অমর্ত্য সেন ও জগদীশ ভগবতীর মধ্যে বিতর্ক এই মেঘলা মরসুমে অনেক অলস আড্ডার খোরাক জোগাল। সেটা ভাল, কারণ তাতে অন্তত ‘আমরা আর ওরা’ বিতর্কের একঘেয়েমি থেকে খানিকটা মুক্তি পেলাম। আর ‘নারদ নারদ’ গোছের মনোরঞ্জন ছেড়ে একটু গভীরে গেলে সেন-ভগবতী বিতর্ক থেকে উন্নয়নের গন্তব্য ও পথ দুই নিয়েই ভাবনার অনেক খোরাকও পাওয়া যাবে ।
এই বিতর্কের অনেকগুলো দিক আছে, তার মধ্যে আমরা আজ প্রাথমিক শিক্ষার দিকে তাকাব। শিক্ষা যে গুরুত্বপূর্ণ, এবং যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষাকে সর্বজনীন করে তোলা প্রয়োজন, সে বিষয়ে সেন আর ভগবতী একমত। তাঁরা একমত যে শিক্ষার প্রসারে সরকারি ভূমিকা আবশ্যক। কিন্তু সেটা কোন পথে হবে, তা নিয়ে বিপুল মতপার্থক্য। তাঁদের দু’জনের দুই সদ্যপ্রকাশিত বই পড়লে সেই মতপার্থক্যের হদিশ পাওয়া যাবে। জঁ দ্রেজ-এর সঙ্গে অমর্ত্য সেন লিখেছেন ‘ইন্ডিয়া: অ্যান আনসার্টেন গ্লোরি’; আর অরবিন্দ পানাগড়িয়ার সঙ্গে ভগবতী লিখেছেন ‘ইন্ডিয়াজ ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ (মার্কিন সংস্করণে যার নাম ‘হোয়াই গ্রোথ ম্যাটারস’)।
অর্থনীতির জগতের এই দুই পথিকৃতের দেখানো আলাদা পথের পিছনে আছে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই ঘরানার দর্শন। জগদীশ ভগবতী মনে করেন, শিক্ষার প্রসারে প্রধান বাধা দারিদ্র, তাই সরকারের কাজ হল দরিদ্র অভিভাবকদের তাঁদের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্যে আর্থিক সহায়তা করা, তার পর বাকিটা তাঁদের ওপর এবং বেসরকারি স্কুলের ওপর ছেড়ে দেওয়া। বরং সরকার যদি অর্থনৈতিক বিকাশের দিকে মন দেয়, তা হলে আয়ের সঙ্গে কর সংগ্রহ বাড়বে যা শিক্ষাক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য করবে, আর শুধু তাই নয়, দরিদ্র মানুষের আয় বাড়লে তাঁদের দিক থেকে সন্তানদের শিক্ষার চাহিদাও বাড়বে। অমর্ত্য সেন মনে করেন, সরকারের কাজ হল সরকারি স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার প্রসার বেসরকারি স্কুল এবং দরিদ্র মানুষের নিজের বিবেচনার ওপর ছেড়ে দেওয়া যথেষ্ট নয়। তাঁর মতে, আর্থিক বিকাশের ফলে শিক্ষার প্রসার হবে বলে বসে থাকলে চলবে না। শিক্ষার প্রসারে মানবসম্পদ বৃদ্ধি হবে, যা আর্থিক বিকাশের জন্যে এক অতি-প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং ইতিহাসের শিক্ষা হল এই প্রক্রিয়ায় সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা আবশ্যক।
|
