ঘরানার ব্যাকরণ ভাঙতেই হবে
আপনাকে ক্ল্যাসিকাল জলসায় যেমন দেখা যায়, তেমনি সামপ্লেসএলস, বেসমেন্টেও দেখা যায়। কোন পূর্বায়ন আসল পূর্বায়ন?
এ দু’টোর মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। আমাদের নতুন জেনারেশনের শিল্পীদের মধ্যে যতটা ট্র্যাডিশনাল মূল্যবোধ আছে, তেমনি লিবারাল চিন্তাভাবনাও আছে।

লিবারাল বলেই ইলেকট্রিক সেতার বাজান?
ক্ল্যাসিকাল জলসায় তো বাজাই না। ফিউশনের সময় বাজাই। ওয়েস্টার্ন ড্রামকিটের লাউডনেসের মধ্যে সাধারণ অ্যাকোয়াস্টিক সেতারের রিনরিনে ঝঙ্কার অনেক সময় চাপা পড়ে যায়। সে জন্যেই ইলেকট্রিক সেতার বাজাই। যাতে ঝঙ্কারটা গমগম করে।

প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি অনার্স নিয়ে পাশ করেছিলেন। সেতারি যদি না হতেন, অন্য কী হতেন?
অনেকে বলে আইটি-তে খুব ভাল করতে পারতাম। অনেকে বলে উকিলও ভাল হতে পারতাম। আমার তো ইংরেজিতে লিখতেও ভাল লাগে। মাঝে মাঝে নিজের জীবনের কিছু উপলব্ধি বা কথা লিখে রাখব। যেগুলো আমার অটোবায়োগ্রাফির পার্ট হবে একদিন।

বয়স তো মাত্র পঁয়ত্রিশ। এখনই আত্মজীবনী?
সত্যি কথা বলতে কী আমি এরই মধ্যে জীবনে অনেক কিছু দেখেছি। যেমন ধরুন আমার বাবা, আমার সেতারের প্রথম গুরু পার্থপ্রতিম চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছোটবেলা থেকে দেশবিদেশ ঘুরে বেরিয়েছি। যখন জার্মানি দু’টো ভাগে ছিল, সেই সময় সেখানে গিয়েছি। তখন আমার বারো বছর বয়স। এই অভিজ্ঞতাগুলো তো অমূল্য। লিখে রাখা উচিত।

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পীরা আড়ালে বসে সাধনা করতেই ভালবাসেন। তাঁদেরকে কিন্তু পেজ থ্রি গ্ল্যামারে দেখা যায় না। আপনার ছবি অনেক সময়ই মিডিয়ায় ছাপা হয়, নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা যায়...
আমার জেনারেশনের পরের জেনারেশনের যদি ধারণা হয় যে ক্ল্যাসিকাল মিউজিশিয়ান হলে তো কোনও গ্ল্যামারাস জায়গায় যাওয়া যাবে না তা হলে ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত কালে কালে লোপ পেয়ে যাবে। যে দু’জন মানুষকে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের স্তম্ভ বলা হয়, পণ্ডিত রবিশঙ্কর, উস্তাদ জাকির হুসেন— এঁরা দু’জনেই কিন্তু শিল্পের নানা শাখায় নিজেদের ছড়িয়ে দিয়েছেন। এক সময় চায়ের বিজ্ঞাপনে জাকির হুসেনকে দেখা যেত। আমি বলব উনি সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন। নতুন প্রজন্মকে তবলা আর ড্রামসের ছন্দে আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
সঙ্গীত-রসিকেরা কেউ কেউ অভিযোগ তোলেন রাগ পরিবেশনের সময় আপনি আপনার নিজস্ব ঘরানার ব্যাকরণ থেকে বিচ্যুত হন। কেন এটা?
ঘরানা বাড়ির মতো। সেই বাড়ির কিছু আচার ব্যবহার মানুষের মধ্যে এসে যায়। মানুষের গড়ে ওঠার বয়সে সেই মূল্যবোধগুলো দরকার। কিন্তু একটা সময়ের পর মানুষকে উন্মুক্ত পৃথিবীতে যেতে হয়। তাই চেনা পথের ব্যাকরণ ভাঙতে আমার ভাল লাগে। ব্যাকরণ ভাঙেনি বলে, অন্য সঙ্গীতের সঙ্গে আদানপ্রদান করেনি বলে, কত ঘরানা লোপ পেয়ে গেছে।

