|
|
|
|
|
|
|
তবুও লাভ
টাকা তলানিতে। অর্থনীতি বেসামাল। তাই আশঙ্কার মেঘ গর্জাচ্ছে শেয়ার
বাজারে।
ওঠা-পড়ার ঢেউয়ে এই সমুদ্র এখন উথালপাথাল। তাতে কী?
ধৈর্যের কৌশলী ছিপ ফেললে মুনাফার মাছ উঠবেই
সত্যব্রত মজুমদার |
|
বাঁচাও কে আছ মরেছি যে শেয়ার কিনে...!
‘ছদ্মবেশী’ সিনেমার বিখ্যাত গানের এই প্যারোডি এখন শেয়ার বাজারে লোকের মুখে মুখে। সকলেই যে গানখানা গলা চড়িয়ে গাইছেন, এমনটা নয়। কিন্তু মুনাফার স্বপ্নের গুঁতোয় সযত্নে বেছে কেনা শেয়ারের দরও যদি খোলামকুচির মতো হয়ে দাঁড়ায়, তবে মনের অবস্থা তো এমন তিতকুটে হওয়াই স্বাভাবিক। লোকসানের তোড়ে ভেসে না-যেতে খড়কুটো খোঁজার এই আর্তিও অস্বাভাবিক নয়।
তাজ্জব!
ভেবে দেখুন, চলতি বছরে চার-চার বার ২০ হাজারের উচ্চতা ছুঁয়েছে বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক সেনসেক্স। তলানিতে ঠেকা টাকা, দেশের বেহাল অর্থনীতি, ইউরোপ নিয়ে আশঙ্কা তাকে বার-বার টেনে নামিয়েছে ঠিকই। কিন্তু তেমনই এখনও পর্যন্ত তা ঘুরেও দাঁড়িয়েছে প্রায় সমান তালে। যে কারণে দেশের কোনও শেয়ার-সূচক সে ভাবে তলিয়ে তো যায়ইনি, বরং সেনসেক্স এখনও ঘোরাফেরা করছে ১৯-২০ হাজারের ঘরে। অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা একেবারে ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
কিন্তু ২০ হাজারের কাছে ঘুরঘুর করা সেনসেক্সের ছাপ হাতে থাকা শেয়ারের দামে পড়ছে কোথায়? দেশের অধিকাংশ নামী-দামি সংস্থার শেয়ারের (ব্লু-চিপ শেয়ার) দরই তার সর্বোচ্চ (এমনকী গড়) দামের থেকে বেশ খানিকটা নীচে। শেয়ার বেচে মোটা মুনাফা করছেন, দূরবিনেও এমন সাধারণ লগ্নিকারীর দেখা মিলছে না। অনেক ভেবেচিন্তে, বাছাই করে শেয়ার কিনেও এখন লোকসান এড়াতে হিমসিম খাচ্ছেন অনেকে। এমনকী যাঁরা লগ্নির ব্যাকরণ মেনে ধৈর্য ধরে দীর্ঘ সময়ের জন্য টাকা ঢেলেছেন, স্বস্তিতে নেই তাঁরাও। বাজারের এই বিচিত্র পরিস্থিতিই একেবারে দিশেহারা করে দিচ্ছে সাধারণ লগ্নিকারীদের। তাজ্জব বানিয়ে দিচ্ছে অনেক বিশেষজ্ঞকেও।
দুই প্রশ্ন
এমনিতেই সাধারণ লগ্নিকারীদের পুঁজি অল্প। সীমিত ঝুঁকি নেওয়ার ক্ষমতাও। অথচ তাঁদের অনেকেই আজ দেখছেন, হাতে যা শেয়ার আছে, তা এখনই বেচলে মোটাসোটা লোকসান একশো ভাগ নিশ্চিত। তাই সেই হিসেবে আপাতত ওই শেয়ার ধরে রাখাই ‘ভাল’। কিন্তু মুশকিল হল, অদূর ভবিষ্যতে ওই সব শেয়ারের দর যে উঠবেই, এমন ভরসাও তেমন জোরালো ভাবে পাচ্ছেন না তাঁরা। ফলে হাতের ওই শেয়ার ধরে রাখবেন না বেচবেন, তাঁদের প্রধান প্রশ্ন এখন সেটাই।
দ্বিতীয় প্রশ্ন অবশ্যই নতুন করে শেয়ার কেনা নিয়ে। বাজারে যাঁরা পুরনো খেলোয়াড়, তাঁরা জানতে চান, দর পড়ে যাওয়া শেয়ার বেচে সেই টাকায় ঠিক কী ধরনের শেয়ার কিনলে আগামী দিনে লাভের মুখ দেখা যাবে? কোন কোন শিল্পের শেয়ার ভবিষ্যতে মুনাফার সন্ধান দিতে পারে, তা জানতে চান নতুন লগ্নিকারীরাও।
আজকের আলোচনায় মূলত এই দুই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব আমরা।
রাখি না বেচি?
