ন্যাড়ামাথার বাঁদিকে দগদগ করছে ক্ষতটা। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে সেই ক্ষতের উপর আলতো হাত বুলিয়ে স্বগতোক্তির মতো বিড়বিড় করছিলেন বছর পনেরোর কিশোরী “উচ্চমাধ্যমিকটা আমাকে পাশ করতেই হবে। তার পর নার্সের চাকরি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।”
আত্মনির্ভর হওয়ার এই ইচ্ছার জন্যই তাকে তার বাবা ‘শাস্তি’ দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। পড়াশোনা বন্ধ করিয়ে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছিলেন মেয়ের। কিন্তু মেয়ে বেঁকে বসেছিল। প্রতিবাদ করেছিল। বাবাকে জানিয়েছিল, সে পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়। সেই ‘অপরাধে’ কাঠ কাটার কুড়ুল দিয়ে মেয়ে দীপিকা-র মাথায় কোপ বসিয়ে দিয়েছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার সন্দেশখালির হাটগাছি গ্রামের দিবাকর আদক। একসপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে শেষপর্যন্ত বেঁচেছে দীপিকা ওরফে তুলি। ভর্তি রয়েছে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফিমেল হেড ইনজুরি বিভাগের ৪২ নম্বর শয্যায়। টেলিফোনে দিবাকরবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শুধু বলেছেন, “আমি যা করেছি ঠিক করেছি।” তার পর আর কথা বলতে চাননি।
দীপিকার মামা তরুণ ঘোরুই প্রথমে সন্দেশখালি চাইল্ডলাইন-এ ফোন করে ঘটনার কথা জানান। তারা খবর দেয় কলকাতা চাইল্ডলাইনকে, সেখান থেকে কলকাতা শিশুকল্যাণ সমিতি (চাইল্ড ওয়েলফেয়ার বোর্ড)কে। তারা সন্দেশখালি থানায় একটি চিঠি লিখে বিষয়টি জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলে। থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সঞ্জীব সেনাপতি বলেন, “এলাকায় গিয়ে জানা গিয়েছে, দিবাকরবাবু মানসিক ভাবে অসুস্থ। ওর পরিবারের লোক জানিয়েছেন, দীপিকা সুস্থ হয়ে ফিরে এলে তাঁরা লিখিত অভিযোগ করবেন। অভিযোগ পেলে আমরা দিবাকরবাবুকে গ্রেফতার করব।” |
এত বড় ধাক্কাও কিন্তু হাটগাছি শ্রী রামকৃষ্ণ বিদ্যাপীঠের দশম শ্রেণীর ছাত্রীকে ভয় পাওয়াতে পারেনি। তার সিদ্ধান্ত এতটুকু টাল খায়নি। এক হাতে মা অনিতা আদকের হাতটা ধরে শুয়ে-শুয়েই দীপিকা বলেছে, “ক্লাস এইট থেকেই বাবা আমাকে বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমি আরও পড়তে চাই। চাকরি করতে চাই। আমার মা আমাকে পড়ানোর জন্য অনেক কষ্ট করছে। আমি মা-কে ভাল রাখতে চাই।” প্রসঙ্গত, বিয়ে করতে না-চাওয়ায় উত্তর ৩৪ পরগনার লড়াকু কিশোরী রৌশেনারাকে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তার বাবা-মা। দীর্ঘ কয়েক মাস এসএসকেএমে-র বার্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থেকে সদ্য বাড়ি গিয়েছে সে। আর নীলরতনের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, চার-পাঁচ দিন পরে বাড়ি যেতে পারবে সন্দেশখালির দীপিকা।
মাটি কাটার কাজ করতেন দীপিকার বাবা দিবাকর। কিন্তু গত দেড়-দু’বছর কাজে যাচ্ছিলেন না। সংসার চালাতে মাস তিনেক আগে মুম্বইয়ে মাছের কারখানায় কাজ নিয়েছিলেন স্ত্রী অনিতা। বড় ছেলে রাজেশ বসিরহাটে কলেজে পড়েন। বাড়িতে থাকত মূলত বাবা আর মেয়ে দীপিকা। অনিতা বলেন, “আমার স্বামী মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চান। কিন্তু মেয়ে পড়তে চায়। আমিও তা-ই চাই। এর জন্য আমার স্বামী আমাদের দু’জনকেই মাঝেমধ্যেই মারধর করতেন।”
হাসপাতালে শুয়েই দীপিকা জানায়, রোজ সকালে উঠে সে ভাত রান্না করে পড়তে বসে। সাড়ে ন’টা নাগাদ স্কুলে যায়। বিকেলে বাড়ি ফিরে টিউশন নিতে যায়। তার পর সন্ধ্যাবেলা রান্না করতে হয়। তাঁর কথায়, “বাবা সবসময় বলত, ‘মেয়েমানুষের আবার অত পড়াশোনা কীসের?’, বলত, ‘গরিবের ঘরে মেয়েদের বিয়েটাই দরকার।’ সাত-আট বার জোর করে আমাকে পাত্রপক্ষকে দেখিয়েছে। স্কুলে যেতে বারণ করত। টিউশন যেতে দিত না। বলত, তাতে রান্নায় দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু আমার স্কুল ভাললাগে। ভৌতবিজ্ঞান, অঙ্ক আর প্রকৃতিবিজ্ঞান প্রিয় বিষয়। আমি নার্স হতে চাই।”
গত রবিবার, ৪ অগস্ট সকালে টিউশন ছিল দীপিকার। তার কথায়, “দাদা-র সঙ্গে বেরোনোর কথা ছিল। কিন্তু বাবা যেতে দিচ্ছিল না। রান্না করতে বলছিল। আমি যাব বলাতে বাবা রাগে চিৎকার করতে থাকে। তারপর ঘর থেকে বেরোতেই কাঠ কাটার কুড়ুল নিয়ে আমার মাথায় কোপ দেয়। অজ্ঞান হয়ে যাই।” অনিতাদেবী জানিয়েছেন, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে আপাতত তিনি মেয়েকে বাপের বাড়ি আতাপুরে রাখবেন। শিশুকল্যাণ সমিতি-র তরফে অবশ্য বলা হয়েছে, থাকার অসুবিধা হলে দীপিকাকে কোনও সরকারি শেল্টার হোমে রেখে পড়াশোনা চালানোর ব্যবস্থা করা হবে।
দীপিকার স্কুলের প্রধানশিক্ষক আশাদুর রহমান জানান, তাঁদের স্কুলে ছেলের সঙ্গে মেয়ের সংখ্যাই বেশি এবং মেয়েরা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে যথেষ্ট ভাল ফল করে। তা-ও মাধ্যমিকের আগেই কিছু মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, “আমরা মাঝেমাঝেই গার্জিয়ানস মিটিংয়ে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে অভাভাবকদের সচেতন করার চেষ্টা করি। কিন্তু দীপিকার ঘটনার পর মনে হচ্ছে সচেতনতায় এখনও ফাঁক থেকে গিয়েছে।”
|