সিনেমায় খিস্তি দিলেই কিউ হওয়া যায় না
রবীন্দ্রনাথের ‘তাসের দেশ’কে নিয়ে কিউ-য়ের সিনেমাতে এসেছে সমকামিতা।
বিতর্কিত পরিচালকের মুখোমুখি প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
|
অনেকেই ভাবছেন কিউ-য়ের ‘তাসের দেশ’ মানেই এতে প্রচুর নগ্নতার দৃশ্য থাকবে। সেটা কি ঠিক?
ফিল্মটা U/A সার্টিফিকেট পেয়েছে। তবে প্রচুর নগ্নতা রয়েছে বলাটার পিছনে একটা সামাজিক ‘মায়োপিয়া’ কাজ করে। অবদমিত কামনার জায়গা থেকে এটা বলা হচ্ছে। যৌনতা নিয়ে আমার সিনেমাতে কাজ রয়েছে। যৌন পরিচয়ের রাজনীতি নিয়ে কথা রয়েছে। আর তার সঙ্গে অন্য অনেক কিছু।
সাধারণ দর্শকের কাছে এই ‘যৌন পরিচয়ের রাজনীতি’ শব্দগুলো খুব জটিল নয় কি?
আমি সাধারণ দর্শক বলে কাউকে চিনি না। একজন মানুষের সাধারণ বা অসাধারণ হওয়াটা তাঁর নিজের ব্যাপার। এই যে অনেকে বলেন ‘আমি এই সব আঁতেল জিনিস বুঝি না’— এটা বলার মধ্যে কীসের কৃতিত্ব আছে? আমি তো নিছক আনন্দ দেওয়ার জন্য ছবি করি না। আনন্দ আছে নিশ্চয়ই। তবে আমার সিনেমা দেখতে গেলে মগজটাও চালাতে হবে। এই সারা ক্ষণ বলা যে সাধারণ মানুষ বুঝবে না— এর পিছনে ভোগবাদের একটা বিরাট চক্র রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের নাটকে সমকামিতার আভাস পেলেন কী ভাবে?
রাজপুত্র আর সদাগরপুত্রের সম্পর্কের মধ্যে একটা পুরুষচেতনা কাজ করছে।
সেখানে সমকামিতার জায়গা কোথায়?
কামের জায়গা থাকলে সেখানে কী আর সম কী আর তৎসম। কাম যে কাউকে এফেক্ট করছে। ‘গান্ডু’তে দু’টো ছেলের মধ্যে একটা সম্পর্ক দেখানো হয়েছিল। ওই ফিল্মে আমি সব ধরনের সম্পর্ক দেখিয়েছি। এটা ছিল একটা ‘পাঙ্ক অ্যাঙ্গেল’য়ে বানানো ফিল্ম। নিচু স্তরের নর্দমার জিনিসকে উন্মুক্ত করে দেখিয়েছিলাম। ‘তাসের দেশ’-এ একটা আরাম কেদারা বা বজরায় বসে দেখা। |
পরিচালক কিউ। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
ইংল্যান্ডে বড় পরদায় শার্লক হোমস আর ডক্টর ওয়াটসনের মধ্যে সমকামিতা দেখানো নিয়ে ঝড় বয়ে যায়নি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নাটক আর বাঙালি সমাজ আলাদা...
‘তাসের দেশ’কে খামোখাই বাচ্চাদের নাটক বলা হয়। কেউ বলে ওটা নাকি একটা ‘ফ্লড টেক্সট’। এটা আমি মানি না। যে সময় ‘তাসের দেশ’ লিখেছিলেন সেই সময় উনি ‘শাপমোচন’য়ের মতো একটা বুদ্ধিদীপ্ত লেখা লিখছেন। সেই সময় কেন একটা ‘ফ্লড টেক্সট’ লিখবেন? ‘তাসের দেশ’য়ে একটা বিরাট পরীক্ষা করেছেন। পোস্ট মডার্নিজমের কনসেপ্টটা সেখানে উঠে এসেছে। আমি প্রায় বারো বছর ধরে ‘তাসের দেশ’ নিয়ে কাজ করছি। রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছি। ‘তাসের দেশ’কে নিয়ে বেশ অ্যাডাল্ট প্রোডাকশনও হয়েছে। যেখানে ফ্যাসিবাদ, রাজনীতি দেখানো হয়েছে। যে সময় আর সমাজে রবীন্দ্রনাথ লিখতেন, তখন যে ভাবে একটা প্রসঙ্গে নিয়ে লেখা বা বলা যেত সেটা উনি করেছেন। উনি তো রোম্যান্টিক কবি। তাই সব কিছু একেবারে মুখের উপর বলতেই হবে সেটা নয়। উনি নাটকটার মধ্যে অনেক আভাস রেখে গিয়েছেন।
যেমন?