কাজের সূত্রে আখছার দেখছি, অনেকের হাতেই এখন এমন বেশ কিছু শেয়ার রয়েছে, যেগুলির দর নেমে গিয়েছে কেনা দামের থেকেও অনেকখানি নীচে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই সেই সব শেয়ার নিয়ে লগ্নিকারীদের চুল ছেঁড়ার দশা।
এঁদের অনেকে মনে করছেন, খামোখা লোকসান করে শেয়ার বেচব কেন? তার থেকে তা ধরে রাখা ভাল। কখনও-না-কখনও তো দর উঠবেই, তখন বরং তা বিক্রি করা যাবে। তাতে অন্তত কেনা দামটুকু উঠে আসবে।
বাকিদের ধারণা আবার উল্টো। কারণ, তাঁরা অল্প ক্ষতি সয়েও আরও বেশি ঝুঁকি এড়ানোর নীতিতে বিশ্বাসী। তাই এঁরা ভাবেন, এর পর যদি শেয়ারের দাম আরও পড়ে? তার থেকে বরং অল্পস্বল্প ক্ষতি হলেও, তা এখনই বেচে দেওয়া ভাল। নইলে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়ার সম্ভাবনা। আমার মতে, স্রেফ আন্দাজে ভর করে এই দুই সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামি। কেন? আসুন, সহজ করে বুঝি। |
|
রাখার জন্যই রেখে লাভ?
যাঁরা মনে করছেন, অন্তত কেনা দামটুকু উসুল করতে দর পড়ে যাওয়া শেয়ার ধরেই রেখে দেবেন, তাঁরা নীচের বিষয়গুলি মাথায় রাখুন
• শেয়ার বাজার দীর্ঘ মেয়াদি লগ্নির জায়গা ঠিকই। কিন্তু তা বলে হাতের শেয়ার অনন্তকাল ধরে রাখা বোকামি। সুতরাং মুনাফা হলে ভাল। নইলে উচিত সব থেকে কম লোকসানে তা বিক্রি করে বেরিয়ে যাওয়া।
• মনে করুন, ২০১২ সালে ১০০ টাকায় ‘ক’ সংস্থার একটি শেয়ার কিনেছিলেন। এখন তার দর কেনা দামের থেকেও কমে যাওয়ায় তা পড়ে রয়েছে আপনার কাছে। দেখা গেল, ২০১৪ সালে তার দর ১০০ টাকার সামান্য উপরে উঠল (ধরুন, ১০২ টাকা)। তাই তখন ওই শেয়ার বিক্রি করে লোকসান এড়ালেন আপনি।
কিন্তু সত্যিই লোকসান এড়ালেন কি? ব্যাঙ্কের সেভিংস অ্যাকাউন্টে টাকা রাখলেও তো তার উপর ৪-৬ শতাংশ সুদ পেতেন আপনি। স্থায়ী আমানতে পেতেন আরও বেশি। ফলে সেই হিসেবে আখেরে ‘ক্ষতি’ই হল। কারণ, শেয়ারে না-ঢেলে ওই টাকা নিছক ব্যাঙ্কে ফেলে রাখলেও তা এর থেকে লাভজনক হত আপনার পক্ষে। কিংবা হয়তো দেখা যাবে, দর ৯৮ টাকা থাকাকালীন ওই শেয়ার বেচে সেই টাকায় অন্য শেয়ার কিনলে, সুযোগ ছিল অনেক বেশি রিটার্ন পাওয়ার। সব থেকে বড় কথা, ব্যাঙ্ক-সুদের থেকে বেশি রিটার্ন যদি না-ই পেলেন, তা হলে আর অযথা ঝুঁকি বইবেন কেন?