প্রশ্ন হল, সরকারের ভূমিকা নিয়ে এই তর্কের সমাধানেই কি প্রাথমিক শিক্ষার উন্নতির সূত্র রয়েছে, না কি এর উত্তর খুঁজতে গেলে আরও গভীরে যেতে হবে? প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে গত এক দশকে দেশে যে গবেষণা হয়েছে, সেগুলো কোন দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করছে? ‘প্রথম’ নামে একটি অসরকারি সংস্থা ভারতে প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিস্তর কাজ করেছে। তারা অ্যানুয়াল স্টেট অব এডুকেশন রিপোর্ট (ASER) নামে একটি সমীক্ষা প্রকাশ করে। সেই সমীক্ষা কার্যত সর্বজনমান্য। অমর্ত্য সেন এবং জগদীশ ভগবতী দুজনের বইয়েও এই রিপোর্টের উল্লেখ আছে। ২০১২ সালের সমীক্ষা থেকে যে মূল ছবি ফুটে উঠছে তাতে দেখা যাচ্ছে, গত এক-দেড় দশকে ভারতে স্কুলে ভর্তি হওয়ার হারে বিপুল উন্নতি ঘটেছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হওয়া এক সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সি ছেলেমেয়েদের মধ্যে ৮০ শতাংশ স্কুলের খাতায় নাম লিখিয়েছে। ২০১২ সালে এই হার দাঁড়িয়েছে ৯৬ শতাংশে।
কিন্তু সংখ্যা ছেড়ে যদি পড়াশোনার মানের দিকে তাকাই, ছবিটা অনেক ধূসর। বিভিন্ন সমীক্ষায় বারে বারেই একটা ছবি উঠে এসেছে। ১৯৯৬ সালে স্কুলে যখন একটি সমীক্ষার টিম গিয়েছে, তখনও দেখা গিয়েছে অর্ধেক স্কুলে কোনও লেখাপড়া হচ্ছে না, এক দশক পরে, ২০০৬ সালেও অন্য একটি সমীক্ষায় একই জিনিস পাওয়া যাচ্ছে। ASER-এর ২০১২-র সমীক্ষাতে দেখা গিযেছে, প্রায় অর্ধেক ছেলেমেয়ে অতি সহজ একটা প্যারাগ্রাফও পড়তে পারে না, সহজ পাটিগণিতের অঙ্ক কষতে পারে না। গত এক দশকে এই ছবিটা বিন্দুমাত্র বদলায়নি।
এই ছবিটার পাশাপাশি দেখা যাক, গ্রামাঞ্চলে কী দ্রুতগতিতে বেসরকারি স্কুলের প্রসার ঘটেছে। গ্রামাঞ্চলে ৮ থেকে ১৪ বছর বযসি পড়ুয়াদের ১৮ শতাংশ ২০০৬ সালে বেসরকারি স্কুলে পড়তে যেত, ২০১২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮ শতাংশে। গড়ে প্রতি বছর প্রায় দশ শতাংশ হারে বাড়ছে বেসরকারি স্কুলের পড়ুয়ার সংখ্যা। এই হার বজায় থাকলে ২০১৮ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলের পড়ুয়াদের ৫০ শতাংশই পড়বে বেসরকারি স্কুলে। পশ্চিমবঙ্গে এই হার অনেক কম, মাত্র সাত শতাংশ ছেলেমেয়ে বেসরকারি স্কুলে পড়তে যায়। কিন্তু এই রাজ্যে আবার প্রাইভেট টিউশন পড়ার প্রবণতা খুব বেশি মোট পড়ুয়ার ৭৩ শতাংশই কোনও না কোনও কোচিং ক্লাসে যায়, যেখানে প্রাইভেট টিউশন পড়ার সর্বভারতীয় গড় হল ২৩ শতাংশ ।
বলা চলে, সরকারি-বেসরকারি স্কুলের ভাল-মন্দ নিয়ে শিক্ষাবিদদের মধ্যে যে বিতর্ক চলছে, তার ফলাফলের জন্যে বসে না থেকে, গ্রামের গরিব মানুষ তাঁদের মতো করে, যে সীমিত সংখ্যক বিকল্প তাঁদের সামনে আছে, তার থেকেই বেছে নিচ্ছেন। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে বসলে এই সত্যকে সহজে নিতে হবে। তবে, কেন বেসরকারি স্কুল বেড়ে চলেছে, এই প্রশ্নের উত্তরসন্ধান জরুরি।
