বেড়ানো...
পাগলি,তোমার সঙ্গে
মি শাঁখা পরব।
হাজার বিঘের বিশাল দিঘি ধামসেরা’র পাড়ে শাঁখা দর করতে ব্যস্ত বধূদের পাশে বসে পড়ে বৃষ্টি। বৃদ্ধ শাঁখারি বৃষ্টির কোমল ডান হাতটি ধরে শাঁখা পরাতে গিয়ে বলে ওঠেন: “মা, তুমি কি সীমন্তিনী? দেখে তো মনে হচ্ছে কুমারী।” তীব্র বিরক্তির সঙ্গে বেজে ওঠে বৃষ্টি: “কুমারী? আমি শাঁখা পরবই। এত সুন্দর দেখতে।” শাঁখারি বলেন, “না মা, কুমারীর হাতে শাঁখা-পলা পরাতে পারব না।”
কলকাতা-বর্ধমান-কৈচর। বাদশাহি সড়ক ধরে। বাঁ হাতি রাস্তা। বর্ধমান-কাটোয়া ন্যারোগেজ লাইন পেরিয়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার যেতেই বাঁ হাতি মোরাম রাস্তা গড়িয়ে গিয়েছে ক্ষীরগাঁয়ের দিকে। গাঁয়ে ঢোকার মুখেই ধামসেরা বা ধামাস দিঘি। এর পাড়ে বসেই শাঁখা পরেছিলেন উমা, বৃদ্ধ শাঁখারির কাছে। তার পর মন্দিরের বৃদ্ধ পুরোহিতের বিলাপ এবং--- ‘সহসা শঙ্খ-বলয়িত কার পাণি/জাগিয়া উঠিল পদ্ম দিঘির বুকে! তার পরে ধীরে ধীরে নধর সে হাতখানি/হ’ল তিরোহিত, চক্ষের সম্মুখে! শাঁখারি-পূজারিঅবাক হইয়া রহে/বারবার তারা প্রণমে দেব্বোদেশে’। বৈশাখী সংক্রান্তির দিন থেকে জ্যৈষ্ঠের চার তারিখ পর্যন্ত যোগাদ্যায় যে উৎসব চলে সেখানে শাঁখা পরেন ক্ষীরগাঁ-সহ অসংখ্য গ্রামের বধূরা।
বৃষ্টির জেদ! হার মানতে হয় শাঁখারিকে। চড়া দামে মাপ মতো শাঁখা কিনে চাল-ধোওয়া-জল-রং-হাতে শাঁখা পরে বৃষ্টি। এ বার বাক্রুদ্ধ বাকি বধূরা। কদম-ছাঁট পক্ককেশ বায়ু-সেনার প্রাক্তন-কর্তা কঙ্কন, শাঁখারিও! বৃষ্টি এমনই। ভীষণ আনপ্রেডিক্টেবল!
