তদন্তকারী ও বিচারক। দু’ক্ষেত্রেই যেন মিলে গেল পার্ক স্ট্রিট ও কামদুনি।
কামদুনির ধর্ষণ-খুনের মামলাটিকে সোমবার বারাসতের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট থেকে সরিয়ে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে আনল কলকাতা হাইকোর্ট। যে মহিলা বিচারক এ বার মামলাটি শুনবেন, সেই মধুছন্দা বসুর এজলাসেই চলছে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ-কাণ্ডের বিচার। একই দিনে কামদুনি-কাণ্ডের তদন্তভার চলে এল মহিলা আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনেরই কাঁধে, কলকাতা পুলিশের তদানীন্তন গোয়েন্দা-প্রধান হিসেবে যিনি কিনা শুরু করেছিলেন পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের তদন্ত!
দময়ন্তী এ দিনই ডিআইজি (দার্জিলিং) পদ থেকে ডিআইজি (সিআইডি) পদে বদলি হয়েছেন। কামদুনি-কাণ্ডের তদন্ত সিআইডি করছে। ওই সূত্রে দময়ন্তীই এখন কামদুনি-তদন্তের দেখভাল করবেন বলে স্বরাষ্ট্র দফতর সূত্রের খবর। পার্ক স্ট্রিট-তদন্ত প্রক্রিয়ায় গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তীর ভূমিকা তাঁকে রাজ্য প্রশাসনের শীর্ষ মহলের বিরাগভাজন করে তুলেছিল। যার জেরে তাঁকে সরতে হয়। দময়ন্তীকে প্রথমে পাঠানো হয়েছিল ব্যারাকপুরে, পরে উত্তরবঙ্গে।
বছর দেড়েক পরে দময়ন্তী আবার ফিরছেন কলকাতায়। ইতিমধ্যে পার্ক স্ট্রিট-মামলার তদন্ত সেরে চার্জশিট দিয়েছে পুলিশ। যেখানে তার বিচার চলছে, সেই নগর দায়রা আদালতের একই এজলাসে এ বার শুনানি হবে সাম্প্রতিক কালে নারী নির্যাতন সংক্রান্ত আর একটি চাঞ্চল্যকর মামলারও। কিন্তু কামদুনি-মামলা বারাসত থেকে কলকাতায় সরলো কেন?
এ ক্ষেত্রে আইন-শৃঙ্খলা ও অভিযুক্তদের বিচার পাওয়ার অধিকারের কথা বলেছে হাইকোর্ট। তার বক্তব্য: বারাসত আদালতে কামদুনি-শুনানি চলাকালীন বিক্ষোভ হচ্ছে, ভয়ে অভিযুক্তদের হয়ে কোনও আইনজীবী দাঁড়াচ্ছেন না। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হচ্ছে। তাই বিচারপতি অসীম রায়ের নির্দেশ: এখন থেকে কলকাতার নগর দায়রা আদালতে বিচারক মধুছন্দা বসুর এজলাসে মামলাটির শুনানি হবে। কামদুনি-বিচার দ্রুত শেষ করার উপরে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ ইতিমধ্যে জোর দিয়েছে। বিচারপতি রায়ও বলেছেন, দু’দিনের মধ্যে মামলার কাগজপত্র বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট থেকে নগর দায়রা আদালতে নিয়ে আসতে হবে। চার্জ গঠন করতে হবে সাত দিনের মধ্যে। |
কামদুনি-মামলার দ্রুত বিচার চেয়ে সিআইডি-র তদন্তকারী অফিসার হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চে আর্জি জানিয়েছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চ তাঁর সব যুক্তি না-মানলেও দ্রুত নিষ্পত্তির কথা বলে বিষয়টি বিচারপতি রায়ের আদালতে পাঠায়। শুনানিতে অভিযুক্তদের আইনজীবী জানিয়েছিলেন, বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে মূল মামলা উঠলেই কামদুনির লোকজন সেখানে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন, অভিযুক্তদের হয়ে কেউ মামলা লড়তে চাইছেন না। এমতাবস্থায় বারাসত আদালতে যথাযথ বিচার সম্ভব নয় বলে দাবি করে তাঁর আবেদন ছিল, কামদুনি-মামলা অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হোক। পাশাপাশি কোনও মহিলা বিচারকের এজলাসে মূল মামলার শুনানি করার জন্য হাইকোর্টকে আর্জি জানিয়েছিলেন কামদুনি-কাণ্ডে অভিযুক্তদের কৌঁসুলি।
এ দিন এ ব্যাপারেই রায় দিয়েছে হাইকোর্ট। বারাসত কোর্টের বিচারকের রিপোর্ট উদ্ধৃত করে হাইকোর্ট বলেছে, ওখানে যে দিনই অভিযুক্তদের হাজির করানো হয়, সে দিনই বিক্ষোভের জেরে আদালত চত্বর উত্তেজনাপ্রবণ হয়ে পড়ে। প্রচুর পুলিশের ব্যবস্থা করতে হয়। এই রিপোর্ট এবং অভিযুক্তপক্ষের কৌঁসুলি আবু ফিরোজের কথায় গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি সরানো হল বলে জানিয়েছেন বিচারপতি রায়। একই সঙ্গে তাঁর নির্দেশ: সরকারি সাক্ষীদের সম্পূর্ণ সরকারি খরচে কলকাতায় সাক্ষ্য দিতে নিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে প্রশাসন তাঁদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করবে।
বারাসত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দু’দিন অভিযুক্তদের পক্ষে আইনজীবী দাঁড়িয়েছিলেন। পরে কেউ দাঁড়াতে পারেননি। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি রায় এ দিন বলেছেন, অভিযুক্তদের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাঁরা যাতে আইনজীবীর সহায়তা পান, সে ব্যাপারে লিগ্যাল এডসের মাধ্যমে সরকারকে সক্রিয় হতে হবে। হাইকোর্টের নির্দেশ, ফৌজদারি মামলায় অন্তত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনও আইনজীবীকে অভিযুক্তদের পক্ষে দাঁড় করাতে হবে।
বারাসত কোর্টের বিচার-প্রক্রিয়া সম্পর্কে হাইকোর্ট অবশ্য কোনও বিরূপ মন্তব্য করেনি।
কিন্তু হাইকোর্টের এ দিনের রায় শুনে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন কামদুনির ক্ষতিগ্রস্তদের আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়। তাঁর দাবি, বারাসতে কোর্টের বাইরে যা হচ্ছিল, তা বিক্ষোভ নয়। “সেটা ওই ভয়ঙ্কর ঘটনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মাত্র।” বলছেন তিনি। রায়ের বিরুদ্ধে তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবছেন বলে জানিয়েছেন জয়ন্তনারায়ণবাবু। কামদুনির নিহত তরুণীর দাদা বলেন, “এমন নির্দেশ কেন, বুঝতে পারছি না। এখানেও তো অভিযুক্তদের আইনজীবী দেওয়া হয়েছে! বারাসতে মামলা থাকলে বরং আমাদের যাতায়াতে সুবিধা হতো।”
পড়শি গৃহবধূ মৌসুমি কয়ালের গলাতেও এর প্রতিধ্বনি। তাঁর মন্তব্য, “বারাসত কোটর্র্ সিআইডি-কে তদন্ত নিয়ে ভর্ৎসনা করেছিল। আমরা চাই, কলকাতার আদালতও মামলাটি গুরুত্ব দিয়ে দেখুক। তবে বারাসতে মামলা থাকলে আমরা প্রতি দিন যেতে পারতাম। এখানে পারব না।”
|