হাজারো হুঁশিয়ারির পরে আরও এক প্রস্ত হুঁশিয়ারি রাজ্য সরকারের! পুরনো সুরেই। কিন্তু গাড়িতে লাল বাতির অবৈধ ব্যবহার তাতে কতটা নিয়ন্ত্রিত হবে, সংশয় থেকেই যাচ্ছে। অতীতের ব্যর্থতাই সেই সংশয়ের মূল কারণ।
সরকারি গাড়িতে লাল বাতির যথেচ্ছ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে বারবার নির্দেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট। সেই নির্দেশ হাতে পেয়ে অতীতের বাম থেকে এখনকার তৃণমূল সরকার বারবার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। কাদের গাড়িতে লাল বাতি থাকতে পারে, তা জানিয়ে বিভিন্ন সময় সরকারের তরফে জারি করা হয়েছে বিজ্ঞপ্তিও। কিন্তু ওই পর্যন্তই! এ রাজ্যে সরকারের বড়-মেজো-ছোট আমলা থেকে পুরসভা-জেলা পরিষদের আধিকারিক পর্যন্ত সকলেই নিজেদের গাড়িতে দেদার লাল বাতি ব্যবহার করে চলেছেন। তাঁদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছেন নানা স্তরের জনপ্রতিনিধিরাও।
এ-সব দেখে সরকারের সর্বোচ্চ কর্তারা কড়া পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করেন। তা শুনে পুলিশ একটু নড়েচড়েও বসে। তার পর আবার যে-কে-সেই! লাল বাতি আর তার হাত ধরে হুটার ব্যবহারের সেই ট্র্যাডিশন চলতেই থাকে। এই অবস্থায় সোমবার ফের একই রকম হুঁশিয়ারি দিলেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। বললেন, “বেআইনি লাল বাতি আর হুটার ব্যবহারের রমরমা রুখতে পথে নামবে রাজ্য সরকার।”কী করতে চায় সরকার?
মদনবাবুর জবাব, “আদালতের নির্দেশ মেনে লাল বাতি ও হুটার লাগিয়ে অবাধে চলার ক্ষেত্রে কঠোর হবে রাজ্য সরকার। যাঁরা বেআইনি ভাবে লাল বাতি ব্যবহার করছেন, তাঁদের অন্তত পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করার কথাও ভাবা হচ্ছে।”
ক্ষমতায় আসার ২৭ মাস পরে তৃণমূল সরকারের এই ভাবনা কেন?
মন্ত্রীর যুক্তি, “যে-রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হুটার ব্যবহার করেন না, সেখানে যে-কেউ এ ভাবে লাল বাতি বা হুটার ব্যবহার করেন কী ভাবে! আমি তো কাল থেকেই রাস্তায় হুটার এবং লাল বাতি ব্যবহার করব না।”
এত দিন ব্যবহার করেছেন কেন?
মন্ত্রীর স্বীকারোক্তি, “আমার একটু দেরিতেই বোধোদয় হয়। কিন্তু হয়।”
মন্ত্রিসভায় আপনার সহকর্মীদেরও কি গাড়িতে লাল বাতি ও হুটার বর্জনের পরামর্শ দেবেন?
