ধর্ষিতার সঙ্গে অসহযোগিতা,
অভিযুক্ত পুলিশ
খাস কলকাতার বুকে ধর্ষণের ঘটনার তদন্তে অসহযোগিতা নিয়ে দিনভর শোরগোলের পর নড়ে বসল পুলিশ। বুধবার রাতে কয়েক জন যুবককে আটক করে তাদের শনাক্তকরণের জন্য অভিযোগকারিণীকে লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়।
দশ দিন আগে মাঝ রাতে গাড়িতে তুলে ওই মহিলাকে মুখে বন্দুক গুঁজে ধর্ষণ করা হয় বলে অভিযোগ। পুলিশের কাছে গিয়েও ‘সুবিচার’ পাননি বলে জানিয়েছেন অভিযোগকারিণী। তাঁর বক্তব্য, আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও জরুরি শারীরিক পরীক্ষা করাতে পুলিশ অহেতুক দেরি করেছে। এমনকী তাঁর প্রতি ইঙ্গিতপূর্ণ আচরণ এবং অপমানজনক ব্যবহারও করেছেন পার্ক স্ট্রিট থানার কয়েক জন অফিসার। বুধবার সন্ধ্যায় স্টার আনন্দকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও অভিযোগ করেন, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ঘেঁটে তিন অভিযুক্তের ছবি বার করে দেওয়া সত্ত্বেও পুলিশ বুধবার সন্ধে পর্যন্ত তাদের কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। এর পরেই তৎপর হয় পুলিশ।
এই ঘটনা সম্পর্কে বুধবার মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পাঁচ দিন আগের ঘটনা। পাঁচ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে।
কী হয়েছিল সেই রাতে?
ওই মহিলা জানান, গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে তিনি প্রথমে পার্ক স্ট্রিটে একটি ক্লাবে গিয়েছিলেন। রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ তিনি কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটেরই একটি পানশালায় যান। ওই পানশালা যে পাঁচতারা হোটেলে, সওয়া বারোটা নাগাদ সেখানকারই একটি নাইটক্লাবে যান তাঁরা। রাত দেড়টা নাগাদ ওই মহিলার বন্ধুরা বাড়ি গেলেও তিনি যাননি। মহিলা জানান, ওই নাইটক্লাবেই তাঁর সঙ্গে লাভি গিদওয়ানি, শরাফত আলি এবং আজহার আলি নামে তিন যুবকের আলাপ হয়। রাত দু’টো নাগাদ তিনি সেখান থেকে বের হন। মহিলার বক্তব্য, ওই যুবকেরা তাঁকে তাঁদের ‘হন্ডা সিটি’ গাড়িতে লিফট দিতে চায়।
ওই মহিলার কথায়, “গাড়িতে ওঠার আগে লাভির ব্যবহার, হাবভাব এত ভাল ছিল যে আমার একটুও সন্দেহ হয়নি। তাই রাজি হয়েছিলাম। পার্ক হোটেলের বাইরেই ওদের গাড়ি দাঁড় করানো ছিল। আমি ওঠার পর ডান দিকে লাভি ওঠে। আর তার মিনিট দু’য়েকের মধ্যে বাঁ দিকে ওঠে শরাফত আলি এবং আরও এক জন। তাকে আমি আগে দেখিনি। সামনে চালকের পাশে ছিল আজহার আলি।”
মহিলার বয়ানে জানা গিয়েছে, গাড়ি চলতে শুরু করতেই শরাফত তাঁর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করে। ওর আচরণ দেখে সন্দেহ হতেই তিনি গাড়ি থামাতে বলেন। সেই সময় শরাফত তাঁর মুখ চেপে, চুলের মুঠি ধরে গাড়ির সিটের ফাঁকে ফেলে দেয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। তিনি বলেন, “শরাফত আমার পেটে সজোরে একটা ঘুঁষি মারে। তখন সব অন্ধকার দেখছিলাম। ওরা গাড়িটা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাশের গলিতে ঢুকিয়ে দেয়। গাড়িটা বেশ জোরে যাচ্ছিল। শরাফত আমার মুখে, মাথায়, পেটে বেধড়ক মেরে যাচ্ছিল। আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করছিলাম। কিন্তু গাড়ির কাচ বন্ধ থাকায় আমার আওয়াজ বাইরে যায়নি। আমি ওর পা ধরে বলছিলাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। কোনও ভুল করে থাকলে মাফ করে দাও।’ এক সময় শরাফত আমার মুখে ঢুকিয়ে বন্দুক বলল, ‘চিল্লায়গি তো ঠোক দেঙ্গে।”