শোনা যায় মহিলা ফ্যানের সংখ্যা আপনার প্রচুর। তাদের সামলান কী ভাবে?
ফ্যানেরা নিজেরা নিজেদের সামলে নেন। তা ছাড়া আমাদের সনাতন হিন্দু শাস্ত্রে তো বলাই হচ্ছে প্রেমই সব। আমাদের রোম্যান্টিক প্রেমও কখনও আধ্যাত্মিক জায়গায় চলে যায়। প্রত্যেক শিল্পী কিন্তু গুণগ্রাহী শ্রোতা পছন্দ করেন। সঙ্গীতজগতে পুরুষেরা সঙ্গীতে নারীর অনুপ্রেরণা পেলে খুশি হন। ঘটনাচক্রে পুরুষ শিল্পীদের প্রতি মহিলারা অনেক সময় আকৃষ্ট হন। আমার ক্ষেত্রেও হয়তো সেটা হয়েছে।

ঘটনাচক্রে মানে? আপনি চান না এই সব নারী আপনাকে ঘিরে থাকুক। তবুও তাঁরা আসেন?
না না না। আমি তো তা বলছি না। বরং বলব পুরুষদের সঙ্গে প্রকৃতির নিয়মে মেয়েদের কমিউনিকেশনটা ভাল হয়। আমারও মেয়েদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ভাল হয়। তাই বান্ধবীও অনেক।

আপনার প্রাক্তন বিয়েতে কি সেই পরিণত ভাবটা ছিল না?
বলা যায় সেরা কাজগুলো সেই বিবাহিত সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার পরই হয়েছে।

বন্ধুত্বটাই আসল? শরীর যেমন তেমন ভাবে থাকলেই হল?
না, তা তো বলছি না। শরীরের সম্পর্ক তৈরি হবেই বন্ধুত্বের উৎস থেকেই। আমি তেমন মেয়েরই খোঁজে আছি। পেলে আপনাকেই জানাব।

ভাল লাগে এমন কেউ আছেন?
ভাল লাগে এমন কেউ? তা দেখুন, একবার পুজোয় রানি মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে পুজোয় সেতার বাজিয়েছি। তখন আমার বেশ লেগেছিল। তাই বলে কি আমি রাতদিন ফোন করে বিরক্ত করব ওঁকে? আমি যখন একটা রোম্যান্টিক মিউজিক পিস বানাই কেউ না কেউ আমার কল্পনায় থাকে। সেই কেউ কিন্তু বিশেষ কোনও নারী নয়। অনেক নারী মিলিয়ে মিশিয়ে একটা আদল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহিলাকে দেখে ইন্সপায়ারড হই। আমার মাও আমার অত্যন্ত প্রিয় বান্ধবী।

এই যে লম্বা চুল, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি— এই স্টাইলটা কি নিজে ভেবে করা, নাকি কোনও বান্ধবীর পরামর্শে?
না, কোনও বান্ধবীর পরামর্শে নয়। এক সময় চুল ছোট ছিল, দাড়ি ছিল না। তার পর এখন চুল দাড়ি দুটোই লম্বা। আমরা শিল্পী। শৌখিন মানুষ। আমরা এই রকমই একটু সাজতেগুজতে ভালবাসি। পোশাকআশাকেও একটু শৌখিনতা করি।

কোনও বান্ধবী ট্রিমার উপহার দিয়েছেন? বান্ধবীরা আপনাকে কী বলেন?
বন্ধুবান্ধব অনেকে শুনেছি বান্ধবীদের কাছে আফটার শেভ পায়। আমার দাড়ি আছে বলে ট্রিমার? না কেউ ট্রিমার দেয়নি। বান্ধবীদের বলতে হবে তা হলে ট্রিমার দেওয়ার জন্য।
হা হা হা।


ক্ল্যাসিকাল সেতার বাজানোর পাশাপাশি ফিউশন মিউজিকও করেন। ভারসাম্য রাখেন কী ভাবে?
ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্সে যখন বাজাতে যাই তখন যে রাগটি আমি বাজাতে চলেছি সেটাকেই ঈশ্বরের মতো মনের মধ্যে সর্বোচ্চ স্থানে বসাই। এবং এক কি দেড় ঘণ্টার একটা ফর্ম্যাট তৈরি করি মনে মনে। যখন ফিউশন করছি, ধরুন শিবমণির সঙ্গে বাজাতে যাচ্ছি তখন সেই ফর্ম্যাটটাকে নিয়ে আসি এক দেড় মিনিটের স্প্যানে। ‘ক্ল্যাসিকুল’ বলে আমার একটা কনসেপ্ট আছে। তার প্রজেক্ট এটা। আর শঙ্কর মহাদেবনের সঙ্গে আর একটা ব্যান্ড আছে যার নাম স্ট্রিংস্ট্রাক।