গবেষণা বলছে, বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকরা অপেক্ষাকৃত কম কামাই করেন। শুধু তাই নয়, শিক্ষকদের ক্লাসের ওপর নিয়ন্ত্রণ কতখানি, একই শিক্ষককে এক সঙ্গে একাধিক ক্লাসে পড়াতে হচ্ছে কি না এই সব ব্যাপারেও বেসরকারি স্কুলগুলি এগিয়ে। তেমনই এই সব স্কুলে শিক্ষকের বেতনও ঢের কম (একটি সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকদের গড় বেতন সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতনের ছয় ভাগের এক ভাগ, বা তারও কম)। ফলে এই সব স্কুলে মাথাপিছু ব্যয়ও অনেকখানি কম।
সরকারি স্কুলের শিক্ষকরা তুলনায় যদিও অনেক বেশি প্রশিক্ষিত, বেসরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা রিডিং পড়ায় বা সহজ পাটিগণিতের অঙ্ক কষায় সরকারি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় গড়ে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। যেমন, ২০১২ সালের ASER-এর সমীক্ষা অনুযায়ী, সরকারি স্কুলে আর বেসরকারি স্কুলে ক্লাস ফাইভের ছাত্রছাত্রীরা ক্লাস টু-এর পাঠ্যপুস্তক থেকে সহজ অনুচ্ছেদ পড়তে পারে না এমন ছাত্রের অনুপাত হল ৬০ ও ৪০ শতাংশ, আর সহজ ভাগের অঙ্ক করতে পারে না, এমন ছাত্রের অনুপাত ৬২ আর ৮০ শতাংশ। এই সব তথ্য থেকে মানতেই হবে যে বেসরকারি স্কুলের এই রমরমার পিছনে সরকারি স্কুল ব্যবস্থার সমস্যা একটা বড় কারণ, তা না হলে কোনও কিছু বিনামুল্যে পাওয়া গেলেও দরিদ্র মানুষ অর্থব্যয় করে বেসরকারি বিকল্পের দিকে ঝুঁকবেন কেন?
এর থেকে জগদীশ ভগবতীরা এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বেশি, কিন্তু জবাবদিহি করার দায় অতি সামান্য— ফলে, তাঁরা কাজে মনোযোগী হবেন না, সেটাই স্বাভাবিক। বেসরকারি স্কুলে এই সমস্যা নেই, তাই বেসরকারি স্কুলই ভবিষ্যতের পথ। সরকারি স্কুলগুলির সমস্যা মেনে নিলেও, জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেনের মতে সরকারি স্কুলগুলোর রোগ সারিয়ে তোলাই সমাধানের পথ, বেসরকারি স্কুলের ওপর নির্ভর করা নয়। তার কারণ হিসেবে তাঁরা দেখিয়েছেন, শিক্ষা বাজারি পণ্য নয়, তার সামাজিক মূল্য বাজারের দাম দিয়ে ধরা যায় না। বেসরকারি স্কুলে তার এই চরিত্রটি বজায় থাকবে না, ফলে সামাজিক ক্ষতি হবে। আর, মেধাবী ছাত্ররা বেসরকারি স্কুলে চলে গেলে, সরকারি স্কুলে যারা পড়ে থাকবে, তাদের ক্ষতি হতে পারে।
দুই পক্ষেই যুক্তি আছে। কিন্তু সরকরি আর বেসরকারি স্কুলের মধ্যে প্রত্যক্ষ তুলনায় একটা সমস্যা থেকেই যায়। যেখানে সরকারি স্কুল ভাল কাজ করে না, বেশির ভাগ বেসরকারি স্কুল সেখানেই তৈরি হয়। অন্য জায়গাতেও, যে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ায় ভাল, যাদের পরিবারের আর্থিক সঙ্গতি বেশি, তারাই বেসরকারি স্কুলে পড়তে যায়। ফলে, সরকারি স্কুলের ফলাফলের সঙ্গে বেসরকারি স্কুলের ফলাফলের সরাসরি তুলনা করা হলে বেসরকারি স্কুলের দিকেই পাল্লা ঝুঁকে থাকাটা স্বাভাবিক। এই সমস্যা এড়াতে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগো-তে কর্মরত অর্থনীতিবিদ কার্তিক মুরলীধরন একটা অভিনব পন্থা বেছেছেন। