ধবন-ধাঁচে ধুন্ধুমার ব্যাটিং বর্ষার, বাঁচল আমন চাষ
ব্যাটে বিস্ফোরণ! চতুর্থ ইনিংসে বাংলার বর্ষা যেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় শিখর ধবন!
পর্যাপ্ত বর্ষণের অভাবে চাষিদের একাংশ যখন ঝিমিয়ে পড়ছিলেন, সেই মোক্ষম সময়েই টি-টোয়েন্টির মেজাজে ব্যাট করে ঘাটতি প্রায় মিটিয়ে দিল বর্ষা। তার ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন চাষিরাও। এক সময় মনে হয়েছিল, এ বার আমন ধানের চাষে রাজ্য বোধ হয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু ১৫ অগস্টের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, বৃষ্টি-ঘাটতি মেটার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আমন চাষের লক্ষ্য পূরণ করতেও অসুবিধা হবে না।
ঠিক সময়ে হাজির হয়ে এ বার অনেকটা এক দিনের ক্রিকেটের মেজাজে ইনিংস শুরু করেছিল বর্ষা। কিন্তু দ্বিতীয় ইনিংসে তার রানরেট ঝপ করে পড়ে যাওয়ায় বীজতলা তৈরি করে বসে থাকা চাষিরা চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয় ইনিংসে কিছুটা মেরে খেলার চেষ্টা করলেও রানরেট এমন একটা খাদে পড়ে গিয়েছিল যে, মনে হচ্ছিল, এ বার বুঝি ৫০% জমিতেই আমন ধান রোয়া যাবে না! কিন্তু চতুর্থ ইনিংসে চার-চারটি নিম্নচাপের টিপস নিয়ে ফের টি-টোয়েন্টির ব্যাটিং করে দেখাল বর্ষা। প্রিটোরিয়ায় ধবনের ১৫০ বলে ২৪৮ রানের মারকাটারি ইনিংসের মতোই!
১৫ অগস্ট বৃষ্টি এবং ধান রোয়ার যে-লক্ষ্যমাত্রা তৈরি করা হয়েছে, বর্ষার এই ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে ভর করে তা ছুঁয়ে ফেলা গেল সহজেই। হেরে যাওয়া ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত জিতিয়েই দিল বর্ষা। ২৬ জুলাই রাজ্যের মাত্র ৪২% জমিতে ধান রোয়া হয়েছিল। স্বাধীনতা দিবসে তা পৌঁছে গিয়েছে ৮২ শতাংশে। অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেও এমনটা আশা করতে পারেননি রাজ্যের কৃষি বিভাগের আধিকারিকেরা। সাধারণ নিয়মে ১৫ অগস্টের মধ্যে আমন ধান রোয়ার কাজ শেষ করতে হয়। কৃষি দফতরের এক আধিকারিকের মন্তব্য, গত ৮-১০ বছর ধরে বর্ষা অনিয়মিত হয়ে পড়ায় এখন ধান রোয়ার কাজ চলে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তবে চলতি মরসুমে এ দিন পর্যন্ত ধান রোয়ার যে-হিসেব মহাকরণে পৌঁছেছে, সেটা অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। কৃষি দফতরের আশা, ৩১ অগস্টের মধ্যে ধান রোয়া শেষ হবে ৯৫ শতাংশেরও বেশি জমিতে।
বর্ষার শুরুর পরে এ বার বর্ষণে টান পড়েছিল। দিল্লির মৌসম ভবন সূত্রের খবর, জুলাইয়ের মাঝামাঝি গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের বেশির ভাগ জেলায় যথেষ্ট পরিমাণে বৃষ্টি মেলেনি। সেই সময় গোটা দক্ষিণবঙ্গে বর্ষার ঘাটতি ৩০% ছাড়িয়ে গিয়েছিল। খরার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে। তবে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে টানা ১০ দিনের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে তৈরি হওয়া চার-চারটি নিম্নচাপ বর্ষার ছবি পুরোপুরি বদলে দেয়। আবহবিদেরা বলছেন, যে-সব জেলাকে নিয়ে চিন্তা ছিল, সেই বর্ধমান, হুগলি, নদিয়ায় বৃষ্টির ঘাটতি অনেকটাই কমে গিয়েছে। উত্তরবঙ্গে মালদহ জেলা ছাড়া অন্য কোথাও বৃষ্টি-ঘাটতি ছিল না গোড়া থেকেই।
দক্ষিণবঙ্গে ঘাটতি এখন কতটা?
