উত্তরপ্রদেশের আই এ এস, আই পি এস অফিসারদের মধ্যে একটা কথা চালু আছে বলে শুনেছি। জেলাশাসক বা পুলিশ সুপার হয়ে কেউ যখন নিজের কর্মস্থলে যান, তখন কেবল একটা সুটকেস নিয়ে যান। তাঁরা জানেন, মাস দুয়েকের বেশি এক জায়গায় টিকবেন না। বস্তুত, উত্তরপ্রদেশে যে কোনও আই এ এস বা আই পি এস’কে মোটামুটি ওইটুকু সময়ের মধ্যেই বদলি বা সাসপেনশনের জন্য তৈরি থাকতে হয়। এবং এখন তো সংবাদমাধ্যমের দৌলতে সবাই এটাও জেনে গিয়েছেন যে, অনেক অফিসারকে যে কারণ দেখিয়ে শাস্তি দেওয়া হয় সে বিষয়ে তাঁরা নিজের কৈফিয়ত দেওয়ার সুযোগটুকুও পান না।
সর্বভারতীয় সার্ভিসের এ ব্যাধি নানা রাজ্যেই আছে, যেমন মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, হরিয়ানা। তবে উত্তরপ্রদেশে এ রোগের প্রকোপ গত কয়েক দশক ধরেই অস্বাভাবিক প্রবল। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকুক, এই দুরাচারের ক্ষান্তি নেই।
সদর জেলার এস ডি এম দুর্গাশক্তি নাগপালের সাসপেনশনের ঘটনা নিয়ে সংবাদমাধ্যমে এত শোরগোলের কারণ, এই ভয়ানক অন্যায় সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এ ক্ষেত্রে অন্যায়টা কিন্তু প্রশাসনিক কর্তাদের নয়। গোলমালটা পাকিয়েছে রাজ্যে ক্ষমতাসীন সমাজবাদী দলের ঘনিষ্ঠ এক স্থানীয় গুন্ডা, তার পর সেই অনাচারকে রাষ্ট্রের ‘নিজস্ব অধিকার’ বলে চালানোর চেষ্টা চলছে।
তবে একটা কথা পরিষ্কার বলে নেওয়া ভাল। সাধারণ মানুষ যেমন টেলিভিশন দেখে এবং কাগজ পড়ে এই ঘটনাটির কথা জেনে স্তম্ভিত হয়েছেন, শাসক সমাজবাদী দল তার চেয়ে কম অবাক হয়নি। তাদের অবাক হওয়ার কারণটা কেবল আলাদা। সাধারণ মানুষ এই ঘটনাকে সরকারি ক্ষমতার ভয়াবহ অপব্যবহারের একটি নিদর্শন হিসেবে দেখছেন, আর সমাজবাদী পার্টি ভাবছে, এ রকম ঘটনা তো আকছার ঘটে থাকে, এই নিয়ে হঠাৎ এমন হইচইয়ের মানেটা কী? কেবল এ-যাত্রায় তো নয়, তারা এর আগে যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও এমন শত শত ঘটনা ঘটেছে, ঠিক যেমন ঘটেছে মায়াবতীর জমানায়, কিংবা বিজেপি সরকারের আমলেও। |
প্রেরণা। দুর্গাশক্তি নাগপালের সমর্থনে। লখনউ, ৩ অগস্ট। ছবি: পি টি আই |
মিডিয়া গত কয়েক সপ্তাহে এ বিষয়ে বিস্তর তথ্য সরবরাহ করেছে: মাসে গড়ে দুশো অফিসারকে বদলি করা হয়েছে, সমাজবাদী পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হাজার দুয়েক, ইত্যাদি। একটা সাসপেনশনের ঘটনা নিয়ে এমন তুলকালাম দেখে শাসক দল কেন অবাক হয়ে গিয়েছে, সে কথা বোঝা কঠিন নয়।
দুর্গাশক্তি নাগপাল যা তাঁর নিজের কর্তব্য বলে মনে করেছেন, সেটাই করেছেন। যত দূর জানি, এটাই ছিল ট্রেনিংয়ের পরে তাঁর প্রথম পোস্টিং। তাঁকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যে পরিস্থিতিতে যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তাঁকে তৈরি করা হয়েছে, তিনি ঠিক সেই অনুসারেই কাজ করেছেন। তাঁকে শেখানো হয়েছিল, আইনের শাসন জারি রাখাই তাঁর কাজ, তিনি আইনের শাসন জারি রেখেছেন। তিনি নিশ্চয়ই এখন সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত হয়ে ভাবছেন নিজের কর্তব্য করার জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করা হল কেন! অচিরেই তিনি বুঝে যাবেন, হয়তো ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছেন, তাঁর আগে তাঁর চেয়ে সিনিয়র অনেক আধিকারিককেও আচমকা বদলি করা হয়েছে, কিংবা তাঁর মতোই সাসপেন্ডও করা হয়েছে। তাঁর উপলব্ধি হবে যে, উত্তরপ্রদেশের রাজনীতিকরা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছেন, তাই তাঁদের ক্ষমতার লোভ বেড়েই