বাংলাই এখন দাওয়াই দিল্লির
গে ভেবেছে বাংলা। এ বার ভাবুক গোটা দেশ। দিল্লি অন্তত তেমনটাই চাইছে। বাংলার ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলিকে সারা দেশে মডেল হিসেবে দেখতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার।
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পিপিপি মডেল) চালু হওয়া ওই দোকানগুলি থেকে সর্বোচ্চ ৬৭% ছাড় মিলছে দামে। শুধু গরিবরা নন, প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে যে কেউই এই সুবিধা পাচ্ছেন। এতে ক্রেতারা যেমন উপকৃত হচ্ছেন, তেমনই খুশি কেন্দ্রীয় সরকার। কেন্দ্রের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রক রাজ্যের এই ব্যবস্থার প্রশংসাই শুধু করেনি, দেশের সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকায় এই ব্যবস্থা চালু করারও পরামর্শ দিয়েছে।
যদিও এই ব্যবস্থার ভাল-মন্দ নিয়ে বিতর্ক কিন্তু থামেনি এ রাজ্যেই। ওষুধ ব্যবসায়ীদের একাংশ প্রশ্ন তুলছে ওষুধের মান নিয়ে। রয়েছে সব ওষুধ না মেলার অভিযোগও। ন্যায্য মূল্যে যাঁরা ওষুধ বিক্রি করছেন, তাঁদের অবশ্য দাবি, মুনাফায় টান পড়াতেই এ সব অভিযোগ তোলা হচ্ছে।
এই তরজার মধ্যেই মানুষের হাতে ন্যায্য মূল্যে ওষুধ পৌঁছে দিতে রাজ্যের উদ্যোগের প্রশংসা করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের হাসপাতাল বিষয়ক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত আন্ডার সেক্রেটারি সঞ্জয় পন্থ প্রতিটি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত এলাকার স্বাস্থ্যসচিবকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ব্যবস্থাকে হুবহু অনুসরণ করা যেতে পারে। কিংবা প্রয়োজন মতো কিছু বদল করা যেতে পারে। তবে গোটা দেশেই একে মডেল হিসেবে অনুসরণ করা উচিত। স্বাস্থ্যসচিব গত মাসে এই চিঠি পান। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য এতে খুশি।

ন্যায্য মূল্যের ওষুধ
মাস মোট বিক্রি দামে ছাড় উপকৃত রোগী
ডিসেম্বর ৪২ লক্ষ ২৪ লক্ষ ১৪ হাজার ৫০০
জানুয়ারি ১ কোটি ৩০ লক্ষ ৭৬ লক্ষ ৪৫ হাজার
ফেব্রুয়ারি ৩ কোটি ৯২ লক্ষ ২ কোটি ৪০ লক্ষ ১ লক্ষ ৩৪ হাজার
মার্চ ৬ কোটি ৯৪ লক্ষ ৪ কোটি ২৭ লক্ষ ২ লক্ষ ৩৮ হাজার
এপ্রিল ১০ কোটি ২৭ লক্ষ ৬ কোটি ২২ লক্ষ ৩ লক্ষ ১৯ হাজার
মে ১১ কোটি ৮০ লক্ষ ৭ কোটি ৫ লক্ষ ৩ লক্ষ ৫২ হাজার
জুন ১৪ কোটি ৭৭ লক্ষ ৮ কোটি ৯৪ লক্ষ ৪ লক্ষ ১০ হাজার
জুলাই ১৭ কোটি ১৬ লক্ষ ১০ কোটি ৪৩ লক্ষ ৪ লক্ষ ৫৪ হাজার
* ৩৪টি ন্যায্য মূল্যের দোকানে বিক্রির হিসেব টাকায় * তথ্যসূত্র: রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের হিসেব বলছে, ২০১২-র ডিসেম্বর থেকে গত জুলাই পর্যন্ত মাত্র আট মাসে ৩৪টি ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকান থেকে প্রায় ৬৬ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। তাতে ছাড় মিলেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। উপকৃত হয়েছেন ২০ লক্ষেরও বেশি মানুষ। রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য যাকে বলেছেন, “সমালোচকদের জবাব দিতে পেরেছি। এটাই বড় সাফল্য।”
আন্ডার সেক্রেটারি সঞ্জয় পন্থের মতে ৬৭% পর্যন্ত ছাড় দেওয়াটা অভাবনীয়। চিঠিতে এই প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, “এতেই পরিষ্কার হয় ওষুধ উৎপাদকরা কত বেশি এমআরপি (খুচরো বিক্রির ন্যূনতম দাম) নির্ধারণ করছে। লাভের মাত্রা কত বেশি রাখা হচ্ছে।”
মাস তিনেক আগে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রকের সচিব কেশব দেশিরাজু পশ্চিমবঙ্গে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানের কাজ পরিদর্শন করে মুগ্ধ হন। পন্থ জানিয়েছেন, সে সময়ই রাজু বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গ খুব ভাল কাজ করেছে। তাই আমরা চাই সারা ভারত এটাকে মডেল করুক।” পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তা জানান, তামিলনাড়ু, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ডেও ন্যায্য মূল্যের দোকান রয়েছে। তবে সেখানে শুধু গরিবরাই ছাড়ে ওষুধ পান। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রেসক্রিপশন দেখিয়ে যে কেউই সর্বোচ্চ পরিমাণ ছাড় পেতে পারেন।
কেন্দ্রের এই চিঠিতে স্বাভাবিক ভাবেই খুশি স্বাস্থ্য ভবন। এই প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব প্রবীর লাহিড়ী জানান, এমন একটা সময়ে এই চিঠি এল, যখন ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে ছাড়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ ৭১% করার প্রস্তাব পেয়েছে সরকার!