আলিপুর আবহাওয়া দফতর জানাচ্ছে, ১ জুন থেকে ১৪ অগস্ট পর্যন্ত হিসেবে গোটা রাজ্যে গড়ে ১১% বৃষ্টি-ঘাটতি রয়েছে। দক্ষিণবঙ্গে ঘাটতি ১৪%, উত্তরবঙ্গে ১০%। এক আবহবিদের কথায়, “২০% ঘাটতি বা ২০% অতিরিক্ত বৃষ্টিকে স্বাভাবিক হিসেবেই ধরা হয়।” হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, একমাত্র মুর্শিদাবাদ ছাড়া দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই বৃষ্টির পরিমাণ মোটামুটি স্বাভাবিক।
একই কথা বলছেন কৃষি দফতরের কর্তারাও। তাঁদের বক্তব্য, জুলাইয়ের শেষ লগ্নের বৃষ্টির দাপটেই ধান রোয়ার কাজ অনেকটা এগিয়েছে। গত বছর এই সময়ে ৮০% জমিতে ধানচারা লাগানোর কাজ শেষ হলেও ৯০ শতাংশে পৌঁছতে সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ হয়ে গিয়েছিল। কৃষিকর্তারা বলছেন, গত বছর জুনে রাজ্যে বৃষ্টির ঘাটতি অনেক বেশি ছিল এবং জুলাইয়ে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হলেও অগস্টে ফের বিশাল ঘাটতি দেখা দেয়। তার জেরেই সে-বছর ধান রোয়ার কাজ সময়মতো করা যায়নি।
চলতি বছরে রাজ্যের ১৮টি জেলার মধ্যে পাঁচটিতে তুলনামূলক ভাবে কম জমিতে ধান রোয়া হয়েছে। বীরভূমে মাত্র ৫৭% জমিতে ধান রোয়া শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি দফতর। দার্জিলিং জেলার শুধু শিলিগুড়ি মহকুমাতেই ধান চাষ হয়। সেখানে ৭৩% জমিতে ধানচারা রোয়ার কাজ শেষ হয়েছে। কৃষিকর্তারা বলছেন, “দার্জিলিঙের মাত্র একটি মহকুমা ধান চাষের যোগ্য হওয়ায় ওই হিসেবকে আমরা অন্যান্য জেলার পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করি না।”
কিছু ক্ষেত্রে যে কম জমিতে ধান রোয়া হয়েছে, কৃষিকর্তারা তার জন্য বৃষ্টি-ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে সেচের সমস্যাকেও দায়ী করছেন। তাঁরা বলছেন, বীরভূমের থেকে এ বার মুর্শিদাবাদে বৃষ্টি-ঘাটতি বেশি। কিন্তু বীরভূমে সেচের তেমন সুবিধা না-থাকায় মুর্শিদাবাদের চেয়ে সেখানে কম জমিতে ধান রোয়া গিয়েছে। বীরভূমে মাত্র ৫৭% জমিতে ধান রোয়া হয়েছে। অথচ ৭১% জমিতে ধান চাষ হয়েছে মুর্শিদাবাদে।
বীরভূমে সেচে সমস্যা কেন?
কৃষি দফতরের এক কর্তা জানান, কংসাবতী জলাধার থেকে জল ছাড়া হলেও তার পরিমাণ এত কম যে, বীরভূমে সেচের তেমন সুবিধে হয়নি। তা ছাড়া বর্ধমান, মুর্শিদাবাদের মতো জেলায় প্রথম দিকে কম বৃষ্টি হলেও পরে প্রচুর বর্ষণের ফলে শেষ পর্যন্ত ঘাটতি দাঁড়িয়েছে কম। তাতে ধান রুইতে সুবিধে হয়েছে। কিন্তু বীরভূমে বর্ষার কৃপণতা চলছে একটানা।
উত্তরবঙ্গে মালদহের চেয়ে কোচবিহারে বৃষ্টি-ঘাটতি বেশি। কিন্তু ধান রোয়ার হিসেবে মালদহকে (৬৮%) অনেক পিছনে ফেলে দিয়েছে কোচবিহার (৯৭%)।
অঙ্কের হিসেবে ছড়িয়েছিটিয়ে সামান্য ঘাটতি থেকে গেলেও মোটের উপরে এ বার আমন ধানের ফলন নিয়ে কৃষি দফতর আশাবাদী। কৃষিসচিব সুব্রত বিশ্বাসের গলায় সেই আশারই প্রতিধ্বনি। তিনি এ দিন বলেন, “নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে প্রথম দিকে ধানচারা রোয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি ছিল। নদিয়া ও মুর্শিদাবাদ পরে সামলে নিয়েছে। বীরভূমে এখনও কিছুটা সমস্যা রয়েছে। খালে সেচের জল নিয়ে গিয়ে সেখানেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এ বার যথেষ্টই ভাল।”
ঘাটতিকে ছক্কা
এলাকা বৃষ্টিপাত*
বৃষ্টিপাত*
গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ -৩১ -১৪
কলকাতা -২০ +১৫
পশ্চিম মেদিনীপুর -৬৬ -১১
নদিয়া -৭৫ -২৪
মুর্শিদাবাদ -৭৪ -৪৪
উত্তরবঙ্গ -১০ -১০
মালদহ -৫৫ -১৯
* স্বাভাবিকের থেকে কম (-), বেশি (+), শতাংশের হিসেব
ধান রোপণ
২৬ জুলাই পর্যন্ত ১৪ অগস্ট পর্যন্ত
৪০% জমিতে ৮২% জমিতে

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.