• অনেক সময়ে দেখেছি, হাতে থাকা শেয়ারের সঙ্গে আবেগের সম্পর্ক তৈরি করে ফেলেন লগ্নিকারী। হয়তো বিস্তর খেটে অনেক তথ্য নাড়াচাড়ার পর তবে ওই সংস্থার শেয়ার কিনেছেন তিনি। কিংবা তাঁর অগাধ আস্থা রয়েছে ওই সংস্থার উপর। সাধারণত এই সমস্ত ক্ষেত্রেই কোনও শেয়ারের প্রতি এমন ‘অহেতুক’ দুর্বলতা জন্মায়। কিন্তু আমার মতে এটা মারাত্মক ভুল।
দেখুন, শেয়ার বাজারে কারও সব সিদ্ধান্ত সঠিক হবে, এমনটা আশা করা অন্যায়। আপনি-আমি কোন ছার, দুনিয়ার সেরা বিশেষজ্ঞদেরও তা হয় না। সুতরাং কোনও ডুবে যাওয়া শেয়ারকে অযথা ‘প্রেস্টিজ ইস্যু’ বানাবেন না। বরং মন থেকে মেনে নিন যে, তা বাছাইয়ে ভুল হয়েছিল। সংস্থার ভবিষ্যত্ পড়তে ভুল করেছিলেন আপনি। দেখবেন, তা হলে ওই শেয়ার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। যুক্তিকে ছাপিয়ে আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার জায়গা অন্তত শেয়ার বাজার নয়।
তা হলে করণীয়?
আপনার হাতে থাকা কোন শেয়ারগুলির অবস্থা শোচনীয়, প্রথমে তা বেছে ফেলুন। এখন দাম তলানিতে মানেই যে পরে তা উঠবে না, এমনটা আদৌ নয়। কিন্তু দেখা দরকার, যে-মেয়াদের কথা আপনি ভাবছেন, সত্যিই তার মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি ওই শেয়ারের আছে কি না। এর আঁচ পেতে নীচের প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজুন
• সংস্থার শেয়ারের এই পতন কি সাময়িক (ধরা যাক মন্দার জন্য)? না কি সংস্থার অসুখ আরও গভীরে?
• সংস্থার আর্থিক ফলাফল কেমন?
• ফলাফল যদি ভাল না-হয়, তা কি শুধু সংস্থার? না কি সামগ্রিক ভাবেই ফল খারাপ হচ্ছে ওই শিল্পের?
ধরুন, কোনও গাড়ি সংস্থার শেয়ার আছে আপনার কাছে। সে ক্ষেত্রে দেখুন খারাপ ফল কি শুধু ওই সংস্থাই করছে? না কি একই হাল পুরো গাড়ি শিল্পেরই?
• সংস্থা এবং ওই শিল্পের আগামী দিনে ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কতটা?
• সংস্থা পরিচালনা কতটা শক্তিশালী? কঠিন পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর রেকর্ড তাঁদের আছে কি?
পরামর্শ নিলেও বুঝুন
উপরের সব প্রশ্নের উত্তর যে আপনি নিজেই খুঁজে পাবেন, এমনটা না-ও হতে পারে। সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ/ ব্রোকারের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাঁর কথায় অন্ধ ভাবে বিশ্বাস করবেন না। বরং নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, পরামর্শদাতার যুক্তির সঙ্গে আপনি একমত কি না। সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে নিজের চিন্তায় একশো শতাংশ বিশ্বাস থাকা একান্ত জরুরি।
সজাগ থাকুন
ধরুন, রিটার্ন একেবারেই মনোমতো নয়, এমন কিছু শেয়ার বাছাই করে বেচে দিলেন আপনি। ভাবলেন, এ বার বোধ হয় গেরো কাটল। এটা কিন্তু মস্ত ভুল। সব শেয়ারের দরই নাগরদোলার মতো ওঠে-নামে। আর্থিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুযায়ী শেয়ার দরের মাপকাঠিতে প্রায়ই বদলে যায় ‘ভাল’-‘খারাপ’ শেয়ারের সংজ্ঞা। তাই হাতে থাকা শেয়ারের ভাল-মন্দ বুঝতে সব সময়ে তাদের দিকে সতর্ক নজর রাখুন।
কোনও সংস্থার শেয়ার হাতে থাকা মানে কিন্তু আপনি তার অংশীদার। আপনার রিটার্নও নির্ভর করবে তার ভাল-মন্দের উপরেই। তাই ‘নিজের’ সংস্থার উপর নিয়মিত নজর রাখুন।
প্রতি তিন মাসে অন্তত এক বার হাতে থাকা শেয়ারের হাল খতিয়ে দেখুন। বাছাই করুন ভাল-খারাপ। কথা বলতে পারেন ব্রোকারের সঙ্গেও।
তবে কি ব্যাঙ্কই ভাল?