কিন্তু কোথায় সেই সোনার-কলস-দেউল? শাঁখা পরার পর দাম দিতে গিয়ে উমা বৃদ্ধ শাঁখারিকে যে-মন্দিরের ও ঝাঁপিতে রাখা কড়ি এবং তার পুরোহিত পিতার কথা বলেছিল? গ্রামবাসী প্রৌঢ় পথ দেখান। মোরাম রাস্তা ধরে এগোলেই গ্রামের প্রান্তে মন্দির আর দিঘি। মন্দিরের সামনে প্রবেশ মণ্ডপ, পরে গর্ভগৃহ। মন্দিরে প্রতিমা নেই। নিত্য ঘট-পুজো হয়।
দেবী যোগাদ্যা। বছরে ছ’দিন মূর্তি দিঘি থেকে তোলা হয়। ক্ষীরদিঘির দক্ষিণে সতীর ডান পায়ের আঙুল পড়েছিল। ক্ষীরগাঁ তাই সতীপীঠ। ৫১ পীঠের অন্যতম।
মেঘ জমছিল অনেকক্ষণ ধরেই। আকাশ কখন যেন কালো হয়ে এসেছে, বৃষ্টির কুঞ্চিত কালো-কেশদামের মতো। শুরু হয়েছে চিকুর হানা। বিজুলি-উজল-আলোয় উদ্ভাসিত বৃষ্টির মুখ। গভীর-দীঘল চোখ। পলাশ রং পাঞ্জাবি-পরা পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির উজ্জ্বল-শ্যাম-শরীর।
দিঘির অদূরে নাতি-উচ্চ টিলা। টঙে দেবীর ভৈরব ক্ষীরকণ্ঠ শিবের মন্দির। মন্দির থেকে গোটা ক্ষীরগাঁ দারুণ দেখায়। সমুদ্র মন্থনে অমৃতের সঙ্গে গরলও উঠেছিল। সেই কালকূট পান করে শিব যন্ত্রণায় আকুল হলে দেবী তারা রূপে স্তন্য-সুধা পান করিয়ে শিবকে বিষ-মুক্ত করেন। দুধের আর এক নাম ক্ষীর। তাই নীলকণ্ঠ হলেন ক্ষীরকণ্ঠ।
বর্ধমানে পুরনো জিটি রোডের মোড়ে নবাবহাট। ১০৮+১=১০৯ শিবমন্দির। ১৭৮৮-১৭৯০ সালে তৈরি। একই মাপের। একই রঙের। রুদ্রাক্ষের মালার মতো। আছে পুকুর। অনেক গাছ। এবং অপার শান্তি। বৃষ্টি সাদা লিনেন শার্ট-স্কিন-টাইট ব্লু জিন্স। তীব্র-তপন-তাপে মুখে-ঘাড়ে-গলায় মিহিদানা-স্বেদ। একটু ভিজেছে স্বচ্ছ সাদা শার্টও। আতপ্ত অন্তর্বাসের অর্ধ-উন্মীলন ফলত অনিবার্য। চোখে অ্যাভিয়েটর। রুপোলি কাচ। কঙ্কন আর বৃষ্টি একটার পর একটা মন্দির ঘুরছে। অসংখ্য রমণীচোখে তখন ধনুষ্টংকার-ঈর্ষা! দেবাদিদেবের দরবারে নতজানু কঙ্কন কাঁপা-কাঁপা পায়ে দাঁড়িয়ে ওঠে, করুণ শঙ্খের মতো চোখ তুলে বলে ওঠে: “ভোলানাথ, সবাইকে ভাল রেখো।” সবাইকে? কঙ্কন, নিজের যন্ত্রণার কথা নয়! পাশে বৃষ্টি। গাড়িতে ওঠার আগে কিনল ছাল-ছাড়ানো নুন-লঙ্কা মাখানো মুঠো-ভর্তি কাঁচা-মিঠে আম।
বহুদর্শী কঙ্কন বলে, বৃষ্টি জানো, বর্ধমান-বীরভূম মানে শুধু প্রাচীন জিটি রোড-বিজয় তোরণ বা বিশ্বকবি-বাউল-বানজারা হাট-কোপাই-খোয়াই নয়। বীরভূম-বধর্মান মানে অনেক নিরীহর রক্তে শাসকের স্নানও!
