নাটক সমালোচনা...
অনবদ্য টিমওয়ার্ক
‘একজন মাত্র কাঁড়া কুস্মির গাড়িখানি টেনে নিয়ে চলে। আর কেউ তার সঙ্গে যায় না। পিছনের সংসার এখন খোলের মধ্যে গুটিয়ে পড়তে ব্যস্ত।’
উপন্যাসে পিছনের সেই সংসার যখন আরও বড় অর্থে মঞ্চের সামনে, তখন নাট্যকার কী করবেন? জটিল এই প্রশ্নটার মুখে দাঁড়িয়ে নান্দীকারের ‘নাচনি’র নাট্যরূপকার ও নির্দেশক পার্থপ্রতিম দেব যা করেছেন তা একই সঙ্গে সহজ এবং কঠিন। তিনি কেবল করুণাটাকে বদলে দিয়েছেন বিদ্রোহে।
সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের ‘রসিক’ উপন্যাসের শেষের দিকে ছিল, ‘শুধু বিজুলিবালা কাঁড়াগাড়ির পিছু ছাড়ে না। ...পাণ্ডবকুমার কি যেন বলতে চায়। ভীম মাহাতো তাকে বাধা দিয়ে বলে, বাধা দিস্ না। উয়াকে যাত্যে দে। লিজের চইখে দেখে আসুক লাচনীর শ্যাঁষ গতিটি...’
উপন্যাসে চরম করুণার এই শেষ গতিটি নান্দীকার-এর নাটকের মঞ্চে হয়ে উঠেছে প্রবল বিদ্রোহের। পুরুলিয়ার মানভূম অঞ্চলের এই শিল্পী-সম্প্রদায়ের প্রথা অনুসারে নাচনি মারা গেলে তাঁর সৎকার হয় না। পায়ে দড়ি বেঁধে মাটিতে ঘষটাতে ঘষটাতে টেনে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়, শিয়াল-শকুনের ছিঁড়ে খাওয়ার জন্য। কারণ, নাচনি অচ্ছুৎ। সে কারও বউ নয়, মা নয়, মেয়েও নয়। তার শরীর পোড়ালে পাপ ঢুকবে বাতাসে, কবর দিলে পাপ মিশবে মাটিতে, জলে ভাসালে জল হবে বিষ! এই শেষ গতিটি পাল্টে দিয়েছে ‘নাচনি’ নাটকের বিজুলিবালা (সোহিনী সেনগুপ্ত)। বড়, মেজ, ছোট সব রসিককে অবাক করে দিয়ে কুস্মির পা থেকে দড়িটা খুলে নেয় সে, চাবুকের মতো আছড়াতে থাকে মঞ্চে। তার পরে একাই সেই ‘বিষ’-দেহ টেনে নিয়ে চলে।
না, মূল উপন্যাসের কতটা আছে আর কতটা নেই সে বিচার করার ইচ্ছে আমার নেই। তাতে নাটকের প্রতি অবিচারই করা হয়। কিন্তু এই বদলটাতেই মঞ্চে আর এক মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি সৃষ্টি সম্ভব করে তুলতে পেরেছেন এ নাটকের নাট্যকার, সঙ্গীতপরিচালক ও নির্দেশক পার্থপ্রতিম। পারাটা বড় সহজ ছিল না। দু’অঙ্কের এই নাটকে দু’জন নাচনি আর তিন জন রসিককে ঘিরে কয়েকশো বছরের এক নৃত্য-আঙ্গিকের খোলসে এক অচ্ছুৎ শিল্পীজীবনের বেদনাকে প্রকাশ করা রসিকজনের কাছে সত্যিই সহজ নয়।
সে কাজটাই সহজ করে তুলতে পেরেছে টিম নান্দীকার, সহজ হতে পেরেছে বলেই। আলো থেকে মঞ্চ, মেক-আপ থেকে অভিনয় সেই সহজ হওয়ার সাধনাটাই ছিল এ নাটকের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। পরিশীলিত শহুরে যে অস্তিত্ব করুণা করতে শেখায় নাচনিদের, সভাসমিতিতে নাচনিদের উন্নতি করিতে হইবেক জাতীয় বক্তৃতা আওড়াতে শেখায়, প্রতি মুহূর্তে সেই অস্তিত্বটাকে নাট্যশালার দরজার বাইরে বসিয়ে রাখতে পারলেই সেই চ্যালেঞ্জটায় জেতা যায়। সেই লড়াইটা নাটকে আর এক ভাবে আসে, বিজুলিকে বাঁচাতে যাওয়ার দৃশ্যের অসাধারণ রণ-পা নৃত্যে।
