|
|
|
|
অতলে সিন্ধুরক্ষক |
ডুবোজাহাজে বিস্ফোরণ, আশঙ্কা মৃত ১৮ |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
মাঝরাতে পরপর তিন বিস্ফোরণ ও তার জেরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মুম্বইয়ে বন্দরের অদূরেই তলিয়ে গেল ভারতীয় নৌবাহিনীর ডুবোজাহাজ আইএনএস সিন্ধুরক্ষক। দুর্ঘটনার সময়ে ওই সাবমেরিনের কেবিনের বাইরে থাকা তিন জন কোনও মতে জলে ঝাঁপিয়ে বাঁচেন। কিন্তু ভিতরে যে ১৮ জন নাবিক ছিলেন, তাঁদের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে নৌবাহিনী সূত্রেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রাতের এই দুর্ঘটনায় বিরাট ধাক্কা খেল নৌবাহিনী তথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
২০১০-এ বিশাখাপত্তনমে থাকার সময়ে এক বার আগুন লেগেছিল এই ডুবোজাহাজে। মারা যান এক নাবিক। এ বারের বিস্ফোরণ ঠিক কী ভাবে ঘটল, এখনও নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না। তদন্ত কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। নৌবাহিনীর প্রধান ডি কে জোশী জানান, তিনি অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না। সিন্ধুরক্ষকের নির্মাতা রুশ সংস্থা জানিয়েছে, কারণ নিয়ে তারাও অন্ধকারে।
প্রাথমিক রিপোর্টে অবশ্য বলা হয়েছে, ডুবোজাহাজটির সামনের দিকে একটি কেবিনে টর্পেডো মজুত ছিল। বিস্ফোরণ ঘটেছিল সেখানেই। কয়েকটি সূত্রের দাবি, প্রথমে একটি ছোট বিস্ফোরণ ঘটে। তার পরেই আরও দু’টি বড়সড় বিস্ফোরণ। এই সময়ে ডুবোজাহাজে মজুত টর্পেডো ও অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্রে আগুন লেগে সেগুলিও ফাটতে শুরু করে বলে মনে করা হচ্ছে। বিস্ফোরণের পর দুমড়ে-মুচড়ে যায় ডুবোজাহাজের সামনের অংশটা। হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকতে থাকে। ক্রমে তলিয়ে যায় সিন্ধুরক্ষক। |
|
জ্বলছে সিন্ধুরক্ষক। আগুন দেখা যাচ্ছে বহু দূর থেকেও। ছবি: রয়টার্স। |
এই ঘটনার পরেই আশপাশের জাহাজগুলিকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। তা সত্ত্বেও কাছেই দাঁড়ানো অন্য একটি ডুবোজাহাজে আগুন লেগে যায়। দমকলের তৎপরতায় রক্ষা পায় সেটি। উদ্ধারকাজে নামেন ডুবুরিরা। আপাতত তলিয়ে যাওয়া সিন্ধুরক্ষক থেকে জল বার করে সেটিকে ভাসিয়ে তোলার চেষ্টা চলছে। কিন্তু সে কাজ দুরূহ। কারণ, ঘোলা জলে দৃশ্যমানতা প্রায় শূন্য। তার ওপর ‘হ্যাচ’ (ডুবোজাহাজের ভিতরে ঢোকার বন্দোবস্ত) খোলা না গেলে নিখোঁজ নাবিকদের ব্যাপারে কিছু জানা সম্ভব নয়।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী এ কে অ্যান্টনির সঙ্গে ঘটনাস্থলে যান নৌপ্রধান জোশী। তিনি বলেন, “এখনও ভাল কিছুর আশায় আছি। খারাপ খবর শোনার জন্যও প্রস্তুত। তবু মিরাক্ল তো হয়!” অ্যান্টনি বলেন, “এটি সাম্প্রতিক কালের সব চেয়ে বড় ট্র্যাজেডি।”
সিন্ধুরক্ষক বিপর্যয়ে বাস্তবিকই অথৈ জলে পড়ল নৌবাহিনী। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতিতে, যেখানে পুঞ্চের ঘটনার জেরে পাকিস্তানের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধ ফের মাথাচাড়া দিয়েছে। উপরন্তু, শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে ভারতের উপরে পরোক্ষে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। দক্ষিণ চিন সাগরে ভারতের তেল উত্তোলন নিয়ে সম্প্রতি খোলাখুলি অসন্তোষ জানিয়েছে তারা। এই অবস্থায় নিজেদের জলসীমায় কর্তৃত্ব মজবুত করতে ভারতের অন্তত ২০টি ডুবোজাহাজ প্রয়োজন। আরও ভাল হয় ৩০টি থাকলে। কিন্তু সিন্ধুরক্ষককে ধরে ছিল মাত্র ১৪টি।