বাজারের টালমাটাল সময়ে অনেকেই প্রশ্ন করেন, তবে কি শেয়ার কেনাই ভুল হয়েছিল? জানতে চান, শেয়ারে অযথা ঝুঁকি নেওয়ার বদলে ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে (ফিক্সড ডিপোজিট) লগ্নিই বুদ্ধিমানের কাজ কি না? এমনকী হালফিলে অনেককে হতাশ হয়ে বাজারের পাট চুকিয়ে ব্যাঙ্কে টাকা রাখতেও দেখছি আমি।
কিন্তু আমার মতে, এটা একেবারেই আবেগের সিদ্ধান্ত। যুক্তির নয়। এ বার বাজার আপনাকে হতাশ করেছে ঠিকই। কিন্তু সাধারণত তার রিটার্ন ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরের তুলনায় বেশ খানিকটা বেশি। তাই একটু ঝুঁকি নিয়েও কিছু টাকা বাজারে (কিংবা অন্ততপক্ষে মিউচুয়াল ফান্ডে) ঢালতেই হবে। নইলে জিনিসপত্রের দাম যে-হারে বাড়ছে, শুধু ব্যাঙ্ক কিংবা ডাকঘরের সুদকে হাতিয়ার করে তার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া শক্ত। তাই ছেলে-মেয়ের পড়াশোনা (বিশেষত উচ্চশিক্ষা), বিয়ে-থা ইত্যাদির মোটা খরচ জোগাড়ের জন্য বাজার বা নিদেনপক্ষে ফান্ডে টাকা ঢালার ঝুঁকি নিতেই হবে আপনাকে।
আজকাল অবশ্য চড়া রিটার্নের আশায় রিয়েল এস্টেটের ঘোড়াতেও সওয়ার হচ্ছেন অনেকে। লগ্নি করছেন জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটে। গত পাঁচ-সাত বছরে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দর যে-ভাবে বেড়েছে, তাতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত খুব স্বাভাবিক।
কিন্তু আমার মতে, এই লগ্নি কখনওই শেয়ার বাজারের বিকল্প নয়। কারণ, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দর ইতিমধ্যেই যেখানে পৌঁছেছে, তাতে শুধুমাত্র সম্পদ তৈরির জন্য একখানা ফ্ল্যাট কিনে ফেলা সকলের কম্ম নয়। তা ছাড়া, আমাদের দেশে বাড়ি কেনা-বেচার পুরো প্রক্রিয়াটাই এখনও বেশ অস্পষ্ট। অসংগঠিত এর বাজারও। ফলে যে- পরিমাণ টাকা উপুড় করে আপনি বাড়ি কিনছেন, দাম হিসেবে তা সঠিক কি না, তা যাচাই করা শক্ত। বোঝা কঠিন, লগ্নি হিসেবে আদৌ তা ভাল কি না।
আশার আলো
এত কিছু বলার পর স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তা হলে বাজারের এই ‘দুঃসময়ে’ কোন ধরনের শেয়ারের উপর ভরসা করব আমি? বাজার পড়ার সময়েও আমাকে মুনাফার সন্ধান দেবে কোন শেয়ার?