এক শুরুর দিকের স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত (কুস্মিবালা) ছাড়া এ নাটকের বাকি অভিনেতারা চ্যালেঞ্জটা জিতেছেন। একেবারে গোড়ার দিকে স্বাতীলেখার অভিনয়ে নাগরিক পরিশীলনের খোলস কুস্মির দমবন্ধ করে দিচ্ছিল। কিছু পর থেকেই অবশ্য সে বেরিয়ে এসেছে পুরুলিয়ার মাটির কন্যার মতো। বিজুলির ভূমিকায় সোহিনী সারল্য আর প্রতিস্পর্ধা, লাবণ্য আর রুক্ষতায় বুনে বুনে তুলেছেন তাঁর চরিত্রটিকে। ভীম মাহাতোর সরলরৈখিক চরিত্রটিতে সুমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় মনে রাখার মতো। পাণ্ডবকুমারের ভূমিকায় দেবশঙ্কর ছিন্নবাধা পলাতক বালকটির মতো দাপিয়ে বেড়িয়েছেন মঞ্চ। কিন্তু কোথাও কোথাও পাণ্ডব পরাজিত হয়েছে দেবশঙ্করের কাছে। যৎসামান্য কয়েক মুহূর্তে অভিনয়ের মুদ্রায় যেন ‘নিঃসঙ্গ সম্রাট’ নাটকের শিশিরকুমার চরিত্রের ছোঁয়া। দেবশঙ্কর এত ভিন্নধর্মী চরিত্রে এখন পাশাপাশি অভিনয় করে চলেছেন তাতে এ হয়তো কিছুটা স্বাভাবিকও। তবু, পরবর্তী অভিনয়ে দেবশঙ্কর আরও বেশি করে চরিত্রে ঢুকতে পারবেন, আশা করা যায়।
চূড়ান্ত উচ্ছ্বাসময় যে জীবনটি এ নাটকের মঞ্চে সৃজন করে চলে কুস্মি-বিজুলি-পাণ্ডবকুমার-ভীম মাহাতোর চরিত্র আর গান তারই এক বিপ্রতীপে, যেন কিছুটা রাশ টেনে ধরার মতোই মঞ্চে আসেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মেজরসিক ধ্রুবকুমার। আর এ নাটকে একমাত্র এই একটি চরিত্রেই মানসিক জটিলতার সব থেকে বেশি দাবি। বড়রসিক ভীম কিংবা ছোটরসিক পাণ্ডবকুমারের মন একমুখী। একজন শান্ত দিঘিটি হলে আর এক জন তিরতিরে নদী। কিন্তু ধ্রুবকুমারের মন অরণ্যের চোরাপথের মতো। মাঝ-জীবনে এসে পৌঁছনো এক মানুষ সে। রসিক হিসেবে খুব সফল নয়, প্রেমিক হিসেবেও বোধহয় নয়। শরীরে তার খিদে, শিল্পেও। কুস্মির পরম সমর্পণ পেয়েছে সে কিন্তু তরুণী বিজুলির বিদ্যুৎ পায়নি। ‘নিজের রক্তজাত পুত্র’ পাণ্ডবকুমার তার অধিকারী। এবং আসরে সেই রক্তজাত পুত্রেরই কদর বেশি, বায়নাও তাকে চেয়েই হয়। নাটকের সবচেয়ে দ্বন্দ্বময় এই চরিত্রটিতে রুদ্রপ্রসাদের অভিনয় মনে রাখার মতো। মাঝরাতে বিজুলির ঘরে ঢোকার কারণ হিসেবে কুস্মিকে বিড়ি ধরানোর আগুন খুঁজতে যাওয়ার কথা যখন বলেন তিনি, কিংবা কুসমির দেহ নিয়ে চলে যাওয়ার পরে তার ঘরটিতে হাতড়ে বেড়ান তখন আরও এক বার বোঝা যায়, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে।
তবু, শেষ অবধি এক অনবদ্য টিমওয়র্ক জেগে থাকে এই নাটকে। জয় সেনের আলোয় দেবব্রত মাইতির মঞ্চে সেই টিমওয়র্কটাই নতুন এক শিল্প-অভিজ্ঞতা হয়ে ওঠে। বছরকুড়ি আগে লেখা উপন্যাসে আসরের আলো থেকে চরাচরে, অন্ধকারে, নদীস্রোতে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল কুস্মি আর বিজুলিবালা নাচনির দুই পুরুষ। আর এই নাটকে উত্তরপুরুষ বিজুলি ‘লাচনি আইন’ ভেঙে ফেলে কুস্মির দেহ নিজে বয়ে নিয়ে যায় একটু শান্তির সৎকারের আশায়।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.