|
|
|
|
বনধকে টেক্কা দিল কার্ফু, মোকাবিলায় নামছে রাজ্য
|
রেজা প্রধান • দার্জিলিং
অনির্বাণ রায় • কার্শিয়াং |
বনধ উঠলেও, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা জনতা-কার্ফুর জেরে মঙ্গলবারও দার্জিলিং পাহাড়ের জনজীবন স্তব্ধ রইল। দশ দিন একটানা অচলাবস্থার ফলে এক দিকে তীব্র খাদ্য সঙ্কট, অন্য দিকে থমকে-যাওয়া পরিবহণ এই দুই বিপর্যয় কাটাতে কাল থেকে সক্রিয় হবে রাজ্য প্রশাসন। আজ শিলিগুড়িতে স্বরাষ্ট্রসচিব এবং তিন মন্ত্রী বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেন, বুধবার ১৫টি বাস চালানো হবে। প্রায় সব রুটেই বাস চলবে। রেশনের পণ্য সরবরাহ করা হবে ১১টি এলাকা থেকে। সরকারি দরে চাল, গম, চিনি পাওয়া যাবে রেশন কার্ড দেখালে।
বস্তুত মঙ্গলবার পাহাড়ের ছবিটা ছিল যে কোনও বন্ধের চেয়েও বেশি উদ্বেগজনক। কারণ, ২৪ ঘণ্টা আগেও যে চকবাজার ছিল স্লোগান, বিক্ষোভে মুখর, রাতারাতি তা যেন ঘুমিয়ে পড়েছে। বেলা ১০টায় জায়গাটা জনমানবহীন। গা ছমছম করে ওঠে। রোপওয়ের দিকে যেতে সিংমারিতে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার অফিসের সামনেও কেউ নেই। কার্শিয়াঙের বাস স্ট্যান্ড, কালিম্পঙের ডম্বর চক সর্বত্রই সুনসান। রাস্তায় পুলিশ-প্রশাসনের গাড়িই চলছে বেশি। মোর্চার জনতা-কার্ফুর ফতোয়ায় খোলসে ঢুকে থাকল দার্জিলিঙের জনজীবন!
গোর্খাল্যান্ডের দাবিতে এক টানা বন্ধের দাপটে পাহাড়ের তিন মহকুমায় চাল, ডাল, তেল, নুন, আলু, পেঁয়াজের আকাল দেখা দিয়েছে। চরম খাদ্য সঙ্কটে পড়ে কোথাও রাস্তার ধারে ঝুলে-থাকা স্কোয়াশের ডাঁটা নিয়ে চলছে কাড়াকাড়ি। কোথাও মোর্চার নজরদারি এড়িয়ে চুপিসাড়ে পাড়ার দোকানের পাল্লা খুলিয়ে একটু চাল-আলুর জন্য পীড়াপীড়ি করছেন মানুষ। আবার কোথাও লুকিয়ে রেশন ডিলারের বাড়ির কাছে গিয়ে কয়েক কিলোগ্রাম চাল নিয়ে সন্তর্পণে ফিরতে দেখা যাচ্ছে তাঁদের। সব মিলিয়ে পাহাড়ের নানা বসতি এলাকায় খাদ্য সঙ্কট যে চরমে পৌঁছেছে তা দলমত নির্বিশেষে পাহাড়ের প্রায় সকলেই স্বীকার করছেন। এমনকী, কয়েক জন মোর্চা নেতাও ফিসফিস করে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ঘরেও খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। |
|
কার্শিয়াঙে জনতা কার্ফুর সমর্থনে মোর্চার পোস্টার। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক |
স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন দার্জিলিঙে গিয়ে সরেজমিনে পরিস্থিতি দেখেছেন। সেখানে জেলা পুলিশ-প্রশাসনের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে শিলিগুড়িতে ফিরে সন্ধ্যায় উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবের দফতরে গিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে বসে পরিস্থিতি পর্যলোচনা করেন। সেই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকও। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বুধবার থেকে পাহাড়ে চাল-গম-চিনি বিলি করবে রাজ্য সরকার।
গৌতমবাবু বলেন, “বহু মানুষ খাবার না পেয়ে চরম সঙ্কটে পড়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছেও নানা মহল থেকে খাবার ফুরিয়ে যাওয়ার বার্তা গিয়েছে। মধ্যবিত্ত ও গরিবদের খাবার মজুত করার সাধ্য নেই। তাঁদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সে জন্যই বুধবার থেকে পাহাড়ের ১১টি জায়গার সরকারি অফিস লাগোয়া এলাকা থেকে রেশনের পণ্য সরবরাহ করা হবে।” মন্ত্রী জানান, গাড়িধুরা, পানিঘাটা, রোহিণী, মিরিক, সুখিয়াপোখরি, সৌরিণী, বিজনবাড়ি, পেডং, গরুবাথান এবং আলগাড়া থেকে রেশন বিলি হবে।
