বনধ, জনতা কার্ফু উপেক্ষা করে একাধিক বার পাহাড়ে গিয়েছেন রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়। সরকারি বাসে চড়ে মন্ত্রীরা পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। চাল-আটা নিয়ে গিয়ে বিলির চেষ্টা হয়েছে। পুলিশ-সিআরপি মোতায়েন করে সরকারি অফিস খুলিয়ে রাখা হয়েছে। এত সবের মধ্যেও কিন্তু দার্জিলিং পাহাড়ের পুলিশ ও প্রশাসনের অধিকাংশ অফিসার-কর্মীদের হাতে জুলাই মাসের মাইনেটুকু পৌঁছতে ব্যর্থ হয়েছে রাজ্য সরকার।
এই ঘটনায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষত, বনধ, জনতা কার্ফু-সহ নানা ব্যাপার সামাল দিতে উদয়াস্ত যাঁদের ঘাম ছুটছে, সেই পুলিশকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ তীব্র। যথা সময়ে মাইনে না-হওয়ায় বাড়ি-ফ্ল্যাট কেনা বাবদ নানা আর্থিক সংস্থায় যে আগাম ‘চেক’ দেওয়া রয়েছে, তা পর্যন্ত ‘বাউন্স’ হয়েছে। নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক পদস্থ অফিসার বলেন, “আমাদের বেশ কয়েক জনের ফ্ল্যাট কেনার মাসিক কিস্তির টাকা অগস্টে বাউন্স করেছে।” অস্থায়ী পুলিশকর্মী, হোমগার্ডদের অনেককে এমনকী ধারদেনা করে সংসার চালাতে হচ্ছে বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে রাজ্যের তরফে পাহাড়কে স্বাভাবিক রাখতে নানা প্রচেষ্টা চললেও সরকারি কর্মীদের মাইনে দেওয়ার কাজটুকু করা গেল না কেন? দার্জিলিং ট্রেজারিতে যদি অফিসার-কর্মীরা গরহাজির থাকেন, তা হলে কেন শিলিগুড়ি ট্রেজারি থেকে সেই কাজটা করানো হল না? |
সরকারি সূত্রের খবর, পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধকালীন তৎপরতা শুরু হয়েছে পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ মহলে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও উদ্বিগ্ন। তাঁর কথায়, “আমি বিশদে খোঁজখবর নিচ্ছি। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা যাতে যথা সময়ে মাইনে পান, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।” পুলিশ-প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, শিলিগুড়ি ট্রেজারি থেকে মাইনে দেওয়ার জন্য মহাকরণে বার্তা পাঠানো হলেও সেখান থেকে ‘নানা আর্থিক বিধি ও বিস্তর ফাইল চালাচালি’র কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে আগামী দিনে একই পরিস্থিতি হলে শিলিগুড়ি ট্রেজারি থেকে মাইনে দেওয়ার কথা ভাবা হবে বলে মহাকরণের আশ্বাস পেয়েছে জেলা পুলিশ-প্রশাসন।
দার্জিলিং জেলা প্রশাসন সূত্রে দাবি, আজ, শনিবারের মধ্যে পুলিশকর্মীরা মাইনে পেয়ে যাবেন। সোমবারের মধ্যে জিটিএ-র সকলে মাইনে পেয়ে যাবেন। কিন্তু তাতে সমস্যা মিটবে না। শনিবার ‘চেক’ পেলে সেই দিনই তা জমা দেওয়া শক্ত। সোমবার থেকে ফের পাহাড়ে ‘জনতা ঘরে বসে থাকো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে মোর্চা। যা চলবে শুক্রবার পর্যন্ত। তখন ব্যাঙ্কে কাজকর্ম না হলে কবে চেক ভাঙাতে যাবে, তা অনিশ্চিত। জেলা পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ কর্তারা বিষয়টি নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তবে পুলিশ সূত্রের দাবি, সকলে যাতে নগদে মাইনে পান, সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা হচ্ছে।
সরকারি সূত্রের খবর, দার্জিলিং পাহাড়ে মোট সরকারি কর্মীর সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। তাঁদের মাইনে বাবদ মাসে প্রায় ৭০ কোটি টাকা রাজ্যকে দিতে হয়। যার মধ্যে জিটিএ-এর ৭ হাজার কর্মীর মাইনে বাবদ খরচ প্রায় ৩৫ কোটি টাকা। বাকি টাকা খরচ হয় পুলিশের অফিসার-কর্মী এবং প্রশাসনের কর্মীদের মাইনে দিতে।
সরকারি সূত্রে খবর, অফিসার-কর্মীদের উপস্থিতির হার জানিয়ে যে বিল পাঠাতে হয় ট্রেজারিতে, জুলাই মাসে তা সময়ের মধ্যে পৌঁছয়নি। এর পরে কেন্দ্র তেলঙ্গানা গঠনের ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতেই ২৯ জুলাই থেকে টানা তিন দিন পাহাড়ে বনধ ডাকে মোর্চা।
বনধ উপেক্ষা করে সরকারি অফিস খোলা থাকলেও সেখানে কার্যত কোনও কাজ হয়নি, মানছেন প্রশাসনের কর্তারা। ১ এবং ২ অগস্ট বনধ না-থাকলেও পুলিশ-প্রশাসন, জিটিএ-এর তরফে বিল ট্রেজারিতে যায়নি। এর পরে শুরু হয় অনির্দিষ্টকালের বনধ এবং সবশেষে জনতা কার্ফু। সরকারি সূত্রের খবর, এর মধ্যে তৎকালীন জেলাশাসক সৌমিত্র মোহন তাঁর দফতরের বিল ট্রেজারিতে জমা দেন। তিন দিনের মাথায় তাঁদের মাইনে হয়। কিন্তু অন্যরা সেই তিমিরে। জেলা পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, প্রায় সকলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যস্ত থাকায় বিল পাঠাতে দেরি হয়। প্রত্যাশিত ভাবেই জিটিএ-র সদস্য তথা মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেন, “আন্দোলন তো শুরু হয়েছে জুলাইয়ের শেষে। তার আগেই তো মাইনের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ার কথা। পাহাড়ের ব্যাপারে রাজ্যের মনোভাব কেমন তা আমাদের বুঝতে বাকি নেই।” |