তিনটে দৃশ্যের কথা বলছি। প্রথমে বলি একটা জায়গাতে আছে, চিরতনি তাঁবুতে ঢুকে একটা দৃশ্য দেখছে। তার পর তিনটি মেয়ের মধ্যে একটা বাগ্বিতন্ডা হয়। সেই কথাবার্তায় এটাও স্পষ্ট হয় যে রুইতনি আর ইস্কাবনির মধ্যে একটা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কটি কোনও শাস্ত্রে অনুমোদন পায়নি। আমার মনে হয় রবীন্দ্রনাথের লেখার এই জায়গাতে এটা স্পষ্ট যে, যে কোনও সময় যে কোনও সমাজেই মানুষ মানুষকে ভালবাসে। লিঙ্গ নির্বিশেষে এই ভালবাসার প্রকাশ পেয়েছে।
শেষ দৃশ্যের কথা বলছি। একটা সংলাপে প্রশ্ন করা হয়েছে: ‘এ কী সভ্যগণ, তোমাদের দেখে চেনা যায় না? কোনও সাজপোশাক নেই?’ তখন সভ্যগণ সমস্বরে বলছে: ‘দোষ নেই, সাজ গেল খসে। সেগুলো রাস্তায় রাস্তায় ছড়িয়ে আছে।’ এই জায়গাটা তো ষাটের দশকের ভালবাসার বিপ্লবের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আর একটা দৃশ্য হল যেখানে রুইতনকে হরতনি মোহের জালে আচ্ছন্ন করছে কুঞ্জবনে। এই ফন্দিটা হরতনিকে দিয়েছিল রাজপুত্র। কানে কানে বলে দিয়েছিল ‘কুঞ্জবনে এসো একা’। এই লাইনটি পড়ে ভাববেন না যে রবীন্দ্রনাথ এখানে রোম্যান্টিক একটা সম্পর্কের ইঙ্গিত করেছেন। ওখানে যাওয়ার কারণ হল নিজের সত্তা এবং যৌন আত্মপরিচয়কে আবিষ্কার করা। সেই আবিষ্কারে পুলকিত হরতনি রুইতনের কাঠখোট্টা সৈনিক ব্যবহারকে অগ্রাহ্য করে তাকে মোহের জালে আবদ্ধ করতে সক্ষম হয়।
এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের নাটক অবলম্বনে একটি বাংলা ছবিতে সাহসের পরিচয় দেখিয়ে আপনি এক পুরুষের কামোত্তেজনাকে এ ভাবে দেখিয়েছেন...
আমার সিনেমাতে শরীর একটা মাধ্যম। কোনও একটা বিশেষ দৃশ্যে যদি অভিনেতা-অভিনেত্রী পুরোপুরি নিজেদের সমর্পণ করতে পারে তাঁদের চরিত্রের কাছে, তা হলে এটা করাটা অসুবিধার নয়। এই দৃশ্যে ঋ আর ইমাদ শাহ (নাসিরুদ্দিন শাহের ছেলে) স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অভিনয় করতে গিয়ে নিজেদের শরীর ব্যবহার করেছেন।
এ রকম সাহসী দৃশ্য! ভয় শব্দটা আপনার অভিধানে নেই?