আপনি যেমন বাবার কাছে তালিম নিয়েছেন তেমনি আলি আকবরের কাছেও তো বাজনা শিখেছেন...
দু’জনেই আমার সেতারের গুরু। দীর্ঘদিন আলি আকবর খান সাহেবের কাছে তালিম নিয়েছি। আর পণ্ডিত অজয় চক্রবর্তীর কাছে অনেক রকম গানের বন্দিশের তালিম নিয়েছি।

হঠাৎ গানের তালিম নিতে গেলেন সেতারি হয়ে...
ইনস্ট্রুমেন্ট বাজালেও গানের তালিম নেওয়া উচিত। ভেতরে ভেতরে যে গানটা শিল্পী গাইতে থাকেন সেইটাই তো বাজনায় ফুটে ওঠে। এমনকী গান না শিখলে তবলাও বাজানো যাবে না।

এক সময় উস্তাদ বিলায়েৎ খান সাহেব সেতারের সঙ্গে গান গাইতেন। তা নিয়ে শ্রোতারা কেউ কেউ কঠোর সমালোচনা করতেন। কারও বা ভালও লাগত...
উস্তাদ বিলায়েৎ খান সাহেব অত্যন্ত ভাল গান করতেন। ওঁর রেকর্ডেও মাঝে মাঝে গান শুনেছি। উনি যে গান শোনাবার জন্য গান শোনাতেন, তা কিন্তু নয়। সেতারের বন্দিশটা সঙ্গীতময় গান গেয়ে বুঝিয়ে দিতেন। আমিও মাঝে মাঝে গান গাই। তবে হ্যাঁ, যাঁদের গলা তেমন ভাল নয়, তাঁদের বাজনার সঙ্গে গান না গাওয়াই উচিত।

কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনি উস্তাদ বিলায়েৎ খানের বাজনার খুব অনুরাগী...
কী ভাবে বলি এটা। বিলায়েৎ খানের সেতার যদি আমার মিষ্টি প্রেমিকা হয়, তা হলে রবিশঙ্করের সেতার বাজনা আমার প্রাণের ঈশ্বর। আর পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনা আমার আদর্শ। আমার বাবা তো ওঁরই শিষ্য ছিলেন।

ফিউশন মিউজিকে নতুন কী করছেন এখন? জ্যাজ বা র্যাপের সঙ্গে কিছু করছেন?
র‌্যাপের সঙ্গে কিছু করিনি। কিন্তু জ্যাজের দ্বারা অনুপ্রাণিত একটা সিডি রিলিজ করবে আগামী মাসে। নাম ট্রায়ালগ। সেখানে একজন বেলজিয়ান স্যাক্সোফোনিস্ট আর একজন সাউথ আফ্রিকান গিটারিস্টের সঙ্গে বিটভিত্তিক মিউজিক রয়েছে। গান গেয়েছেন শান, কৌশিকী চক্রবর্তী এবং আমি। এ ছাড়া ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্তের একটা কম্পোজিশন আছে।

আপনার সমসাময়িক শিল্পী যাঁরা, যেমন নীলাদ্রি কুমার, বা অনুষ্কা শঙ্কর— এঁদের থেকে আপনি কোথায় স্বতন্ত্র?
ওরা সকলেই খুব ভাল কাজ করছে। কলকাতায় একবার অনুষ্কা একটা ইন্টারভিউয়ে বলেছিল, ‘‘কলকাতায় একজন দুর্ধর্ষ সেতারি আছে। পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়।’’
আমার ইউনিকনেস হল আমার খাঁটি ক্ল্যাসিকাল মিউজিক। এই ভিতটা কোনও দিন ধসে যাবে না। আমার সাঙ্গীতিক চেতনা ঠেকে শিখে গড়ে উঠেছে। তিলে তিলে। পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ যে নিউ এজ ক্রসওভার কাজগুলো করছেন সেগুলো আমাকে প্রভাবিত করেছে। প্রভাবিত করেছে উস্তাদ জাকির হুসেন থেকে পণ্ডিত অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় সকলেই। আমার কোনও গডফাদার ছিল না। এখনও নেই।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.