ওই মহিলা জানান, চলন্ত গাড়িতেই শরাফত তাঁকে ধর্ষণ করে। সঙ্গে চলতে থাকে গালিগালাজ আর মার। তাঁর কথায়, “আমার জ্ঞান ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। শুধু ভাবছিলাম, আমার ছোট দু’টো মেয়ে ও মায়ের কী হবে!” তবে গাড়ির অন্য যুবকেরা তাঁর উপর কোনও অত্যাচার করেনি বলে জানান ওই মহিলা। তিনি বলেন, “লাভি আর আজহার বারবার শরাফতকে অনুরোধ করছিল আমাকে ছেড়ে দিতে।” ভোর সাড়ে চারটে নাগাদ এক্সাইড মোড়ে তাঁকে গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়। মহিলা জানিয়েছেন, বেশ কিছুক্ষণ পর বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠে তিনি একটি ট্যাক্সি ধরে বেহালায় নিজের বাড়ি ফিরে যান।
৫ তারিখ মধ্যরাতে এই ঘটনা ঘটলেও তিনি তার পরদিনই পুলিশের কাছে যাননি কেন?
ওই মহিলার বক্তব্য, বাড়িতে তাঁর দুই মেয়ে রয়েছে। বিবাহবিচ্ছিন্না হওয়ায় তিনিই তাঁদের লালনপালন করেন। তাঁর সঙ্গে থাকেন তাঁর মা-ও। এই ঘটনার পর তিনি মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন। উপরন্তু নিরাপত্তার কথা ভেবেও তিনি ভয় পেয়েছিলেন। সে কারণেই তিনি থানায় যেতে পারেননি। ৮ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রথম থানায় যান। পুলিশের দাবি, জেনারেল ডায়েরি লেখার পর কতর্ব্যরত পুলিশকর্মীকে তিনি বলেন, আরও বিস্তারিত ভাবে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে চান। সে কারণেই শেষমেশ ৯ তারিখে ফের ওই মহিলা পুলিশকে মৌখিক বক্তব্য জানালে এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ওই মহিলার মেডিক্যাল পরীক্ষা হয়। পাঁচ দিন দেরি কেন?
মহিলা জানান, ১০ তারিখ পুলিশ তাঁকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে নিয়ে গিয়েছিল। আদালত ডাক্তারি পরীক্ষার নির্দেশও দিয়েছিল। কিন্তু পুলিশ তাঁকে জানায়, মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মেডিকো-ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছুটিতে। ফলে ১৪ তারিখের আগে ডাক্তারি পরীক্ষা হবে না। হাসপাতাল কেন এমন বলল? কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ উৎপল দত্তকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি কিন্তু এ দিন বলেন, “ওই বিভাগে একাধিক চিকিৎসক রয়েছেন। এই ধরনের মেডিক্যাল পরীক্ষায় কখনও দেরি করা হয় না।” সে ক্ষেত্রে অবধারিত ভাবে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি পুলিশের গাফিলতিতেই নষ্ট হল মূল্যবান প্রমাণ?
১৪ তারিখ ডাক্তারি পরীক্ষার পরে থানায় গিয়েছিলেন ওই মহিলা এবং তাঁর কাকিমা। সেখানে তাঁদের আর এক প্রস্ত অপমানের সম্মুখীন হতে হয় বলে অভিযোগ। মহিলার কাকিমার কথায়, “আমরা যখন থানায় গেলাম, তখন নিয়োগী এবং মণীশ সিংহ নামে দুই পুলিশ অফিসার নিজেদের মধ্যে আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকেন। নিয়োগী নামের ওই অফিসার মণীশকে বলেন, ‘চলো, ওই নাইটক্লাবে গিয়ে ঠান্ডা বিয়ার খাই।’ মণীশ তাতে রাজি না হওয়ায় নিয়োগী আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে থাকে, ‘ওই জন্যই তোমার কোনও গার্লফ্রেন্ড নেই।’ প্রায় পনেরো মিনিট ধরে এ ধরনের কথা বলতে থাকেন ওঁরা।” ওই আত্মীয়ার বক্তব্য, “এ ভাবে আমাদের অপমান করার অধিকার পুলিশকে কে দিল? কেউ কোনও সাহায্যের জন্য থানায় গেলে সভ্য সমাজের পুলিশের কি এ রকম ব্যবহার করার অধিকার আছে?”
