিয়ে বাঁচেন তারকেশ্বর লোহার। পুলিশ পৌঁছে মৃতদেহগুলি সনাক্ত করতে পারেনি। পরে সেই দেহাংশের নমুনা ডিএনএ পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। তারকেশ্বর গ্রেফতার হন ওই দিনই। তিনি ২৮ জন মহিলা-সহ মোট ১১৩ জনের নামে মামলা করেন। ঘটনার দিন পুলিশ ১০৮ জনকে গ্রেফতার করে। পরে পাঁচ জন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন।
সোমবার সকাল আটটায় বাগান লাগোয়া ৩১ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে ক্যান্টিনের পাশে পৌঁছে গিয়েছিল একটি বাস ও একটি ছোট গাড়ি। গাড়ির তেলের খরচ দেন বাগান কর্তৃপক্ষ। বাকি ভাড়া প্রতি মাসের মজুরি থেকে দশ টাকা করে জমিয়ে শোধ করেন অভিযুক্ত শ্রমিকেরাই। দলগাঁ থেকে আলিপুরদুয়ার ৬০ কিলোমিটারের পথ। মাঝের ৭-৮ কিলোমিটার রাস্তা বেশ খারাপ। জায়গা না পেলে দাঁড়িয়ে যেতে ঝাঁকুনিতে কষ্ট হয় বেশ। পঞ্চাশোর্ধ্ব সাবিত্রীদেবী তাই ছুটতে ছুটতে বাসে উঠে নিজের জন্য একটি জায়গা দখল করেন। জায়গা পেয়ে স্বস্তি পান তিনি। হাঁফ ছেড়ে আঁচল দিয়ে মুখটা মুছে বলেন, “দশ-দশটা বছর ধরে আদালতে যাচ্ছি আর আসছি। তিন মাস জেল খেটে জামিনও পেয়েছি। এখনও যেতে হচ্ছে। কবে মামলার নিষ্পত্তি হবে তা ভেবে চিন্তায় থাকতে হয়।” পাশেই বসে ছিলেন আরেক মহিলা শ্রমিক সন্ধ্যা মিনজ। দুপুরে খাবার খরচ বাঁচাতে আঁচলের খুঁটে বেঁধে নিয়েছেন কয়েক মুঠো চিড়ে। তিনি বললেন, “দশ বছর ধরে দু’মাস, আড়াই মাস অন্তর গাড়ি ভাড়া করে আদালতে যেতে হয়। নির্দিষ্ট তারিখে উকিলবাবুকে টাকা মেটাতে হয়। দশ বছরে যে ভাবে খরচ বেড়েছে তাতে আমাদের মত গরিব চা শ্রমিকের পক্ষে খাবারের খরচ মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। যে দিন আদালতে যাই সে দিন বাগান কর্তৃপক্ষ আমাদের বেতন দেন না। মামলা কবে শেষ হবে তাও বুঝতে পারছি না।” আলিপুরদুয়ার পৌঁছনোর আগে দু’ঘণ্টার যাত্রায় এই প্রশ্নটাই ঘুরছিল মুখে মুখে। বাগানের সমস্ত আসামীদের নিয়ে তৈরি জেল কমিটির নেতা বিনোদ লাকড়া সকলকে অভয় দিয়ে বললেন, “মামলা এখন বড় কোর্টে গিয়েছে। তার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।”
এতদিন ওই মামলাটি আলিপুরদুয়ার এসিজেএম আদালতে ছিল। মাঝে মধ্যে তারিখ পড়ত আর হাজিরা দিয়ে অভিযুক্তরা ফিরে আসতেন। সোমবার সেই মামলা অতিরিক্ত দায়রা আদালতে স্থানান্তরিত হয়। ওই দিন বিচারপতি প্রসূনকুমার ভট্টাচার্য অবশ্য অভিযুক্তদের অস্থায়ী জামিন স্থায়ী করেন। এ মাসে একজন অভিযুক্ত মারা যাওয়ার বিষয়টি আদালতে না জানানোয় বিচারক তার ডেথ সার্টিফিকেট ও পুলিশ রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়ে ২৭ সেপ্টেম্বর পরবর্তী হাজিরার দিন ধার্য করেন বলে আইনজীবীরা জানান। সরকারি আইনজীবী জহর মজুমদার বলেন, “সব আসামী সময় মত আদালতে এসে হাজিরা না দেওয়াতে মামলার প্রক্রিয়া শেষ হতে দেরি হচ্ছে। সকলে নিয়মিত এলে খুব শীঘ্রই বিচার প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে আশা করছি।”
অভিযুক্তদের আইনজীবী সমীর সরকার বলেন, “পদ্ধতিগত কারণে এতদিন দেরি হয়েছিল। তবে এতদিন ওই আদালতে হাজিরা বা নানান পদ্ধতি শেষ হয়েছে। এই আদালতে কিছু দিনের মধ্যে মামলার শুনানি শুরু হবে বলে আশা করছি।” অভিযুক্তদের অপর আইনজীবী অশেষ চক্রবর্তীর কথায়, “এই মামলায় আসামীর সংখ্যা অনেক। কখনও কখনও সকলে এক সঙ্গে আসেন না। কেউ মারা গেলে পুলিশ তার রিপোর্ট পাঠাতে দেরি করে। এই সব কারণেই এত দেরি হচ্ছে।”
আগামী হাজিরার দিন জেনে নিয়ে দুপুর আড়াইটেয় ফের বাস চলতে শুরু করে দলগাঁর দিকে। শহর, নদী, ধানখেত পেরিয়ে দলগাঁ পৌঁছনোর আগে রাস্তার দু’ধারে গালিচার মত সবুজ চা বাগান দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে সাবিত্রী, সন্ধ্যা, রতশিলা, গন্ধুরদের। তবে ফের আগামী হাজিরার কথা ভেবে সে হাসি মিলিয়েও যায় নিমেষে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওঁরা বলেন, “কে জানে আর কতদিন এ ভাবে যাতায়াত করতে হবে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.