শব্দ ব্রহ্ম কি না, ব্রহ্মজ্ঞানীরা বলিতে পারিবেন। তবে শব্দ প্রায়শই মোহময়। এমনকী অতি বড় বাস্তববোধসম্পন্ন ব্যক্তিও শব্দের মোহে পড়িতে পারেন। যথা, পালানিয়াপ্পন চিদম্বরম। ভারতের অর্থমন্ত্রীর বাস্তববোধের ঘাটতি আছে, তাঁহার অতি বড় শত্রুও এমন কথা বলিবে না। অথচ তিনিও দুইটি শব্দের ফাঁদে পড়িয়াছেন। প্যাশন এবং কমপ্যাশন। তাঁহার ঘোষণা: ‘প্যাশন ফর গ্রোথ’ এবং ‘কমপ্যাশন ফর দ্য পুয়োর’কে মিলাইবেন তিনি, মিলাইবেন। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য: এই মহামিলনই ইউ পি এ’র আদর্শ, তাহার নির্বাচনী প্রস্তাবনায় সেই আদর্শের জয়গান অবশ্যই গীত হইবে। ইতিপূর্বেও তিনি শব্দ দুইটি ব্যবহার করিয়াছেন। দুই প্রবীণ ও বিশ্রুত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এবং জগদীশ ভগবতী সম্পর্কে তিনি সম্প্রতি বলিয়াছেন, প্রথম জনের আছে ‘আয়বৃদ্ধির জন্য আবেগ’, আর ‘দরিদ্রের জন্য করুণা’ দ্বিতীয় জনের চরিত্রলক্ষণ। ভগবতী ইতিমধ্যেই এই প্রতিতুলনার জন্য চিদম্বরমকে ঈষৎ তিরস্কার করিয়াছেন। স্বাভাবিক, দরিদ্রের জন্য করুণা একা অমর্ত্য সেনের আছে, তাঁহার নাই, এমন অপবাদ তিনি সহ্য করেন কী করিয়া? অমর্ত্য সেন অর্থমন্ত্রীর মন্তব্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানান নাই, জানাইবেন বলিয়া মনে হয় না, আয়বৃদ্ধি তাঁহার নিকট গুরুত্বপূর্ণ হইলেও সে জন্য তাঁহার ‘আবেগ’ আছে, এমন দাবি তিনি সম্ভবত করিবেন না। তবে সম্প্রতি এই দুই অর্থশাস্ত্রীর মতামতকে কেন্দ্র করিয়া যে শোরগোল উঠিয়াছে, তাহার পরিপ্রেক্ষিতে চিদম্বরমের মন্তব্যটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। শব্দের মোহটি কেমন ও কোথায়, তাহাও সেই সূত্রেই বিচার্য।
চিদম্বরমের মন্তব্যের নিহিতার্থ ইহাই যে, আয়বৃদ্ধির স্পৃহা এবং দরিদ্রের প্রতি করুণা, এই দুইয়ের স্বাভাবিক দূরত্ব আছে, তাঁহার দল তথা জোট সেই দূরত্ব বিনাশ করিয়া দুইটিকে একত্র করিবেন। স্পষ্টতই, ইহা কেবল ইউ পি এ’র ‘ইনক্লুসিভ গ্রোথ’ বা সর্বজনীন উন্নয়নের পরিচিত আদর্শের প্রস্তাবনা নহে, ইহা প্রতিদ্বন্দ্বী জোট এন ডি এ তথা নির্বাচনী প্রচারে তাহার অগ্রণী নায়ক নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে অস্ত্রসন্ধানের একটি কৌশলও বটে। সনিয়া ও রাহুল গাঁধীর নির্দেশনায় কংগ্রেস তথা ইউ পি এ ক্রমাগত প্রচার করিতে চাহিতেছে যে, তাহারা সর্বজনীন উন্নয়নে বিশ্বাসী, আয়বৃদ্ধিকে দরিদ্রের কল্যাণে কাজে লাগাইয়াই সেই উন্নয়নের সোপান রচনায় আগ্রহী, আর দরিদ্রের প্রতি নরেন্দ্র মোদী তথা বিজেপি তথা এন ডি এ’র স্বতন্ত্র কোনও মনোযোগ নাই, তাহারা মনে করে, আয়বৃদ্ধি ঘটিলে আপনিই দরিদ্রের কল্যাণ হইবে, বর্ধিত আয় দরিদ্রের হাতে আপনিই পৌঁছাইবে। সেন ‘বনাম’ ভগবতী বিতর্কের ছায়া অতি সুস্পষ্ট।
সেন বনাম ভগবতী হউক, ইউ পি এ বনাম এন ডি এ হউক, উন্নয়নের বিতর্ককে আয়বৃদ্ধি বনাম দারিদ্র বিমোচনের দ্বৈরথে পর্যবসিত করিলে বড় অন্যায় হয়। যথার্থ উন্নয়নের নীতি ও কার্যক্রম রচনা করিতে চাহিলে আয়বৃদ্ধিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়, আবার দারিদ্র দূর করিবার আয়োজনও সেই নীতি ও কার্যক্রমের অপরিহার্য অঙ্গ। দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক ঠিক কী ও কেমন, তাহার কোনও পাইকারি উত্তর হয় না, হইতে পারে না, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে বিভিন্ন উত্তর নির্ধারণ করিতে হয়। কিন্তু রাজনীতিকরা যখন নির্বাচনে অবতীর্ণ হন, সনিয়া-রাহুল-মনমোহনকে যখন নরেন্দ্র মোদীর মহড়া লইতে হয়, তখন সেই সূক্ষ্মবিচারে তাঁহাদের কাজ চলে না। তখন স্লোগান আবশ্যক। স্লোগান ধ্বনি-নির্ভর। অতএব ‘প্যাশন’ এবং ‘কমপ্যাশন’-এর লড়াই জমিয়া ওঠে। কথার অর্থ অপেক্ষা কথার আওয়াজ প্রধান হইয়া দাঁড়ায়। যোদ্ধারা যুক্তি ছাড়িয়া শব্দ সন্ধান করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদরাও সেই লড়াইয়ে জখম হইতে পারেন। কোল্যাটারাল ড্যামেজ। |