এখানে নির্দিষ্ট করে কোনও সংস্থার শেয়ারের নাম আমি করতে চাই না। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখুন, সব শেয়ারের দর কিন্তু একসঙ্গে তলিয়ে যাচ্ছে না। এই দোলাচলের বাজারেও প্রায় নিয়মিত ভাল রিটার্ন জুগিয়ে যাচ্ছে কিছু শেয়ার। যেমন, অধিকাংশ ওষুধ সংস্থা, হাসপাতাল গোষ্ঠীর শেয়ারের হাল তেমন হতাশাজনক নয়। আসলে অর্থনীতির ওঠা-পড়ার সঙ্গে তাদের তেমন সম্পর্ক নেই। ভাল ফল করছে ভোগ্যপণ্য সংস্থাগুলিও। ডলারের দর চড়া থাকায় মুনাফা ফুলেফেঁপে উঠছে তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির। খারাপ করছে না বিদ্যুত্, সংবাদমাধ্যমের (মিডিয়া) ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সংস্থাগুলিও। অন্তত ব্যাঙ্ক কিংবা গাড়ি-সিমেন্ট-আবাসন-টেলিকম-পরিকাঠামো নির্মাণ সংস্থাগুলির তুলনায় তাদের দশা ঢের ভাল।
তাই আমার পরামর্শ হল, এই চড়াই-উতরাইয়ের বাজারে মুনাফা খুঁজতে সম্ভাবনাময় ব্যবসাগুলির দিকে নজর রাখুন। মনে রাখবেন, এই বাজারে লাভের মুখ দেখার আসল শর্ত, সঠিক সময়ে শেয়ার কেনা ও বেচার ক্ষমতা। তাই এখন যে-সংস্থাগুলির ফল ভাল হচ্ছে, চোখ বুজে তাদের শেয়ার কিনে ফেলা কোনও কাজের কথা নয়। বরং ভাবুন, আগামী দিনেও এর মধ্যে টগবগে টাট্টু থাকবে কারা? কেনই বা তারা দীর্ঘ মেয়াদে ভাল রিটার্ন দেওয়ার ক্ষমতা রাখে?
এই সমস্ত বিষয়ে স্পষ্ট উত্তর পেলে তবেই সেই শেয়ারে লগ্নি করুন।
তা হলে নতুন লগ্নি?
হাতের শেয়ার বদলে এই টালমাটাল বাজারেও কী ভাবে মুনাফার মুখ দেখা যেতে পারে, তা নিয়ে এতক্ষণ বিস্তর আলোচনা করলাম আমরা। কিন্তু আর একটা প্রশ্নের সামনেও এখন প্রায়ই পড়তে হচ্ছে। অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, এই বাজারে কি আদৌ নতুন কারও পা রাখা উচিত? পুরনো খেলোয়াড়রাই যেখানে তল পেতে নাজেহাল, সেখানে আনকোরা কারও মুখ থুবড়ে পড়া তো সময়ের অপেক্ষা?
আমার উত্তর হল, বাজারে উত্থান-পতন থাকবেই। দেশের অর্থনীতির কোনও একটা খবরে, বিদেশে যুদ্ধ বাধলে, তেলের দরের ওঠা-পড়ায়, সত্যি বলতে কী, এমন হাজারো খবরে হয়তো এক লহমায় বদলে যাবে বাজারের চালচিত্র। কিন্তু তা বলে অনন্তকাল শেয়ার থেকে হাত গুটিয়ে থাকলে চলবে কেন? লগ্নির তরী ভাসাতে হবে এই ঝড়ঝঞ্ঝার আবহাওয়াতেও। তবে হ্যাঁ, পা ফেলতে হবে সাবধানে। সে ক্ষেত্রে মাথায় রাখুন অন্তত নীচের বিষয়গুলি
ব্রোকিং সংস্থা বাছাইয়ে যত্ন নিন
• যে ব্রোকিং সংস্থা মারফত বাজারে লগ্নি করবেন, টাকা দেওয়ার আগে তার সম্পর্কে খুঁটিয়ে খবর নিন।
• লগ্নিকারীদের টাকা যে দিশাহীন ভাবে বিনিয়োগ করা হবে না, তার নিশ্চয়তা তাদের তরফে আছে কি?
• জানতে চেষ্টা করুন, তাদের লগ্নির কৌশল। জিজ্ঞাসা করুন, টাকা ঢালার আগে সংস্থা সম্পর্কে সত্যিই কতখানি গবেষণা করে তারা?