ছুটতে শুরু করল কঙ্কনের এসইউভি। নিচু গ্রামে বেজে যাচ্ছে বব ডিলানের অবিনাশী গান: হাউ মেনি রোডস মাস্ট এ ম্যান ওয়াক ডাউন/বিফোর য়ু কল হিম আ ম্যান। দূর দিগন্তে তখন রঙের রায়ট! অজস্র কৃষ্ণচূড়া এবং কিছু রাধাচূড়া। অ্যাক্সিলেটরে চাপ, কাঁচা-মিঠে আম মুখে দিয়ে টকাস শব্দ করে কঙ্কন বলে ওঠে: কৃষ্ণচূড়া কিন্তু বিদেশি, মাদাগাস্কার থেকে আনা।অবন সেতু হয়ে পথ গিয়েছে সোজা শান্তিনিকেতনে। তার আগে গুসকরা। মঙ্গলকোটের নতুনহাটের মোড় থেকে বাঁ দিকে
গুসকরার পথে কিছুটা গিয়ে কুনুরের উপর কুমুদ সেতু। পার হয়ে ডান দিকে পথ। কুমুদরঞ্জনের আমবাগানকে বাঁয়ে রেখে পথ চলা। দু’দিক থেকে অজয় আর কুনুর এগিয়ে আসছে। ছোট্ট কুনুর কোগ্রামকে দক্ষিণ ও পুব দিকে বেড় দিয়ে অজয়ে মিশেছে। অজয় এখানে উত্তরবাহিনী। অজয়ের এ-পারে বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট, ও-পারে বীরভূমের নানুর। মঙ্গল কাব্যের উজানিনগর আজকের কোগ্রাম। পল্লি-কবি কুমুদরঞ্জনের কোগাঁ, ‘ভাঙন-ধরা অজয় নদীর বাঁকে’।
চৈতন্যমঙ্গলের কবি লোচনদাসের শ্রীপাট ছিল কোগ্রামেই। অল্প বয়সে বিয়ে করেও লোচনদাস বিদ্যাভ্যাস করে যান, ভুলে যান সংসার, যৌন-জীবন। ক্রুদ্ধ স্ত্রী তাই গাঁয়ের নাম দেন ‘কুগ্রাম’। লোচনদাস তাকে ‘কোগ্রাম’ করেন। এখন কোগা।ঁ অজয়ের ধারে কবি লোচনদাসের সমাধি। কাছেই সর্বমঙ্গলা মন্দির। আর এক সতীপীঠ।
কুমুদরঞ্জনের আদি ভিটে গিয়েছে অজয়ের ভাঙনে। নতুন বাড়ি দেখে সঙ্গমের পথে। একটু পরেই কৌমার্য হারাচ্ছে কুনুর। নন্দিত-নদী ঝাঁপিয়ে পড়ছে গেরুয়া-বসন-উদাসীন-সন্ন্যাসীসম অজয়ের বুকে। তপ্ত বিকেলে, জল আর বালির বিপুল বিস্তারে, অজয়কে উদাসীন ঋত্বিক মনে হয়।
রাতে অতিথিনিবাস ‘অজয়’-এর ছাতে। সামনে নদ-নদীর শ্লীল সঙ্গম। মাথার উপর কালচে নীল জামদানি-আঁচল-আকাশ। শুক্লা একাদশীর চাঁদ আকাশ পারাবারের খেয়া একলা চালাচ্ছে বসি। রুপো রং চাঁদের গায়ে কলঙ্ক-চিহ্ন স্পষ্ট। বাসব-বাঞ্ছিত পানপাত্র নামিয়ে রেখে সহসা বেজে ওঠে বৃষ্টি: কঙ্কনদা, কেন কুমারী মিশে যায় কংসাবতীতে? কুনুর অজয়ে? কী রতি-সুখ পায় নদী অনিঃশেষ আত্মসমর্পণে?
সহসা শাঁখা-পরা দু’টো হাত উপরে তুলে রূপ-তাপসী বৃষ্টি বলে ওঠে: কুমারী! কলঙ্ক? মানে কী শব্দ দুটোর? সাতাশে কেউ কুমারী থাকে কঙ্কনদা? থাকলে বুঝতে হবে শারীরিক বা মানসিক সমস্যা আছে।
এতক্ষণ চুপ বন্ধু-প্রিয় বাঁড়ুজ্জে কঙ্কন দু’হাতে দু’টো হাঁটু চেপে ধরে, যন্ত্রণা-বিদ্ধ মুখ আকাশে তুলে, উঠে দাঁড়িয়ে প্রাণ খোলা হাসিতে জাগিয়ে তোলে আম-জাম-কাঁঠাল-শাল-পিয়াল-পেয়ারা গাছে ক্লান্ত-ডানা-পাখিদের। বলে, “কুমারী-কৌমার্য! মানে কী! কালী আর কার্ল মার্ক্স একসঙ্গে পুজো পায় এ-দেশে! ভাল মানুষ হওয়াই সবথেকে জরুরি। কেউ ভালবাসে প্রিয় দেবতার প্রসাদ পেতে, কেউ বাংলা মাল খেতে। কেউ রুটি দিতে, কেউ কেড়ে নিতে! এমনকী ভালবাসাও!” কঙ্কন? একি শুধু সংলাপ? নাকি জীবনবেদ?
