হাঁড়ির খবর
জাপানে যা পান
দ্মার ইলিশ এখন ডুমুরের ফুল ঠিকই! প্রশান্ত মহাসাগরের ইল কিন্তু কলকাতার পাতে আকছার শোভা পাচ্ছে। অনেকটা বাণমাছের আদলের সর্পাকৃতি ইল অবশ্য পাতে আসছে ছোট-ছোট টুকরোয়। পার্ক হোটেলের জেন রেস্তোরাঁর নৈশভোজে এগজিকিউটিভ শেফ শরদ দিওয়ান অভয় দিলেন, ‘চেখে দ্যাখেন কেমন স্মোক্ড ফ্লেভার’!
ইলিশের গন্ধবিহীন স্মোক্ড কিংবা সর্ষে-ইলিশ নিয়েই যখন সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে, তখন এই ইলের বিকল্প সত্যিই মন্দ কী! শুধু ইল-ই নয়। জেনের মাছের তালিকায় ভিনদেশি মহার্ঘ স্যামন-টুনার সঙ্গে থাকছে কানাডার স্ক্যালপ্স। বরফগলা জলে হাত ডুবিয়ে স্ক্যালপ্স ধরতে হয়। স্বাদে তার সঙ্গে পাঙ্গা নিতে গলদা-বাগদাও মুশকিলে পড়বে। ফ্রেশ স্যামন আসে নরওয়ে থেকে। যেমন দামি, তেমন নাজুক। কলকাতায় ল্যান্ড করার পরে স্যামনের শেল্ফ-লাইফ মেরে-কেটে চার দিন। এ ছাড়া, খাস জাপান থেকে আগত ইল, টুনার সঙ্গে ম্যাকারেল, সফ্ট ক্র্যাব, ফ্যাটি টুনা, আর্কশেল তো আছেই।
বাংলাদেশে এত মাছের ছড়াছড়ি থাকতে এই বিদেশ-প্রীতি নিছকই লোক-দেখানো নয়। জাপানি শৈলীর মশলার কলুষমুক্ত নির্মল মৎস্যখণ্ড দেশি মাছে কদাচ মুখে তোলা যাবে না। সুশি বা সাশিমি রাঁধতে হলে একমাত্র বরফগলা জলের মাছই ত্রাহি মধুসূদন। নরওয়ের স্যামনে যা সম্ভব, কস্মিনকালেও ভারত মহাসাগরের স্যামনের তা কম্মো নয়। মাছপ্রেমীদের মতিগতি বড্ড বিচিত্র। কেউ ইলিশের মতো মাছই বড্ড ‘স্ট্রং ফ্লেভার’ বলে ধারে-কাছে ঘেষবেন না। কেউ শুঁটকির কষাটে ঘ্রাণটুকুতে বুঁদ হয়ে এক থালা ভাত মেরে দেবেন। তেমনই কারও প্রখরতম বিশ্বাস, সদ্য জল থেকে উঠে-আসা তাজাতম মাছ আঁচে ছোঁয়ানোর মতো না-পাক কাম আর হয় না! জাপানি বরফগলা জলের মাছ সত্যিই তার নিজের স্বাদেই সম্পূর্ণ। সুশিতে মাছের সঙ্গী জাপানি স্টিকি রাইস, সি-উইড বা সবুজ রিবনের মতো নোরিশিট। সাশিমি মানে শুধুই কাঁচা মাছটুকু। জাপানি সংস্কৃতির প্রতীক নোনতা কিকোমান সস আর সর্ষের থেকে হাজারগুণ প্রখর শ্যামলাবরণ ওয়াসাবি-বাটায় মাখিয়ে সুশি-সাশিমি চপস্টিকে পাকড়ে বা স্বহস্তে টপাটপ মুখে পুরুন। মেছো সোয়াদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওয়াসাবির তেজ মাঝেমধ্যে ব্রহ্মতালুতে হাল্কা চাঁটি মেরে আদর করে যায়। মধুর আত্মপীড়ন। এই স্বাদ ও নিরাভরণ মাছের টানে আজকাল গোটা দুনিয়াই হেদিয়ে মরছে। জাপান ছাড়িয়ে ইউরোপ-আমেরিকাও সুশির জন্য পাগল। একটু চিজ-টিজ মেশানো ফিউশন সুশির নামেও আমেরিকা। যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া মাকি কিংবা নিউ ইয়র্ক, ফিলাডেলফিয়া, বস্টন রোল।
কয়েকটি কুলীন রেস্তোরাঁর কল্যাণে ভারতও খুব পিছিয়ে নেই।
মাছ, সি-উইড, জাপানি স্টিকি রাইস, নানা কিসিমের মাশরুম, মিরিন-সাকে-র মতো খাঁটি জাপানি রাইস ওয়াইন পার্কের জেনে খাস জাপান থেকেই আসে। সুশির সঙ্গে উষ্ণ সাকে তুখোড় কম্বিনেশন। বিভিন্ন উপকরণের উৎকর্ষের সুবাদে মুম্বইয়ের রেস্তোরাঁ ওয়াসাবি, দিল্লির মেগু-র সঙ্গে কলকাতায় পার্কের জেনও এশিয়ার কুলীন রেস্তোরাঁদের লিস্টিতে ঢুকে পড়েছে।