মদনবাবুর উত্তর, “এখনই কিছু বলছি না।”
পরিবহণমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে রাজ্যের অন্য এক মন্ত্রীর কটাক্ষ, “আগে তো পুরসভার মেয়র-পারিষদদের গাড়ি থেকে লাল বাতি খুলে দেখাক!” |
তবে পরিবহণমন্ত্রী দাবি, রাজ্য সরকার যথেষ্ট কড়া হবে। তিনি বলেন, “আমরা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশিকা চেয়ে পাঠিয়েছি। কারা লাল বাতি ও হুটার ব্যবহার করতে পারবেন, সেই নির্দেশিকার ভিত্তিতে তার তালিকা তৈরি করা হবে। সেটি মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পরে নির্দেশ বলবৎ করা হবে।” মন্ত্রীর বক্তব্য, যাঁরা গাড়িতে হুটার ব্যবহার করার অধিকারী, তাঁরাও অনেক ক্ষেত্রে নিয়ম মানেন না। প্রয়োজনের বাইরে গিয়ে তাঁদের গাড়ি হুটার বাজায়। অনেক ক্ষেত্রে অযথা হুটার বাজায় অ্যাম্বুল্যান্সও। “এটা চলতে দেওয়া যায় না,” মন্তব্য মন্ত্রীর।
বেআইনি ভাবে লাল বাতি ও হুটার ব্যবহারের পুরনো রোগ সারাতে কলকাতা হাইকোর্টের শেষ নির্দেশটি ছিল ২০০৭ সালে। তার ভিত্তিতে ওই বছরের ৭ সেপ্টেম্বর মহাকরণ থেকে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছিল। তাতে ৪০ ধরনের পদাধিকারীর ক্ষেত্রে লাল বাতির গাড়ি ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু হুটার ব্যবহারের ক্ষেত্রে তেমন কোনও সরকারি নির্দেশিকা নেই। সরকারের নির্দেশিকায় বলা ছিল, সরকারি কাজের সময়টুকু বাদে কোনও আধিকারিক লাল বাতি ব্যবহার করতে পারবেন না। বাকি সময় গাড়ির লাল বাতি ঢেকে রাখতে হবে, যাতে দূর থেকে তা দেখা না-যায়।
তার পরেও প্রায় চার বছর ক্ষমতায় ছিল বামফ্রন্ট সরকার। মহাকরণের হাতবদল হয় ২০১১ সালে। কিন্তু পুরনো ও নতুন সরকার সব আমলেই সেই নির্দেশের তোয়াক্কা না-করে অবাধে চলছে লাল বাতি ও হুটারের ব্যবহার। তাই পরিবহণমন্ত্রীর নতুন হুঁশিয়ারি আদৌ কাজে আসবে কি না, তা নিয়ে শুরুতেই সংশয়ে প্রশাসনের একাংশ।
বস্তুত, সরকারি গাড়ির বাতি থেকে লাল রংটাকেই বিসর্জন দিতে চাইছেন পরিবহণমন্ত্রী। কেন?
মদনবাবু বলেন, “লাল আলো খুব তীব্র। তাই আমরা ওই আলো পরিবর্তন করে হলুদ, সবুজ বা নীল করার কথাও ভাবছি।”
কিন্তু চাইলেই কি সরকারি গাড়ির বাতির রং পরিবর্তন করা যায়?
পরিবহণমন্ত্রীর পাল্টা প্রশ্ন, “কেন যাবে না? যায় না বলে তো কোনও কথা আমার জানা নেই।”
মদনবাবু এমনটা ভাবলেও সরকারের এক কর্তা জানান, লাল বাতির ব্যবহার নিয়ে আদালতের নির্দেশের পরে দিল্লি-সহ কয়েকটি রাজ্য অনেক ‘ভিআইপি’র গাড়িতে নীল ‘বেকন’ আলো লাগানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে আদালতের নির্দেশও মানা হচ্ছে, আবার সরকারের বিচারে ভিআইপি-দের (লাল বাতির তালিকার বাইরে থাকা) গাড়িতে আলো ব্যবহারের অনুমতিও দেওয়া যাচ্ছে।
এ রাজ্যে অ্যাম্বুল্যান্সে লালের পাশাপাশি নীল বেকন আলোও ব্যবহার করা হয়। প্রশ্ন উঠছে, সরকারি গাড়িতে নীল বাতি ব্যবহার করলে কি চিনতে অসুবিধে হবে?
পরিবহণ দফতরের এক কর্তার জবাব, “অ্যাম্বুল্যান্সে লাল বাতি থাকলে যদি অসুবিধে না-হয়, নীল রং থাকলেই বা কী অসুবিধে!”
|