কল্যাণ মিত্র ছিলেন প্রকৃত অর্থে বাংলার শেষ জমিদার ক্রিকেটার।
নিজের মেজাজে থাকতেন। স্পষ্ট কথা বলতেন। কর্মকর্তাদের তোয়াজ কোনও দিন করেননি। সে জন্য বহু ক্ষেত্রে যোগ্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু কখনও কারও ওপর রাগ বা অভিমান পুষে রাখতে দেখিনি।
কান্তুদার সারা জীবনটা ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা। নিজের জীবন নিয়ে যেন জুয়ায় মেতেছেন! কখন কী করবেন কে বলতে পারে? একদিন হাতে ব্যাট-বল তো পরক্ষণেই পিয়ানোর কি-বোর্ডে আঙুলের নাচ! গলায় ছিল মিষ্টি সুর। আদবকায়দায় কেতাবি নড়াচড়া।
মাঠের বাইরে যেমন অলরাউন্ডার, মাঠের ভেতরেও তাই। কান্তুদার ড্রাইভে যা জোর ছিল তার সঙ্গে একমাত্র ধোনির ড্রাইভের তুলনা করা যেতে পারে! রয় গিলক্রিস্টের ঘণ্টায় ৯০ মাইলের বেশি গতির বলকে পরপর দু’বার যে রকম অবিশ্বাস্য জোরে ড্রাইভ মেরে তখনকার ইডেনের রঞ্জি স্ট্যান্ডে পাঠিয়েছিলেন, সেটা যাঁরা দেখেছেন নিশ্চয়ই কখনও ভোলেননি। দু’বারই বলের আকৃতি পাল্টে গিয়েছিল। আম্পায়ারদের বাধ্য হয়ে দু’বার বল পাল্টাতে হয়। তা-ও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একটা ডেলিভারি হওয়ার পরেই! |
প্রয়াত কল্যাণ মিত্রকে শেষ শ্রদ্ধা লক্ষ্মীরতনের। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
হাতে ছিল বিশাল অফস্পিন-ও। অতটা বল ঘোরাতে কাউকে কোনও দিন দেখিনি। একবার দলীপ ট্রফিতে বিজয় মঞ্জরেকর-হনুমন্ত সিংহের মধ্যাঞ্চলকে স্পিনের জাদুতে প্রায় একাই কাবু করে দিয়েছিলেন কান্তুদা। ছ’ফুট তিন ইঞ্চির মেদহীন শরীরটা ছিল চাবুকের মতো। নামী সিনিয়র ক্রিকেটার ভুল করলেও রেগে যেতেন। একটা ম্যাচে পঙ্কজ রায়ের ভুল ‘কল-এ কান্তুদা রান আউট হতে হতে বেঁচে গিয়েছেন। দর্শক গ্যালারি থেকে দেখলাম, অধিনায়ক পঙ্কজ রায়কে হাত নেড়ে তাঁর ভুলটা দেখাচ্ছেন কান্তুদা! আর পঙ্কজ রায় ক্রিজের অন্য প্রান্ত থেকে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কান্তুদার কাঁধে হাত রেখে তাঁকে শান্ত করছেন! বিরল অভিজ্ঞতা। নবীন স্পষ্টবাদী, প্রবীণ ততোধিক ভদ্র। ষাট দশকের এই আচরণ ক্রিকেট মাঠে পরে আর কোনও দিন দেখিনি।
ছোটদের ক্ষেত্রে আবার কান্তুদা ঠিক উল্টো। যতই ভুল করি না কেন, গ্রাহ্যের মধ্যে আনতেন না। বলতেন, “ছোটরা ভুল করবে না তো কি আমরা করব?” গল্প করতে ভালবাসতেন। আড্ডার সুযোগ পেলেই হল। কিন্তু কোনও দিন কারও সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতে শুনিনি।
খেতে খুব ভালবাসতেন। একবার জামাডোবায় ম্যাচ চলাকালীন আমাকে ডিনারে ডেকে বাড়িতে বৌদিকে বোধহয় বলতে ভুলে গিয়েছিলেন। আমাকে দেখে বৌদিকে বললেন, “জানো, রাজু খুব ডিম খেতে ভালবাসে। ডাল-ভাত-অমলেটে ডিনার খুব জমবে।” কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বৌদি মাংসের কিমা-পরোটা বানিয়ে সামনে হাজির। বুঝলাম, এই ‘ঘটনা’ প্রায়ই হয়। কান্তুদা ভুলো মন হতে পারেন, কিন্তু বৌদির হাতের রান্না ভোলার নয়।
পরিসংখ্যান দিয়ে কান্তুদাকে মাপতে যাওয়াটা তাঁর প্রতি অন্যায় হবে। ক্রিকেটার কল্যাণ মিত্র সম্পর্কে সবচেয়ে ভাল বোধহয় বলেছিলেন মোহনবাগানের প্রাক্তন ক্রিকেট সচিব চিনে দত্ত। “বুঝলে, কান্তু হল রোলস রয়েস-এর পার্টসে ভর্তি। সমস্যা হল, সেই পার্টস কোনও দিন জোড়া লাগল না।”
সত্যিই তাই। অনন্য প্রতিভা। অজাতশত্রু। একমাত্র কান্তুদাকেই দেখেছি, বিয়ার-পান-সিগারেট একসঙ্গে উপভোগ করতে! ছেলেকে ডাকতেন ‘দুষ্টু’ বলে। হওয়া উচিত ‘দুষ্টু-দুই’! অরিজিনাল দুষ্টু তো নিজেই। কান্তুদা মারণরোগে ভোগাকালীন ‘মেডিকা’ হাসপাতাল দায়িত্বভার না নিলে শেষের দিকে হয়তো তিনি চিকিৎসা পেতেন না।
গত মাসে বাড়িতে দেখা করে ফিরে আসব। কান্তুদা হঠাৎ বললেন, “এই চেহারাটা দেখতে আর কখনও এসো না রাজুবাবু।”
‘রাজুবাবু’ বলে আমাকে ডাকার আর কেউ রইল না! |