জ্যোতিপ্রিয়বাবু জানান, মাওবাদীরা জঙ্গলমহলেও রেশন দোকান বন্ধ করে দিয়েছিল। সেখানে এই ভাবে থানা-লাগোয়া জায়গা থেকে রেশন বিলি করা হতো। তাতে বাসিন্দারা সাড়া দিয়েছিলেন।
মঙ্গলবার সরকারি অফিস, আদালত খুলেছে। তবে হাতে গোনা কয়েক জন শীর্ষ অফিসার ছাড়া সাধারণ কর্মীদের দেখা মেলেনি। সরকার অবশ্য এ নিয়ে কড়া মনোভাব নিচ্ছে। মহাকরণে মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র জানিয়েছেন, সরকারি কর্মীরা অফিসে না এলে বেতন কাটা হবে।
সাধারণত, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি চূড়ান্ত অবনতি হলে সরকার কার্ফু বলবৎ করে। জনতা কার্ফ’ বলে মোর্চা পাহাড়ে যা করছে, তা বেআইনি কিনা, সেই প্রশ্নও উঠেছে। স্বরাষ্ট্রসচিব বলেন, “কোনও শব্দ যে কেউ ব্যবহার করতে পারেন। তবে পাহাড়ে যা পরিস্থিতি, তাতে জনতা কার্ফু বলে বন্ধ-ই করা হচ্ছে। হাইকোর্টে এবং রাজ্য সরকারের কাছে এ ব্যাপারে রিপোর্ট দেব।”
মোর্চা সভাপতি বিমল গুরুঙ্গ এ দিন বাড়ি থেকে বার হননি। দলের সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি বলেছেন, “আমরা তো জবরদস্তি করিনি। মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সাড়া দিয়ে জনতা-কার্ফু সফল করেছে। পাহাড়ের মানুষ কী চান, সেটা আশা করি রাজ্য সরকারকে বোঝানো গিয়েছে।” তাঁর দাবি, পাহাড়ের মানুষ অনটন সহ্য করতে রাজি।
কিন্তু সাধারণ মানুষের অনেকেরই গলায় শোনা গেল হতাশার সুর। তাঁদের মন্তব্য, “এ তো বন্ধের চেয়েও বেশি। ঘর থেকে বার হওয়া যাবে না। এ ভাবে কার্ফু জারি করা যায় নাকি!” তবে শহরের প্রধান রাস্তাগুলো সুনসান থাকলেও, গ্রামের মধ্যে ঢুকে দেখা গেল অনেকেই গুটিগুটি পায়ে এ দিক-সে দিক রয়েছেন। কেউ পাড়ার দোকানের পাল্লা অল্প ফাঁক করে চাল, আনাজ কিনছেন। |
|
শাকপাতা সংগ্রহ করে বাড়ির পথে। কার্শিয়াং স্টেশন এলাকায় বিশ্বরূপ বসাকের তোলা ছবি। |
সুকনা পার হয়ে পাহাড়ি পাকদণ্ডি পথে রোহিণীর চিকোপানি গ্রাম। বাড়ির পেছনে সার দিয়ে সবুজ খেত। কচি ধানের পরিচর্যায় ব্যস্ত জনা পাঁচেক বাসিন্দা। এলাকার বাসিন্দা রবিন থাপা বললেন, “ঘরে খাবার বাড়ন্ত। খেতের স্কোয়াশ, কচি ভুট্টা খাচ্ছি। কাজ না-করে বাড়িতে বসে থাকলে পেট চলবে না।”
দুপুর দুটো নাগাদ রোহিণীতে দেখা গেল উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার দু’টি বাসকে পুলিশ পাহারায় দার্জিলিঙে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সব মিলিয়ে যাত্রী ১০ জন। বেশির ভাগই কার্শিয়াং পর্যন্ত যাবেন। বাসে ছিলেন বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের দুই বাসিন্দা সুব্রত সাহা এবং সাগর সাহা। এমবিএ-র ছাত্র সুব্রতবাবু এবং ব্যবসায়ী সাগরবাবু দার্জিলিঙে ঘুরতে যাচ্ছেন। গত সোমবার শিলিগুড়ি গিয়ে সে দিনই রওনা দেওয়ার কথা থাকলেও, বন্ধের জন্য যেতে পারেননি। সুব্রতবাবু বলেন, “পুলিশ অফিসারেরা বললেন, যেতে কোনও সমস্যা হবে না। দার্জিলিঙের একটি হোটেলও আশ্বাস দিয়েছে। তাই যাচ্ছি।” সাগরবাবুর আশা, আর বন্ধ হবে না।
ফেসবুক বার্তায় গুরুঙ্গ অবশ্য এ দিনই বলেছেন, “১৯ অগস্ট থেকে আন্দোলন জারি থাকবে। তা হবে স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশের মাধ্যমে। ১৬ অগস্ট বৈঠকের পরে কর্মসূচি ঘোষণা করব।”
|
পুরনো খবর: জিটিএ প্রধানের পদ নিয়েও সক্রিয় মোর্চা |
|
|
|
|
|