ভয় এই নিয়েই যে, সমাজ আমার পরিচিতি কিংবা ভাবনাচিন্তাকে যেন নিয়ন্ত্রণ না করে। ‘তাসের দেশ’য়ের প্রথম দিকের একটি শো প্রযোজনা করেছিলেন সরোজিনী নায়ডু। বম্বেতে, ১৯৩৩ সালে। নেতাজিকে উৎসর্গ করা হয়েছিল নাটকটি। প্রথম দিকের কিছু শো-তে রবীন্দ্রনাথ নিজে রাজপুত্রের ভূমিকায় ছিলেন। ওটা ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক একটা নাটক। আমি থাকি পোস্ট মডার্ন একটা যুগে। সিনেমার মাধ্যমে আমি চারপাশের জগৎ সম্পর্কে প্রশ্ন করি। বাঙালিমাত্রেরই রাগ একটু বেশি। সে নিয়ে ভাবলে কি চলে নাকি? অবশ্যই ‘তাসের দেশ’ একটি ইরোটিক ছবি। কিন্তু ইরোটিসিজম নানা রকম ভাবে আমাদের পরদায় দেখানো হয়েছে। ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’র ওই ফরম্যাটে অদৃশ্য করে দিয়ে একটা মাখোমাখো দৃশ্য দেখানো হল। মনে নেই শ্রীদেবীর সেই নীল শাড়ি পরা দৃশ্য? আমার সিনেমাতে শরীরটা দেখানো হয়েছে। স্ট্রেট রিলেশনশিপ, সমকামিতা— এ সব দেখিয়েছি। অনেক চুমু আছে। বাঙালি রেগে যাবে ভেবে চুমু খাওয়া কি বন্ধ করে দিতে হবে নাকি? ভালবাসার বিপ্লব করতে গেলে জামা তোমায় খুলতেই হবে! তবে এটা ভাববেন না যে আমি ‘গান্ডু’ যে ভাবে বানিয়েছিলাম, সে রকম ভাবেই ‘তাসের দেশ’-ও বানিয়েছি। আমি সচেতন ভাবে ‘আ*-বা*’ ছবি বানাই। ‘গান্ডু’ বানিয়ে যদি ভাবি যে এটা সব হলে দেখানো হবে, তা হলে তো প্রথমে নিজেকেই ওটা ভাবব। ওই সময়, ওই বিষয় নিয়ে আমি ও ভাবে ছবি বানিয়েছি। ‘গান্ডু’তে সামনে থেকে নগ্ন শরীর দেখানো হয়েছিল। ‘তাসের দেশ’-এ তা নেই। |
সমকামিতার দৃশ্যে টেক্কানি আর ইস্কাবনি। অভিনয়ে রক্সান আর মায়া |
বিজ্ঞাপন জগতে আপনার পুরনো সহকর্মীরা মাঝে মধ্যে বলেন: ‘কিউ যা করছে, অনেকটাই গিমিক। ওর এই ঢপটা একদিন সবাই ধরে ফেলবে!’
এটা কানে এসেছে। শুনে বেশ মজা লাগে। আমি যা বলি, তা যদি ঢপই হয়, তা হলে তাঁরা সেগুলো শোনেন কেন? আমি নিজেকে সিরিয়াসলি নিই না। একদম ইগো নেই আমার।
ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত আনন্দplus-এর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন উনি যে ‘তাসের দেশ’-এর সঙ্গীত পরিচালনা শেষ পর্যন্ত করছেন না, সেটা আপনার উচিত ছিল ওঁকে নিজে বলা...
ইন্দ্রদীপ অনেক দিনের বন্ধু। একটা সময় গিয়েছে যখন আমরা দু’জনেই নিজেদের ডেভেলপ করেছি। ও আমার ‘লভ ইন ইন্ডিয়া’ আর ‘বিশ’-এর সঙ্গীত পরিচালনা করেছিল। তবে এটাও ঠিক যে, মিউজিক্যালি আমি অনেকটাই সরে এসেছি। ওকে নিয়ে এই ফিল্মে কাজ না করার সিদ্ধান্তটা আমার নিজের।
আঠাশ বছরের বন্ধুত্বের পরে সেটা খোলাখুলি ওঁকে বলেননি কেন?
