জেলার কলেজে ফাঁকা পড়ে অর্থনীতির আসন
মর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে বাঙালি যতই গর্ব করুক, যে বিষয়ে তাঁর ওই শিরোপা, সেই অর্থনীতি কিন্তু এ রাজ্যের ছাত্রছাত্রীদের কাছে ক্রমেই সমাদর হারাচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর এখন কলেজে ভর্তির মরসুম। কলকাতা ও সংলগ্ন মফস্সলের কলেজগুলিতে অর্থনীতি পড়ার ঔৎসুক্য তা-ও কিছু রয়েছে। তবে দূরের জেলাগুলিতে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের তালিকায় অর্থনীতি প্রায় নেই।
কলা বিভাগে বাংলা, ইংরাজি, ভূগোল বা সংস্কৃতে অনার্স পড়ার ক্ষেত্রে যেখানে ছেলেমেয়েরা অতি উৎসাহী, সেখানে অর্থনীতিতে অনেক কলেজেই আসন শূন্য থেকে যাচ্ছে। যেমন, কোচবিহার কলেজে বাংলা অনার্সে ৯১টি আসনের জন্য আবেদন করেছেন ১২৫০ জন, ইংরেজিতে ৬৭ আসনে ১১০০ জন, ভূগোলে ৩৬ আসনে ১০০০ জন, সংস্কৃতে ৬১ আসনে ১২০০ জন। আর অর্থনীতিতে? ২৪টি আসনে আবেদনকারী মাত্র ১৫ জন। মালদহ কলেজেও অর্থনীতি অনার্সে ৯৪টি আসনের জন্য আবেদন করেছেন মাত্র ১২ জন। জলপাইগুড়ি প্রসন্নদেব মহিলা কলেজে ২৫ টি আসনের জন্য আবেদনকারী ১২ জন।
জেলার অধিকাংশ ছাত্রেরই এখনও পাখির চোখ স্কুলে শিক্ষকতা।—ফাইল চিত্র।
অর্থনীতি ব্রাত্য কেন? শার্লক হোমস হলে নিশ্চয়ই বলতেন, ‘এলিমেন্টারি, ওয়াটসন।’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পশ্চিমবঙ্গে কলেজ পড়ুয়াদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য স্কুলে শিক্ষকতা। তাই কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে ছাত্ররা এমন বিষয় বাছে, যা স্কুলে পড়ানো হয়। তাতেই বাদ পড়ে যাচ্ছে অর্থনীতি। বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষরা তাই দুষছেন ‘স্কুল সার্ভিস কমিশন’কে। জলপাইগুড়ি প্রসন্নদেব মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ শান্তি ছেত্রী বলেন, ‘‘ছাত্রীদের বোঝাই বাংলা, ইংরেজি, ভূগোল, সংস্কৃতের বাইরে কলা বিভাগের অন্য বিষয় নিয়ে পড়তে। ওদের বক্তব্য, তাহলে পাশ করে বেকারের খাতায় নাম লেখাতে হবে।’’ একই অভিজ্ঞতা বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজের অধ্যক্ষ সোমেশ রায় এবং বহরমপুর কলেজের অধ্যক্ষ সমরেশ মণ্ডলের। দু’জনেরই বক্তব্য, “বিজ্ঞানের বিষয়গুলিতে অনার্স পড়ার প্রবণতা তেমন কমেনি। কারণ, স্কুলে গণিত, ভৌতবিজ্ঞান বা জীববিদ্যার শিক্ষক নিয়োগ হয়। অর্থনীতির শিক্ষকের কোনও পদ নেই, তাই ও বিষয়ে পড়ার আগ্রহও নেই।”
মালদহ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ চৈতালি চট্টরাজ জানালেন, পাস কোর্সেও ছাত্রীরা অর্থনীতি পড়তে চায় না। কোচবিহার কলেজের অধ্যক্ষ পঙ্কজ দেবনাথ অর্থনীতির শিক্ষক। তাঁর আশঙ্কা, “অর্থনীতি বিষয়টাই হয়তো জেলার কলেজগুলো থেকে মুছে যাবে।” মালদহ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ প্রভাস চৌধুরী নিজে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন। তাঁর ব্যাখ্যা, “শুধু স্কুল সার্ভিস কমিশনকে দায়ী করা ঠিক নয়। দায় রয়েছে উচ্চশিক্ষা সংসদেরও। এ বছর থেকে সংসদের নির্দেশে একাদশ শ্রেণিতে কলাবিভাগে সংস্কৃত এবং অর্থনীতির মধ্যে বাছতে হবে যে কোনও একটি বিষয়। অর্থনীতি পড়লে চাকরি নেই, সংস্কৃতে তবু জুটতে পারে। অতএব চুলোয় যাক অর্থনীতি।”
তবে ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ কলকাতা-র অধিকর্তা অচিন চক্রবর্তী বলেন, অর্থনীতি নিয়ে পড়ার জন্য আবশ্যক একাদশ-দ্বাদশে গণিত পড়া। যেহেতু জেলার বহু স্কুলে বিজ্ঞান নেই, তাই স্কুলে গণিতে ভাল করেও কলেজে অর্থনীতি পড়ার সুযোগই হয় না বেশ কিছু ছাত্রের। “পদার্থবিদ্যা বা রসায়ন না থাকলে গণিত পড়ানো দরকার স্কুলগুলিতে,” বলেন অচিনবাবু। অর্থনীতি বিষয়টি ছাত্রদের কাছে অপরিচিত বলে তা ‘কঠিন’, এমন একটা ধারণা থাকার জন্যও অনেকে ঝুঁকি নিতে চায় না, মনে করেন তিনি।
‘লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্স’-এর অধ্যাপক মৈত্রীশ ঘটক মনে করেন, মাধ্যমিক স্তরে অর্থনীতি পড়ানো না-হলে অনেকেই এই বিষয়ের প্রাথমিক ধারণাটুকু ছাড়াই সারা জীবন কাটিয়ে দেবেন। সেটা কাম্য নয়। মৈত্রীশের কথায়, ‘‘বিশ্ব উষ্ণায়ন কী, বায়রন বা জীবনানন্দ কে, গণতন্ত্র কী, না জানলে আপনি পার পাবেন না। অথচ অনেকে গর্ব ভরে বলেন, ‘মুদ্রাস্ফীতি, বাজেট ঘাটতি, দারিদ্ররেখা, এ সব খটমট জিনিস বুঝি না।’ পেশা যাই হোক, বিজ্ঞান-সাহিত্য-রাজনীতি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকলে আমরা শিক্ষিত বা সচেতন নাগরিক হতে পারি না। একই কথা খাটে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও।”
অন্য সমস্যাও রয়েছে। মৈত্রীশের কথায়, “অর্থনীতির প্রাথমিক জ্ঞান না থাকলে রাজনৈতিক নেতাদের জনমোহিনী নীতি বা স্লোগানের ধোঁয়া সরিয়ে দেশের অর্থনৈতিক সমস্যার স্বরূপ আমরা বুঝব না। আমাদের অর্থনীতির হালও ফিরবে না। যেমন, শিল্পায়নের ধরন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে, কিন্তু শিল্পবিরোধী অবস্থান সমর্থনযোগ্য নয়। এই শিক্ষা আমরা অর্থনীতি থেকেই পাই।’’



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.