বিকেল তিনটের পরেই যাবতীয় অস্ত্রোপচার বন্ধ। দুর্ঘটনায় আহত রোগীই হন বা সিজার দরকার এমন গর্ভবতী, তিনটের পরে হাসপাতালে এলেই সকলকে রেফার করা হচ্ছে
আর জি করে। এটাই এখন নিয়ম কামারহাটির সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজে। একটি মেডিক্যাল কলেজে অর্ধেক দিন জরুরি অস্ত্রোপচার বন্ধ থাকবে কেন? স্বাস্থ্যকর্তাদের যুক্তি, “কর্মীর অভাব।”
কর্তারা স্বীকার করছেন, কলকাতা-ঘেঁষা উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক হাসপাতালে তিনটের পরে অস্ত্রোপচার বন্ধ করাটাই এখন দস্তুর। অশোকনগর, পানিহাটি, ভাটপাড়া, বরাহনগর, নৈহাটি স্টেট জেনারেলের মতো হাসপাতালে বিকেল তিনটের পরে জরুরি অস্ত্রোপচার না করে ‘অন কল’-এ থাকা চিকিৎসকেরা সব কেস আর জি কর বা কলকাতা মেডিক্যালে রেফার করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রোজ এত রোগীর চাপে নাভিশ্বাস উঠছে আর জি করের।
পরিকাঠামোর দিক থেকে সাগর দত্তের অবশ্য কোনও অংশে পিছিয়ে থাকার কথা নয়। তবু দু’বছর কাটতে চললেও বিকেল তিনটেয় আর কোনও অস্ত্রোপচার না করাটাই গত কয়েক মাস অলিখিত নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অভিযোগ। পরিকাঠামোর গলদের জন্যই ২০১২-এ এমসিআই-এর অনুমোদনের পুনর্নবীকরণের ক্ষেত্রে আটকে গিয়েছিল হাসপাতালটি। স্বাস্থ্য দফতর দ্রুত পরিকাঠামো শুধরোনোর প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় অনুমোদন মিলেছিল।
হাসপাতালের অধ্যক্ষ দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “সার্জন বা অ্যানাস্থেটিস্টের অভাব নেই। সমস্যা হল চতুর্থ শ্রেণির কর্মী, সুইপার ও নার্সের। তাঁরা যথেষ্ট সংখ্যায় না থাকলে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সার্জন থাকলেও ২৪ ঘণ্টা অস্ত্রোপচার চালু করতে পারব না। তাই বাধ্য হয়ে তিনটের পর থেকে সব ওটির কেস আর জি করে পাঠাতে হচ্ছে।”
প্রশ্ন উঠেছে, পরিকাঠামো না থাকায় হলদিয়ার বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে আদালত। সরকার সেই রায়ের পক্ষে। সেই একই যুক্তিতে সাগর দত্ত কেন ছাড় পাবে? কেন একটা মেডিক্যাল কলেজে দুপুরের পর থেকে অস্ত্রোপচার হবে না? স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “চতুর্থ শ্রেণির কর্মীর অভাবেই মূলত সমস্যা হচ্ছে। কিছু জটিলতার জন্য পিএসসি-র প্যানেল থেকে নিয়োগ হচ্ছে না। হেল্থ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড কিছু দিনের মধ্যে কাজ শুরু করলে সমস্যা মিটবে।”
স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সাগর দত্তে ছোট-বড় মিলিয়ে সাকুল্যে আড়াইশোর একটু বেশি অস্ত্রোপচার হয়েছে। সেখানে একটা মেডিক্যাল কলেজে এক মাসে ওই সংখ্যক অস্ত্রোপচার হওয়ার কথা।
কেন এত কম অস্ত্রোপচার? সাগর দত্তের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসকেরা জানান, এই মুহূর্তে ৮ জন সার্জন আছেন। তাঁদের মধ্যে ৩ জন প্রফেসর ও অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তাঁরা পড়াতে ব্যস্ত থাকেন। তাঁদের ‘জব চার্টে’ অস্ত্রোপচারের বিষয়টি থাকে না। ৫ জন অ্যানাস্থেটিস্টের মধ্যে ২ জন শুধু পড়ানোর দায়িত্বে। প্রায় ২০ জন নার্স ছিলেন। তাঁদের ৭-৮ জনকে চিত্তরঞ্জন সেবা সদন ও ইন্দিয়া মাতৃ সদনে ডেপুটেশনে দেওয়া হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ৩ জন। সুইপার ২ জন। তাঁরাই অস্ত্রোপচারের জন্য রোগীকে ট্রলি ঠেলে নিয়ে যাওয়া থেকে ওটি-র যন্ত্র ঠিক করা সব করেন। কর্তৃপক্ষের কথায়, “এ রকম ভাঙাচোরা কর্মী-পরিকাঠামো নিয়ে বিকেল তিনটের পরে জরুরি অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয়।”
স্বাস্থ্য দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, কলকাতা সংলগ্ন উত্তর ২৪ পরগনার অধিকাংশ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে সাত মাসে ৩৫০-৭৫০টি অস্ত্রোপচার হয়েছে। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা প্রলয় আচার্যের কথায়, “অশোকনগর, নৈহাটি, পানিহাটির মতো হাসপাতালে তিনটের পরে কোনও অস্ত্রোপচার হচ্ছে না বলেই সংখ্যাটা এত কম। চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ও নার্স না বাড়ালে সারা দিন ধরে ইমার্জেন্সি অস্ত্রোপচার করা যাচ্ছে না। সিজার কেসও রেফার হচ্ছে।” স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “বিষয়টা বহু দিন থেকেই চলছে। দেখছি কী করা যায়।” |