• জেনে নিন, কত ধরনের শিল্পে কতগুলি সংস্থায় লগ্নি ছড়িয়ে দেয় তারা। মনে রাখবেন, লগ্নি যত ছড়ানো-ছেটানো, সাধারণত ঝুঁকি তত কম।
• ব্রোকিং সংস্থার কয়েক জন উচ্চপদস্থ কর্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করুন। তাঁদের ফোন নম্বর, ই-মেল নিয়ে রাখতে ভুলবেন না। যাতে ডিলারের সঙ্গে কোনও সমস্যা হলে, তা সরাসরি তাঁদের জানানো যায়।
ডিলারকে চিনুন
• যিনি আপনার হয়ে বাজারে টাকা লাগাবেন, অবশ্যই তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনুন।
• তাঁরও স্পষ্ট জানা উচিত, কখন ঠিক কতটা ঝুঁকি নিতে স্বচ্ছন্দ আপনি।
• ডিলারের উচিত আপনার জন্য শেয়ার কিনতে সব সময়ে সঠিক সুযোগের সন্ধানে থাকা। তক্কে তক্কে থাকা সুযোগ বুঝে তা বিক্রির জন্যও। মুনাফা হলে তো কথাই নেই। লোকসান হলেও তা যথাসম্ভব কম হওয়া জরুরি। ‘স্টপ-লস’ এ ক্ষেত্রে ভাল পদ্ধতি হতে পারে। মনে করুন, আপনি ১০ টাকায় একটি শেয়ার কিনছেন। কেনার সময়েই তাতে ৮ টাকায় স্টপ-লস লাগিয়ে রাখলেন। সে ক্ষেত্রে শেয়ারের দাম ৮ টাকায় নামলে তা বিক্রির সিদ্ধান্ত আপনিই নেওয়া হয়ে যাবে। তার থেকেও বেশি ক্ষতির ঝুঁকি আপনাকে বইতে হবে না।
একই ভাবে সুবিধা নিতে পারেন ‘বুক প্রফিটস’-এরও। ১০ টাকা দরে কেনা শেয়ারে ১২ টাকায় বুক প্রফিটস লাগিয়ে রাখার অর্থ দাম ১২ ছুঁলেই ওই শেয়ার বিক্রি করা। হতেই পারে যে আপনি ওই শেয়ারে ২০% লাভ পেলেই খুশি। তাই তার বেশি মুনাফা পেতে অযথা ঝুঁকি নিতে রাজি নন। সে ক্ষেত্রে ডিলারের উচিত ১২ টাকায় ওই বুক প্রফিটস ব্যবহার করা। |
|
নিজের ধারণা স্বচ্ছ তো?
• ডিলার কোনও শেয়ার কেনার পরামর্শ দিলে, তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করুন। জানতে চান, কোন যুক্তিতে ওই শেয়ারে টাকা লাগানো সঠিক বলে মনে করছেন তিনি।
• বাজার যখন এমনিতেই চাঙ্গা, তখন তবুও খারাপ শেয়ার কিনে পার পাওয়া যায়। কিন্তু পড়তি কিংবা এখনকার মতো টালমাটাল বাজারে সেই সম্ভাবনা প্রায় নেই। তাই বাড়তি সতর্কতা জরুরি। আপনার ডিলারের তা আছে তো?