তাঁর দাবি, “এত দিন ৩৫টি দোকানে সর্বোচ্চ ছাড় পাওয়া যেত ৬৭.২৫ শতাংশ। গত সোমবার আরও ৫২টি দোকানের জন্য দরপত্র খোলা হয়েছে। তাতে বিভিন্ন আবেদনকারী সংস্থা ৫৪% থেকে ৭১% পর্যন্ত ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে।” তাঁর সংযোজন, ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে চলতি আর্থিক বছরেই পেসমেকার ও হার্টভাল্ভ মিলবে ছাড়ে। তাতে একটি পেসমেকারের দাম পড়বে ২২ হাজার টাকার মতো।

রাজ্যে ন্যায্য মূল্যের এই সব দোকান খোলার পথে বাধা ও হুমকি এসেছিল নানা মহল থেকে। এখন যখন দিল্লিও স্বীকার করছে, বাংলা এই ক্ষেত্রে গোটা দেশের কাছে দিশারী, তখনও কিন্তু এর বিরোধিতা অব্যাহত। রাজ্যে ওষুধ বিক্রেতাদের বৃহত্তম সংগঠন বেঙ্গল কেমিস্টস অ্যান্ড ড্রাগিস্টস অ্যাসোসিয়েশন-এর দাবি, “মানুষ কম দামের ওষুধ ব্যবহার করে খুশি নন। কারণ, এই ওষুধের মান খারাপ। তাতে অসুখ সারছে না। সরকারি হাসপাতালের প্রেসক্রিপশন নিয়ে তাই অনেকেই বাইরের দোকানে এসে নামী ব্র্যান্ডের ওষুধ দিতে ঝোলাঝুলি করছেন।” সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক তুষার চক্রবর্তীর অভিযোগ, “একটা সংস্থা একটি ইঞ্জেকশন বিক্রি করছে ২০০ টাকায়। সেটাই অন্য সংস্থা দিচ্ছে ৪০ টাকায়। মানের সঙ্গে আপস না করলে এটা সম্ভব নয়।”
তুষারবাবুর অভিযোগ অবশ্য উড়িয়ে দিয়েছেন স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ সচিব। তাঁর পাল্টা দাবি, “এক-একটা ওষুধ সংস্থা উৎপাদন খরচের থেকে ২০০% থেকে ৪০০% পর্যন্ত বেশি দামে ওষুধ বিক্রি করে মুনাফা লোটে।” তিনি বলেন, “ন্যায্য মূল্যের দোকান থেকে আপাতত ১৪২ ধরনের জেনেরিক ওষুধ বিক্রি হচ্ছে। এখানে ক্রেতা সংখ্যা অনেক বেশি এবং বিজ্ঞাপন, মেডিক্যাল রিপ্রেজেনটেটিভ বা মার্কেটিংয়ের জন্য খরচ নেই। তাই লাভ রেখেও এত ছাড় দেওয়া যাচ্ছে।”
তুষারবাবুর পাল্টা অভিযোগ, “ন্যায্য মূল্যের দোকানগুলিতে কার্ডিয়াক ইমপ্লান্ট (যেমন স্টেন্ট) বা প্রস্থেটিক ইমপ্ল্যান্ট কম মেলে। মিললেও দামে প্রচুর কারচুপি হচ্ছে।” যার উত্তরে প্রবীরবাবু বলেন, “১ লক্ষ ১০ হাজারের স্টেন্ট আমরা দিচ্ছি মাত্র ৩৬ হাজারে। ৬৬ হাজারের স্টেন্ট মিলছে ১৯ হাজার টাকায়। শুধু এসএসকেএম হাসপাতালের দোকান থেকেই এই রকম ৮৬টি স্টেন্ট বিক্রি হয়েছে। এতে ব্যবসায়ে টান পড়ায় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন।”
অভিযোগ আরও, ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানগুলিতে অনেক ওষুধ পাওয়া যায় না। পিপিপি বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের উপদেষ্টা গৌতম মজুমদারের অবশ্য দাবি, “ন্যায্য মূল্যের দোকানে ১৪২ ধরনের জেনেরিক ওষুধ বাধ্যতামূলক ভাবে থাকছে। শুধু খুব দামি কিছু ক্যানসারের ওষুধ এখনও রাখা যায়নি।”
স্বাস্থ্য দফতরের দাবি, শুধু জেনেরিক নয়, দামি সংস্থার ব্র্যান্ডেড ওষুধও বাইরের দোকানের চেয়ে কম দামে দিচ্ছে ন্যায্য মূল্যের দোকান। কী ভাবে সেটা সম্ভব হচ্ছে? গৌতমবাবু বলেন, “এই দোকানগুলিতে বিক্রির পরিমাণ বেশি। তাই বেশি ছাড় দিয়েও সংস্থাগুলির পুষিয়ে যাচ্ছে।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.