বিখ্যাত সেই ‘পনিটেল’-টা আজ আর নেই। মানে, ছিল না। বরং মাথা জোড়া আজ সাদা কাপড়। মুখের অনেকটাও জুড়ে।
ঠিক কতগুলো ফুলের মালায় দেখতে দেখতে সওয়া ছ’ফুটের চেহারাটা ঢেকে গেল, গোনার উপায় নেই। দেবাঙ্গ গাঁধী থেকে শুরু করে লক্ষ্মীরতন শুক্ল, সিএবি-র উচ্চপদস্থ কর্তারা কে নেই সেই ভিড়ে (অসুস্থ থাকায় সিএবি প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়া আসতে পারেননি)? দুপুর একটা নাগাদ ক্লাব হাউসের পিছনের গেট দিয়ে নিথর শরীরটা বেরোনোর সময় তাঁর সম্মানে কর্তা-ক্রিকেটারদের একটা ছোটখাটো ‘গার্ড অব অনার’ও।
স্বাভাবিক। কল্যাণ মিত্র যে আর নেই। আর কোনও দিন দেখা যাবে না ময়দানের ‘ক্যামি স্মিথ’-কে।
দীর্ঘ দিন কর্কট রোগের প্রকোপে ভুগছিলেন। শেষ পর্যন্ত শুক্রবার ভোরে ৭৯ বছরে জীবনের ইনিংস শেষ করলেন কল্যাণ মিত্র। রেখে গেলেন এক পুত্রসন্তানকে।
সঙ্গে রেখে গেলেন একটা প্রশ্নও। বাংলা ক্রিকেট কি তার গুটিকয়েক বলিষ্ঠ চরিত্রের একজনকে শুক্রবার হারিয়ে ফেলল? শুধু বলিষ্ঠ কেন, বর্ণময়ও!
ষাটের দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ টিমের ক্যামি স্মিথের সঙ্গে আদবকায়দা, ক্রিকেট খেলার ধরন মিলত বলে ময়দান তাঁকে ডাকতে শুরু করেছিল ‘ক্যামি’ নামে। অফস্পিন করতেন। স্ট্রোক প্লে-ও অসম্ভব ভাল ছিল। ’৫৩ থেকে ’৬৯ বাংলা ও বিহারের হয়ে ৫১টি রঞ্জি ম্যাচে করেন ১৬৯৮ রান। উইকেট ৫০। এবং এ সসব কিছুই আবার অসম্ভব স্টাইলিশ ভঙ্গিতে খেলে অর্জিত। সে রকমই মাঠে স্টাইলিশ হাঁটাচলা। ল্যাঙ্কাশায়ার লিগেও খেলে এসেছিলেন। সিএবি-তে এ দিনও এক কর্তাকে বলতে শোনা গেল, “ক্রিকেট তো সাহেবদের খেলা। আর সেটা বাংলাকে বুঝিয়েছিলেন উনি।”
বাংলার হয়ে খেলেছেন। কোচ ছিলেন। ইডেনের কিউরেটর হয়েছেন। “কিন্তু কোনও দিন দেখলাম না, কাউকে ধরে কিছু হয়েছে। ঠিক আমার মতো ছিল,” খড়গপুর থেকে ফোনে বলছিলেন কল্যাণের দীর্ঘ দিনের বন্ধু প্রবীর মুখোপাধ্যায়। বর্তমান ইডেন কিউরেটর। প্রাক্তন রঞ্জি অধিনায়ক চুনী গোস্বামীর আবার মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে কোচবিহার ট্রফিতে কল্যাণের সঙ্গে নেমে পড়ার দিনটাকে। “আমি যখন বাংলার হয়ে প্রথম ক্রিকেট খেলতে নামি, ও ছিল টিমে। বড় প্রতিভা ছিল। যতটা প্রতিষ্ঠা পাওয়া ওর উচিত ছিল, ততটা পায়নি,” বলছিলেন চুনী।
কেন পাননি?
বাংলার ক্রিকেটমহল কোথাও গিয়ে কারণ হিসেবে খুঁজে পায় কল্যাণের খামখেয়ালি জীবনযাপনকে। যেখানে তিনি হঠাৎ সব ছেড়েছুড়ে কখনও আমেরিকা চলে যান, কখনও নেমে পড়েন বিহারের জার্সিতে। কিন্তু সেই খামখেয়ালি জীবনেও মিশে ছিল জীবন নিয়ে সাহসী দৃষ্টিভঙ্গী। মিশে থাকবে শিশুসুলভ মিশুকে মনোভাব। পিচ তৈরি নিয়ে মিডিয়া প্রশ্ন তুললে যে লোকটা গর্জে উঠতেন, “আমাকে কি দর্জি পেয়েছ নাকি? যা বলবে, তাই করতে হবে?” সেই ভদ্রলোকই আবার হাঁটুর বয়সি লক্ষ্মীরতন শুক্লকে অক্লেশে বলতেন, “অ্যাই শোন, তোর একটা ব্যাট দিস তো আমাকে!”
আর বোধহয় সে কারণেই জীবন-মৃত্যুর প্রাচীর পেরিয়ে বাংলার ক্রিকেট-ইতিহাসে তাঁর এই সত্ত্বাটাই শেষ পর্যন্ত থেকে যাবে। ময়দানের ‘ক্যামি স্মিথ’ হিসেবে নন। পনিটেল বাঁধা অসম্ভব স্টাইলিশ ক্রিকেটার হিসেবেও হয়তো নন।
তিনি কল্যাণ মিত্র থাকবেন সবার ‘কান্তুদা’ হিসেবে! |