এই ব্যাপারে পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দময়ন্তী সেন বলেন, “পুলিশকর্মীদের বিরুদ্ধে ওই মহিলা যে অভিযোগ করেছেন, তা যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে কড়া ব্যবস্থাও নেওয়া হবে।” ওই মহিলা জানিয়েছেন, একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট থেকে লাভি এবং অন্য কয়েক জনের ছবি তিনি পুলিশকে দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও পুলিশ তাদের ধরতে পারেনি বলে তাঁর অভিযোগ। এ ব্যাপারে যুগ্ম কমিশনার জানান, লাভি গিদওয়ানি নামে এক যুবকের বাবাকে এ দিন লালবাজারে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি পুলিশকে জানিয়েছেন, লাভি ১ জানুয়ারি কানাডা চলে গিয়েছে। এই তথ্য খতিয়ে দেখছে পুলিশ। সেই সঙ্গে বাকি অভিযুক্তদের সঙ্গে নামের মিল থাকা যুবকদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
যদিও মহিলার বিপত্তি আরও বাড়িয়েছেন যুগ্ম কমিশনার নিজেই। এ দিন লালবাজারে সংবাদমাধ্যমের কাছে অভিযোগকারিণীর নাম বলে দেন তিনি। সুপ্রিম কোর্টের নিয়ম অনুযায়ী, কোনও ধর্ষিতার নাম প্রকাশ করা যায় না। পুলিশ কেন তা করল, উঠেছে সে প্রশ্নও।
এ দিন রাতে দক্ষিণ কলকাতা জেলা কংগ্রেসের নেতৃত্বে পার্ক স্ট্রিট থানার সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়। মহিলাদের নিরাপত্তা দিতে রাজ্য সরকার উদাসীন বলেও অভিযোগ করেন বিক্ষোভকারীরা।


গলদের খতিয়ান
চিকিৎসকদের বক্তব্য, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষিতার ডাক্তারি পরীক্ষা হওয়া উচিত। অভিযোগকারিণী থানায় আসেন ৮ তারিখ। পরীক্ষা হয় আরও ছ’দিন পরে। (আশার কথা, ২০০৫-এর অক্টোবরে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে ডাক্তারি রিপোর্ট সব সময় অপরিহার্য বলে গণ্য হবে না।)
পুলিশের দাবি, ১০ তারিখেই মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাসপাতাল বলেছিল, মেডিকো-ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছুটিতে। কিন্তু মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ এ দিন বলেন, “ওই বিভাগে একাধিক চিকিৎসক রয়েছেন।”
অভিযোগকারিণী জানান, সেই রাতের পোশাক তিনি ধুয়ে ফেলেছেন। চিকিৎসকদের মত, ধোয়া পোশাক থেকেও কিছু প্রমাণ মিলতে পারত।
অভিযোগকারিণীর দাবি, পুলিশ জানায়, নাইটক্লাবের সিসিটিভি ফুটেজ মুছে গিয়েছে। তাই ওই রাতে তিনি সেখানে ছিলেন কি না, তার প্রমাণ নেই। অথচ পুলিশ এ-ও বলে, সিসিটিভি ফুটেজে এক জন কালো জ্যাকেট পরা মহিলাকে দেখা গিয়েছে।
পার্ক স্ট্রিট থানার এক অফিসার অভিযোগকারিণী এবং তাঁর এক আত্মীয়াকে অকারণে অপমানজনক নানা কথা বলেছেন বলে অভিযোগ।
৮ তারিখে অভিযোগ জানানোর পরে সাত দিন কেটে গিয়েছে। অভিযুক্তদের নাম জানানো সত্ত্বেও কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.