অদূরে অজয়, রাতের কুনুর। ও-পারে রজতাভ মেঘ-মাখা আবছায়া বীরভূম। দূরে দৃষ্টি রেখে বৃষ্টি বলে: “আবার আসব ফিরে, কুনুরের তীরে, কুমারী হয়ে! অথবা ইলামবাজার জঙ্গলে, শ্রাবণী-পূর্ণিমায় বানজারা হাটের কটেজে ক’টা কুমারী-দিন কাটাব বলে।” বলেই নির্জনে হাসির ঝরনা হয়ে যায়।
কুমারী! ব্যাগে মোবাইল-লিপস্টিক-ক্লেনজিং মিল্ক-ময়েশ্চারাইজার-পার্স-পারফিউম-ডেবিট কার্ড-ওয়েট টিস্যু পেপার নিতে বৃষ্টির কখনও ভুল হয় না। এবং একান্ত ব্যক্তিগত কিছু। কী সেটা? না-ই বা বললাম! বৃষ্টির কথায়, ‘রিস্ক তো নেওয়া যায় না।’


কিছু তথ্য
কোগ্রাম: ১. পঞ্চায়েত সমিতির অতিথিনিবাস ‘অজয়’।
যোগাযোগের জন্য: মঙ্গলকোট বিডিও অফিস০৩৪৫৩-২৬৬৩৩৩। ক্ষীরগাঁয়ে থাকতে হলে মন্দিরের যাত্রীনিবাস। আগাম সংরক্ষণ হয় না।
বানজারা হাট: শাল জঙ্গলের দেশে।
শমীক: ৯৮৩০১-৪৬৩২৪।
এই শ্রাবণে মাইথনে। দামোদর গর্ভিনী নারীর মতো। ভরন্ত। থেকে থেকেই বিশাল জলাধারের লকগেটে ধাক্কা মারছে ক্রুদ্ধ নদ। এ-পার ও-পার দেখা যায় না। ছোট্ট সেতু পার হয়ে আশ্চর্য অতিথি-আবাস মজুমদার নিবাস। রাতে চাঁদ উঠলে কোনও কথা হবে না। হাওড়া: সকাল ৬-০৫ মিনিটে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস। ১০-০৫-এ বরাকর। গাড়ি ভাড়া করে আধ ঘণ্টায় মাইথন।
যোগাযোগ: ২৩৩৩২১১৫
কাটোয়া। শ্রীচৈতন্যের দীক্ষা-স্থান। বর্ষায় ফুলে-ফেঁপে ওঠা দামোদর আর কূল-ছাপানো গঙ্গার সঙ্গম। ভিন্ন রঙের দুই ধারা। অদূরে উদ্ধারণপুরের ঘাট! কাটোয়া পুরসভার অতিথি নিবাস অথবা লজ অশোক নিশ্চিন্ত আশ্রয়।
যোগাযোগ: ০৩৪৫৩-২৫৮২৭৮ এবং ২৫৫১৩৫।
টাকি। ইছামতির তীরে। ওপারে আবছা বাংলাদেশ! ভরা বর্ষায় ইছামতি অনন্যা। টাকি পুরসভার সভাপতি অজাতশত্রু সোমনাথ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা অতিথি নিবাস, যেন নদীর উপর ঘর। তবে নদীতে নামবেন না, কামট-কুমির আছে।
যোগাযোগ: ৮৯৬৭১৫৭৭৭৮

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
মডেল: অঞ্জনা বসু


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.