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশে সারা রাজ্যব্যাপী একটি সমীক্ষায় সরকারি স্কুলের কিছু ছাত্রকে লটারির মাধ্যমে বেছে নিয়ে তাদের ভাউচার দিয়েছেন, যাতে তারা বেসরকারি স্কুলে পড়তে পারে। এর ফলে উপরোক্ত সমস্যাটা এড়ানো গেছে, কারণ যে ছাত্ররা নির্বাচিত হয়েছে, তারা গড়পড়তা বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে (পরিভাষা ব্যবহার করলে, তারা র্যানডমলি সিলেক্টেড বা যদৃচ্ছ ভাবে নির্বাচিত হয়েছে)। তার পর তিনি এই বাছাই ছাত্রদের ফলাফলের সঙ্গে ভাউচার না পাওয়া ছাত্রদের ফলের তুলনা করেছেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, যে ছাত্ররা ভাউচার পেয়েছে, তারা ভাউচার না পাওয়া ছাত্রদের তুলনায় অধিকাংশ বিষয়েই ভাল ফল করেছে, যদিও ইংরেজি আর হিন্দি ছাড়া আর কোনও বিষয়েই ফলাফলের পার্থক্য পরিসংখ্যানবিদ্যার নিরিখে উল্লেখযোগ্য নয়। অর্থাৎ, বেসরকারি ও সরকারি স্কুলের মানের মধ্যে ফারাক থাকলেও তা ASER-এর সমীক্ষার তুলনায় কম।
শুধু তাই নয়, অনুমান করা চলে, বাজারে যে ধরনের দক্ষতার চাহিদা বেশি, বেসরকারি স্কুলগুলো সে দিকেই বেশি নজর দিচ্ছে। তাই দ্রেজ ও সেনের আশংকা অমূলক নয়। তাছাড়াও ASER-এর সমীক্ষার ফল অনুযায়ী বেসরকারি স্কুল সরকারি স্কুলের তুলনাতে এগিয়ে থাকলেও, তারও সার্বিক উকর্ষের মান এমন কিছু আহামরি নয়— উন্নতি করার অনেক জায়গা এখনও আছে। তাই ‘বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও’ বলে বাজারের শক্তির ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে চলবে না। আবার অন্য দিকে, সরকারি স্কুল যতখানি লেখাপড়া শেখাতে পারে, বেসরকারি স্কুল প্রায় ততটাই করতে পারছে অনেক কম খরচে (প্রায় এক-তৃতীয়াংশ)। এ দিক থেকে দেখলে, সরকারি স্কুলশিক্ষকদের আয় এবং দায়বদ্ধতার মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তার সমাধান না করে, সেখানে বিনিয়োগ বাড়িয়ে যাওয়া ফুটোপাত্রে জল ঢালার মতো হবে।
প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে বিতর্কে এই কথাগুলো মনে রাখা প্রয়োজন— সরকারি এবং বেসরকারি, উভয় পক্ষের সমর্থকদেরই। আসল প্রশ্নটা সরকারি বনাম বেসরকারি স্কুল নয়, আরও অনেক গভীর। প্রাথমিক শিক্ষার নদীটি সরকারি সেতু ব্যবহার করে পেরোনো উচিত, নাকি বেসরকারি নৌকোয়— এই বিতর্ক অবান্তর। দুটোই ব্যবহারযোগ্য, স্থান-কাল-পাত্রের ওপর নির্ভর করে তাদের বাছতে হবে। সেতুটা যেখানে নড়বড়ে এবং নৌকোয় যেখানে ফুটো, সেখানে এই সব ত্রুটি মেরামত করার দিকেই মনোনিবেশ করতে হবে। সেতু ভাল না নৌকো— এই তাত্ত্বিক তর্কে সময় নষ্ট করে কী লাভ?
|
মৈত্রীশ ঘটক লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস্-এ অর্থনীতির শিক্ষক |