সত্তরের দশকে মিক জ্যাগার আর কিথ রিচার্ডস ট্যাবলয়েড পড়ে জানতেন একে অপরের সম্পর্কে কী ভাবছেন। মনে হয় আমি আর ইন্দ্রদীপ ঠিক জায়গাতেই আছি। ওর দিক থেকে ও ঠিক বলেছে।
ইন্দ্রদীপ তো বলছিলেন, ‘স্বচ্ছতা না থাকলে কীসের বন্ধুত্ব বলুন তো? আই প্রেফার স্ট্রেট হিউম্যান বিয়িংস টু ট্যালেন্টেড ডিরেক্টরস’...
দেখা করে এই প্রসঙ্গে কথা বলব, এই ইমোশনে আমি বিশ্বাস করি না। আমার ধারণা ইন্দ্রদীপও করে না। একটা সময় ওর সঙ্গে এক ধরনের কাজ করেছি। সে জায়গা থেকে ভাঙনটা অনিবার্য ছিল। স্বচ্ছতার প্রসঙ্গে না যাওয়াই ভাল। |
হরতনি প্রলুব্ধ করছে রুইতনকে। ভূমিকায় ঋ এবং ইমাদ শাহ |
কেউ আপনাকে স্বার্থপর বলেছেন?
আমি স্বার্থপর নই। আত্মচর্চা করি। নিজের উপর পরীক্ষা করাটাই আমার কাজ।
কিছু পরিচালক ভেবেছিলেন আপনি তাঁদের লড়াইটা করবেন। কিন্তু তাঁরা এখন বলছেন কিউ দল পালটেছেন। স্টারদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করে বলিউডি ঘরানায় চলে গেলেন।
যেখানে অন্য ধরনের পরিচালক সাফল্য পেলেই তাঁর পরের এজেন্ডা হয় কী ভাবে তারকাদের অভিনেতা বানানো হবে...
যে কোনও সিরিয়াস কাজ করতে সময় লাগে। ইন্ডিপেনডেন্ট সিনেমা বানানো আমাদের দেশে সহজ নয়। বানালেও সেটা দর্শক পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়াটা আরও কঠিন ব্যাপার। ডিসট্রিবিউশন চ্যানেলটা ঠিক করতে সময় লাগবে। এই প্রথম একটা বাংলা ইন্ডিপেনডেন্ট ছবি কলকাতা ও মুম্বইতে যুগ্ম ভাবে মুক্তি পাবে। ২৩ অগস্ট ছবি মুক্তির দিন ঠিক হয়েছে। আর অভিনেতারা আমার কাছে একটা রিসোর্স। তা সে তারকা হোন বা অন্য কেউ। সবাইকে ওয়ার্কশপ করতে হয়।
বাইরের ফিল্মের নিরিখে বাংলা সিনেমাকে কোন জায়গায় দেখেন?
আমি ইন্ডিপেন্ডেন্ট সিনেমা দেখি। আন্তর্জাতিক স্তরে বাংলা সিনেমা মোটামুটি বছর কুড়ি পিছিয়ে আছে। তবে আনন্দের কথা এটাই যে পঞ্চাশ বছর তো পিছিয়ে নেই। টেকনিকালি অ্যাডভান্স কাজ হচ্ছে। ভারতীয় সিনেমার তুলনায় আমরা অবশ্য অনেক দূর এগিয়েছি। বাংলাতে জীবনমুখী সিনেমা হচ্ছে। ঠিক জীবনমুখী গানের মতো। বেশ কিছু পরিচালকের কাজে নিজস্ব ভাষা আছে।
কিছু পরিচালকের ধারণা হয়েছে যে অন্য ধরনের সিনেমা বানাতে গেলে দু’চার কিলো অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করলেই চলবে। এ ভাবে কি তাঁরা কিউ হওয়ার চেষ্টা করছেন?
ভাল গালাগালি দিতে অনেকেই পারে। তবে তার সঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালনার সম্পর্ক ক্ষীণ। দাম্ভিক না হয়েই বলছি সিনেমায় খিস্তি দিলেই কিউ হওয়া যায় না। |
|