• ইন্টারনেট তো তথ্যের খনি। তাই যে-সংস্থার শেয়ার কিনবেন বলে মনস্থির করছেন, তার সম্পর্কে তথ্য বা পরিসংখ্যান পেতে শুধু ব্রোকারের উপর নির্ভর করবেন কেন? নিজে সংস্থার ওয়েবসাইটে গিয়ে আর্থিক রিপোর্ট ঘাঁটুন। দেখুন, তার সাম্প্রতিক অবস্থা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন। সংস্থার ব্যালান্স শিট দেখতে ঢুঁ মারতে পারেন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (এনএসই) কিংবা বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের (বিএসই) ওয়েবসাইটেও।
• তথ্য আর পরামর্শের মধ্যে ফারাক করুন। ধরুন, আমি আপনাকে বললাম যে, গত বছরে ‘ক’ সংস্থার মুনাফা ১০০ কোটি টাকা। তারা ৫% ডিভিডেন্ড দিয়েছিল। কলকাতার বাইরে দেশের অন্য তিন শহরে নতুন কারখানা গড়ছে তারা। কিংবা একটি নতুন পণ্য বাজারে আনতে চলেছে আগামী মাসেই। এগুলি হল নিখাদ তথ্য।
কিন্তু সেই আমিই যদি বলি যে, আপনার উচিত ‘ক’ সংস্থার শেয়ার কেনা, তা হলে কিন্তু তা পরামর্শ। আমার মতে, পরামর্শ নেওয়ার আগে-পরে দশ বার ভাবুন। কিন্তু তথ্য সংগ্রহে কোনও দোষ নেই। শুধু খেয়াল রাখতে হবে তা যেন সঠিক হয়।
• শেয়ার বাছার আগে কয়েকটা অঙ্কও ঝালিয়ে নেওয়া ভাল। যেমন
(১) আর্নিংস পার শেয়ার
(২) প্রাইস টু আর্নিং রেশিও (পি/ই রেশিও)
(৩) প্রাইস টু বুক ভ্যালু রেশিও
(৪) ইন্টারেস্ট কভারেজ রেশিও
(৫) বিটা
এই পাঁচ বিষয় সম্পর্কে বিশদে জানতে www.anandabazar.com ওয়েবসাইটে গিয়ে গত ২১ ফেব্রুয়ারির বিষয়-আশয় দেখতে পারেন।
সুতরাং...
বাজারে ষাঁড় বনাম ভল্লুকের লড়াই চলবেই। কৌশলে তার মধ্যে থেকেই মুনাফা ছিনিয়ে নিতে হবে আপনাকে। এতক্ষণ ধরে যা আলোচনা করলাম, তা মাথায় রাখলে, তাতে অন্তত কিছুটা সুবিধা হবে বলেই আমার বিশ্বাস।
|
সাবধানের মার নেই |
• গুজবে কান দেবেন না।
• উপযুক্ত কারণ ছাড়া কোনও অনামী শেয়ার হঠাত্ চড়তে থাকলে, তা না-কেনাই ভাল।
• সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে লগ্নির ঝুঁকি কখনওই নয়।
• খুব বিশ্বস্ত না-হলে, কাউকে (ব্যক্তি বা সংস্থা) পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি না-দেওয়াই উচিত।
• শুধু অতীত দেখে কোনও শেয়ারের ভবিষ্যত্ আঁচ না-করাই ভাল। |
লাভের মন্ত্র |
• শেয়ার বাজার দীর্ঘ মেয়াদি লগ্নির জায়গা। রাতারাতি বড়লোক হওয়ার রাস্তা এখানে না খোঁজাই ভাল।
• যত্ন নিয়ে ব্রোকিং সংস্থা বাছুন। ভাল ভাবে চিনুন ডিলার/ ব্রোকারকে। একই ভাবে তাঁরও উচিত আপনাকে ভাল ভাবে জানা। বুঝে নেওয়া, কতটা ঝুঁকি নিতে স্বচ্ছন্দ আপনি।
• ব্রোকারকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবেন না। বরং তাঁকে প্রশ্ন করুন। জানতে চান, কেন কোনও শেয়ার কেনা/ বিক্রির পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি।
• মনে রাখুন স্টপ-লসের কথা।
• যে-সংস্থার শেয়ার কিনছেন, সেটি সম্পর্কে নিয়মিত খবর নিন। নজর রাখুন তার অ্যানুয়াল রিপোর্ট এবং ত্রৈমাসিক ফলাফলের উপর।
• প্রতি তিন মাসে অন্তত এক বার খতিয়ে দেখুন, আপনার হাতের শেয়ার ঠিক কেমন অবস্থায় রয়েছে।
• লেনদেনের পর পাওয়া চুক্তিপত্র বা কনট্র্যাক্ট নোট খুঁটিয়ে দেখুন। মিলিয়ে নিন, আপনাকে ফোনে বলা দরেই ব্রোকার শেয়ার কেনা-বেচা করেছেন কি না।
• নিয়মিত সংগ্রহ করুন ডি-ম্যাট অ্যাকাউন্টের স্টেটমেন্ট। |
|
লেখক: রেলিগেয়ার ম্যাকুয়ারির অ্যাসোসিয়েট ভাইস প্রেসিডেন্ট (মতামত ব্যক্তিগত) |
|
|
|
|
|