আর দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিপর্যয়টা ঘটল সিন্ধুরক্ষকেই। যেটি থেকে ‘ক্লাব’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আঘাত হানা যেত ১৫০ মাইল দূরের লক্ষ্যবস্তুতে। যেটি কি না গত বছরের অক্টোবরে আগের চেয়েও বেশি আধুনিক হয়ে ফিরেছিল রাশিয়া থেকে। ভারত-রাশিয়া যৌথ উদ্যোগে তৈরি, ডিজেলচালিত সিন্ধুরক্ষক নৌবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। তখন সেটি তৈরির খরচ পড়েছিল প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। ২০১০-এর অগ্নিকাণ্ডের পর সেটিকে আবার রাশিয়া পাঠানো হয়। আড়াই বছর ধরে মেরামতের পাশাপাশি সিন্ধুরক্ষকের রণকৌশল ও যুদ্ধাস্ত্র নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত ব্যবস্থা আরও উন্নত করা হয়। লাগানো হয় নতুন কুলিং সিস্টেম। ব্যাপার হল, এই সমস্ত মেরামতিতে যা খরচ হয়, তা ডুবোজাহাজটি তৈরির খরচকেই ছাপিয়ে যায় খরচ হয় প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা। কাজেই নৌবাহিনী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তারা যতই ধাক্কা সামলে নেওয়ার আশ্বাস দিন, অস্বস্তিটা ঢেকে রাখা যাচ্ছে না।
ডুবোজাহাজে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রাক্তন নৌসেনা প্রধান সুশীল কুমার বলেছেন, “সিন্ধুরক্ষকের মতো প্রথম সারির ডুবোজাহাজের এই পরিণতি সত্যিই নৌবাহিনীর কাছে বড়সড় ধাক্কা।” আর এক প্রাক্তন নৌসেনা-কর্তা এ কে সিংহের ব্যাখ্যা ডুবোজাহাজের নীচের দিকে ব্যাটারি থাকে। আর উপরের দিকে থাকে ক্ষেপণাস্ত্র। চার্জ হওয়ার সময় ব্যাটারি থেকে ক্রমাগত হাইড্রোজেন বেরোতে থাকলে গ্যাসের ঘনত্ব ৪% পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। তখন এর থেকে বিস্ফোরণ ঘটতেই পারে। ২০১০-এ এই ব্যাটারির ত্রুটিপূর্ণ ভাল্ভ থেকে হাইড্রোজেন লিক করেই সিন্ধুরক্ষকে আগুন লেগেছিল বলে একটি সূত্রের দাবি। তবে এ কে সিংহের মতে, মঙ্গলবারের বিস্ফোরণ সম্ভবত শুধু হাইড্রোজেন লিক করে ঘটেনি। তাঁর সন্দেহ, “হাইড্রোজেন থেকে হয়তো আগুন লেগেছিল। সেই আগুনই সম্ভবত ছুঁয়ে ফেলে যুদ্ধাস্ত্র বোঝাই জাহাজের সামনের কেবিনটিকে।”
|
বিপদে রণতরী |
• ২১ অগস্ট, ১৯৯০: বঙ্গোপসাগরে ১৫ কর্মী-সহ ডুবে যায় আইএনএস আন্দামান। |
• ২৭ ডিসেম্বর, ২০০৫: মুম্বই বন্দরে বাণিজ্যতরী অম্বুজা লক্ষ্মীর সঙ্গে ধাক্কা আইএনএস ত্রিশূলের। |
• ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬: বিশাখাপত্তনম বন্দরে আগুন লেগে যায় আইএনএস মগরে। |
• ২১ এপ্রিল, ২০০৬: গোয়ায় বাণিজ্যতরী এমভি লিডস ক্যাসেলের সঙ্গে ধাক্কা আইএনএস প্রহারের। |
• ৭ জানুয়ারি, ২০০৮: মুম্বই বন্দরে একটি বিদেশি বাণিজ্যতরীর সঙ্গে ধাক্কা খায় আইএনএস সিন্ধুঘোষ। |
• ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮: বঙ্গোপসাগরে মহড়া চলাকালীন বিস্ফোরণ আইএনএস জলাশ্বতে। মৃত ৫ নৌসেনা। |
• ২৮ জুন, ২০১০: বিশাখাপত্তনমে আইএনএস সিন্ধুকেশরী ও আইএনএস সিন্ধুরত্নের মধ্যে ধাক্কা। |
• ৩০ জানুয়ারি, ২০১১: মুম্বইয়ে বাণিজ্যতরীর সঙ্গে ধাক্কার পর আগুন আইএনএস বিন্ধ্যগিরিতে। |
|
|
|
|
|
|
|