রাজ্যের রাজধানী শহর কলিকাতার রাস্তাঘাটের অবস্থা শোচনীয় বলিলে প্রায় কিছুই বলা হয় না। শহরের সর্বত্রই এমন বেশ কিছু জনস্থান রহিয়াছে, যেগুলিকে কখনও হয়তো রাস্তা বলা যাইত, এখন স্বচ্ছন্দে খানা-খন্দ, ডোবা বা খাল আখ্যা দেওয়া যায়। কোনও সভ্য দেশেই এ সবের উপর দিয়া কোনও যানবাহন চলাচল করে না। কলিকাতায় করে, করিতে হয়, কারণ ওইগুলিই শহরের একমাত্র যান-সরণি। সভ্য দেশে এ ধরনের রাস্তায় যাতায়াতের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িকে (এবং অবশ্যই জনসাধারণকেও) সরকার ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য থাকে। এখানে সরকারি পরিষেবার ত্রুটি বা সীমাবদ্ধতার কারণে নাগরিকদের ক্ষতি হইবে ধরিয়া লইয়াই নাগরিক বা নাগরিকের গাড়ি পথে নামে। মোদ্দা কথা, প্রতি বর্ষায় শহর ও শহরতলির পথঘাট যান-চলাচলের অযোগ্য হইয়া ওঠে, এ বারও উঠিয়াছে। ভবিষ্যতেও যে উঠিবে না, তাহা মনে করিবার কিছুমাত্র কারণ নাই।
যে-কোনও জিনিস ভাঙাচোরা অবস্থায় পৌঁছাইলে তাহাকে মেরামত করিতে হয়। ইহাকে সাধারণত রক্ষণাবেক্ষণ বলে। কলিকাতার রাস্তাঘাট ভাঙিয়া গেলেও মেরামতি হয়, তবে তাহা কেবল অচিরেই আবার মেরামতির আবশ্যকতা নিশ্চিত করিতে। প্রায়শ যে ঠিকাদার সংস্থা এক বার মেরামতির দায়িত্ব পাইয়াছে, পত্রপাঠ ভাঙিয়া যাওয়ার জন্য তাহার দায় শনাক্ত না করিয়া পুনর্বার তাহাকেই মেরামতির ঠিকা দেওয়া হয়। পূর্ত দফতর হউক কিংবা পুরসভা, উভয়েই এ ভাবেই ভাঙা রাস্তার মেরামতি করিয়া আসিতেছে। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে যেমন চলিতেছিল, তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের আমলেও একই ধারা অব্যাহত। নিন্দুকরা ইহার মধ্যে ঠিকাদার এবং পূর্ত বিভাগ ও পুরসভার ইঞ্জিনিয়ার ও ভারপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের কায়েমি স্বার্থের খেলা দেখিতে পান। জনসাধারণ কেবল দেখেন, প্রতি বছর নিয়ম করিয়া বর্ষার আগেই রাস্তা ভাঙে, বর্ষার পর সারাইয়ের সরকারি প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, বর্ষায় পথঘাট চলাফেরার অনুপযুক্ত থাকে, বর্ষার পরেও এমন আল্তো ভাবে মেরামতির কাজ হয় যাহাতে অচিরেই আবার পথের ত্বক নষ্ট হইয়া যায়, পথের ক্ষত দাঁত বাহির করিয়া ভেংচি কাটে। যশোর রোড, ভিআইপি রোড, জেম্স লঙ সরণি, বি টি রোড, ডায়মন্ডহারবার রোড, রুবি-কসবা রোড, সকলেরই এক কাহিনি।
একটা সময় ছিল, যখন রাজ্যের মাননীয় মন্ত্রীরা যাইবেন বলিয়া কোনও-কোনও পথ মাঝেমধ্যে সারাই হইত। জনসাধারণ চাহিতেন, তাঁহাদের এলাকা দিয়া যেন ঘন-ঘন ভিআইপি-রা যাতায়াত করেন! ইদানীং মন্ত্রীরা পারতপক্ষে ওই ধরনের এলেবেলে রাস্তা মাড়ান না। ফলে ভাঙা খন্দপথের উপরিতল সমান রাখার কোনও দায়ও পূর্ত দফতরের নাই। ভাড়া না-বাড়ানোয় এমনিতেই বাসের সংখ্যা শহর হইতে ক্রমবিলীয়মান। অটোরিক্শ ধরনের যান-মাধ্যমে ওই সব রাস্তা দিয়া নাচিতে-নাচিতে গন্তব্য অভিমুখী জনসাধারণের কিছু বাধ্যতামূলক ব্যায়ামও হইয়া যায়, তাহাতে তাঁহাদের শরীর-স্বাস্থ্যও ভাল থাকে। তাই এক হিসাবে সরকার রাজ্যবাসীকে ব্যথাপথ উপহার দিয়া তাঁহাদের উপকারই করিতেছে। রাজ্যবাসীর এ জন্য সরকারের কাছে, বিশেষত পুরসভাগুলি এবং পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে যৎপরোনাস্তি কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। ভাঙা পথের রাঙা ধুলা কিংবা খানাখন্দের নোংরা জল গায়ে মাখিয়া ভগ্নমেরু বঙ্গবাসীর নিত্য অভিসার দীর্ঘজীবী হউক। |