চলেছে, নরখাদক বাঘ যেমন রক্তের স্বাদ পেয়ে কেবলই আরও শিকার চায়। আইন বলবৎ করার জন্য আধিকারিকরা আছেন, কিন্তু তার উপরে আছেন রাজনীতির শক্তিমানরা, আছে তাঁদের সহযোগী চোর-ডাকাত-গুন্ডার দল। কোনও অফিসার তাদের অসুবিধে সৃষ্টি করলে তারা তাঁকে সরিয়ে দেয়, সেই ক্ষমতা তাদের আছে। এই ক্ষমতার নেশা বড় সাংঘাতিক। অফিসারদের কাছে এই ভাবে একটা খুব পরিষ্কার বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়: আমাদের দরকার মতো আইনকানুন বাঁকিয়ে-চুরিয়ে দিয়ো, তা হলে তোমাকে কেউ ঘাঁটাবে না, না হলে তোমাকে সরিয়ে দেওয়া হবে।
এই পরজীবী শ্রেণিটিতে কংগ্রেস, বিজেপি, বি এস পি, সমাজবাদী পার্টি, সব দলের লোকই আছে। তারা কি জানে না, শাসনকাঠামোর কত বড় ক্ষতি তারা সাধন করছে? আইনের শাসনকে কী ভাবে নষ্ট করছে? অবশ্যই জানে। এরা কেবল পাজি নয়, ধুরন্ধরও বটে। আমরা হয়তো সরল মনে ভাবি, রাষ্ট্রযন্ত্রের বেশির ভাগ জায়গাতেই আইনের শাসন ভেঙে পড়েছে, ভেঙে পড়েছে ক্ষমতার বৈধ কাঠামো। যখন ভয়াবহ সব ঘটনা ঘটে, যেমন ধরুন, ডি এস পি জিয়া উল হককে ঠান্ডা মাথায় খুন করা হয়, তখন আমাদের এমনটা মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু ওই বদমাশগুলো জানে, বৈধ ক্ষমতার কাঠামো ভেঙে পড়েনি, কেবল তার বদলে অবৈধ ক্ষমতার কাঠামো পাকাপোক্ত হয়েছে। জিয়া উল হক যেখানে নিহত হন, সেই এলাকার সর্বজনবিদিত মাফিয়া ডন রাজা ভাইয়া। ভূতপূর্ব মন্ত্রী, বিস্তর মারাত্মক অপরাধের অভিযোগ তাঁর নামে। ঠিকঠাক মেজাজে থাকলে তিনি নিজেই সত্যি কথাটা সাফ সাফ বলে দেবেন। অফিসাররা তাঁর সামনে নতজানু, তাঁর আদেশ পালনের জন্য নিজেদের আইনি ক্ষমতা কাজে লাগাতে প্রস্তুত। সেটাই অফিসারদের কাজ। রাজা ভাইয়া এবং তাঁর মতো ক্ষমতাবানরা তেমনটাই মনে করেন।
তবে উত্তরপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে একটা ক্ষীণ আশার আলো দেখা যাচ্ছে। এত অফিসারকে যে বদলি করা হচ্ছে, তাতে বোঝা যায়, এখনও অন্তত কিছু অফিসার আছেন, যাঁরা প্রশাসনের কাঠামো ভেঙে দেওয়ার এই নির্লজ্জ উদ্যোগের কাছে মাথা নোয়াতে রাজি নন। তাঁদের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা নিজেরা যা ন্যায়সংগত বলে মনে করেন, শত চাপের মুখেও সেটাই করে চলেছেন। এর ফলে যে ব্যবস্থাটা বদলাবে, এমন আশা করে লাভ নেই। এই অফিসারদের রাতারাতি বদলির হুকুম জারি হবে, কিংবা তাঁদের সাসপেন্ড করা হবে, তাঁদের জায়গায় যাঁরা আসবেন, তাঁরাও কেউ কেউ মাথা উঁচু রাখতে চেষ্টা করবেন, আবার ক’মাস পরে তাঁরাও শাস্তি পাবেন, এমনটাই হয়তো চলবে। মাফিয়া-পরিবৃত রাজনীতিকদের দাপট হয়তো অক্ষত থাকবে। কিন্তু ন্যায়ের পথে, আইনের পথে থাকার চেষ্টাটা যদি জারি থাকে, কিছু অফিসার যদি শিরদাঁড়া সোজা রেখে কাজ করতে চান, তা হলে একটু ভরসা হয়। আশা জাগে, হয়তো বা এক দিন আসবে, যখন সৎ অফিসাররা সেই ভাবেই কাজ করতে পারবেন, যেমন ভাবে কাজ করার কথা।
তরুণ অফিসার দুর্গাশক্তি নাগপাল যা কর্তব্য বলে মনে করেছেন, সেটাই করেছেন। আমরা দেখব, এই তিক্ত অভিজ্ঞতার পরে ভবিষ্যতে তিনি আরও অনেক আই এ এস, আই পি এস অফিসারের মতো দলে ভিড়ে যাবেন, না কর্তব্যে অবিচল থাকবেন। মুসুরির ট্রেনিং অ্যাকাডেমিতে এবং পরবর্তী প্রশিক্ষণপর্বে যে আদর্শে তিনি দীক্ষিত হয়েছিলেন, কর্মক্ষেত্রের কঠিন ভূমিতে, গুন্ডা-মাফিয়াদের হুমকির মুখে দাঁড়িয়ে সেই আদর্শের সম্মান রক্ষা করতে পারবেন কি না, আইনের পথে থেকে যা করা উচিত সেটাই করে যেতে পারবেন কি না, ভবিষ্যৎই তা বলবে।
|
কেন্দ্রীয় সরকারের ভূতপূর্ব সংস্কৃতি সচিব, দূরদর্শনের ভূতপূর্ব অধিকর্তা |