তবে জেন এবং জাপানি খানা মানেই পাড়াগাঁর ভূতের মতো কেবল কাঁচা মাছ কচকচিয়ে খাওয়া ব্যাপারটা এমন নয়। রেস্তোরাঁর কুশলী কাপ্তেন শেফ আনানচাই সাটিসন আদতে শ্যামদেশের ছেলে। রেস্তোরাঁর হেঁসেলে চিনে, তাই বা জাপানি রান্না সবেতেই তাঁর দৌড় অপ্রতিরোধ্য।
হপ্তায় ছ’দিন ডিনারে ও রবিবার দু’বেলা জেনের বিচিত্র মৎস্য-সম্ভার গ্রিল্ড কি ফ্রায়েড সাজেও রসিকের সেবায় মজুত। জাপানি রন্ধনশৈলীর মহিমা যেমন আগুনের ছোঁয়াচবর্জিত সুশিতে তেমনই মুচমুচে ভাজাতেও বটে। এই ভাজারই নাম টেম্পুরা। আমাদের ব্যাটার ফ্রাইয়েরই জাত ভাই সে। কবিরাজি কাটলেটেরও আত্মীয় বলা যায়। কিন্তু মিহি তবু কুড়মুড়ে ভারি নান্দনিক মোড়কে এমন মাছভাজাকে শিল্প বলে না-মেনে কোনও উপায় নেই। বার্বিকিউ সসে চিকেনের জাপানি ইয়াকিতোরি তো আছেই! জেনের মোলায়েম কিন্তু মুচমুচে হাঁসের মাংস চাখতে পারেন মিষ্টি-মিষ্টি তোবানজন হানা সসে। জাপানি লঙ্কাগুঁড়ো, টমেটো কেচাপ-টেচাপ মিশিয়ে রান্না। ভাবতে মজার লাগে, লঙ্কার ঝাল এমন ভালমানুষ! জাপানি রান্নায় ফিউশনের প্রাবল্যের কথা আগেই উঠেছিল। স্টেক সসে রান্না চিংড়ি বা ডাকেও ফিউশনের স্বাক্ষর। মাখন দিয়ে তৈরি সসেও কিন্তু জাপানের বিখ্যাত শিতাকে মাশরুম ও নুড্ল্স-প্রতিম ইনোকি মাশরুমের উপস্থিতি নির্ভুল ভাবে জাপানকে চিনিয়ে দিচ্ছে। ক্লিয়ার সুপ বা মিসো সুপ অদ্ভুত তরতাজা করে দেয়। তাতে জাপানি শুকনো মাছের গুঁড়ো মেশানো দাশি পাউডারে জাপানের অকাট্য উপস্থিতি। সি-উইড স্যালাড বা জাপানি উডন নুড্ল্সময় সি-ফুড স্যালাডও হাল্কা, ফ্রেশ অভিজ্ঞতা। শেষ পাতে ঘোর জাপানি রেডবিনপেস্টের রোলের সঙ্গে গ্রিন-টি আইসক্রিমের মিশেলও মনে ধরে।
জাপানিরা এক সঙ্গে ভাত, পছন্দসই মাংস বা মাছ, ডিমের ভুজিয়া, নুড্ল্স ইত্য্যাদি মিশিয়েও খেতে ভালবাসে! টাকনায় ঘরোয়া আচারি মুলো। কিন্তু শুনতে যতই ভাল লাগুক, মশলাবিলাসী বাঙালির তাতে ধাতস্থ হতে সময় লাগবে।
তবু আইটিসি-সোনারের প্যান এশিয়ানও সে-চেষ্টা কিছু দূর করেছে। ডাক্তার শরৎ ব্যানার্জি রোডের ওয়াল-এর জাপানি মেনুও কলকাতায় জাপানি কনস্যুলেটের কর্তাদের বেশ প্রিয়। উপকরণ দুর্লভ বলেই সুশি-টুশির দাম এত চড়া। তবে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাড়ায় শর্ট স্ট্রিটের সুশি ওকে-ও কিছুটা কম দামে সুশি খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। হাল্কা, লো-ক্যালরি খানা হিসেবে শাকাহারীরাও এ তল্লাটে সুশির প্রেমে মজেছেন। মাছের বিকল্প হিসেবে তাতে চিজ-টোফু-অ্যাভোকাডো-অ্যাসপ্যারাগাসের রমরমা। মুম্বই থেকে আমদানি একধরনের ওয়াসাবি আইসক্রিমও সুশি ওকে-তে মিলবে। পাতি ভ্যানিলাস্বাদের আইসক্রিমের মতোই, কিন্তু তেজিয়ান ওয়াসাবির ঝালটা মাঝেমধ্যে ধাক্কা দেয়। আমাদের ‘গুপ্ত কবি’ একদা মাছ-রান্না নিয়ে সাহেবদের জোর এক হাত নিয়েছিলেন। ‘বাঙালির মতো তারা রন্ধন না-জানে/ আধসিদ্ধ করে শুধু টেবিলেতে আনে’। এবং সাহেবদের রান্না মাছের ‘মশলার গন্ধ গায়ে কিছুমাত্র নাই’! জেনে সুশি-র জনপ্রিয়তা দেখলে ঈশ্বর গুপ্ত কী বলতেন জানতে ইচ্ছে করে। আর হ্যাঁ, ইলিশটাও কিন্তু কলকাতার এই ‘জাপানে’ বেশি দিন ব্রাত্য থাকছে না। শেফ দিওয়ান-আনানচাইরা লোভ দেখাচ্ছেন, মাসখানেকের মধ্যে সুশিতেও মরসুমি স্মোক্ড ইলিশের টুকরো মিলবে।

ছবি: শুভেন্দু চাকী




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.