সন্ধ্যা নামলেই রেশন ডিলারদের বাড়িতে গিয়ে ধর্না, কিলো পাঁচেক চালের জন্য ঝুলোঝুলি, না হয় দোকান খুলিয়ে আলু-পেঁয়াজ-ডিম কেনার মরিয়া হুড়োহুড়ি।
সাত দিনে পড়া পাহাড় বন্ধে দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং কিংবা পাহাড়ের কোলে ছোট ছোট জনপদগুলিতে এমনই হাহাকারের চেহারা। যা দেখে পাহাড়ের পুরনো বাসিন্দাদের মনে পড়ে যাচ্ছে,
আড়াই দশক আগের সেই সব প্রলম্বিত বন্ধের দিনগুলো।
নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রমেই ফুরিয়ে আসায় ইতস্তত ক্ষোভও চোখ এড়াচ্ছে না। মোর্চা নেতাদেরও এ ছবি নিশ্চয় চোখে পড়েছে। না হলে বাসিন্দাদের নিরস্ত করা তো দূরের কথা, বরং ডিলারদের অনুরোধ, এমনকী কড়া নির্দেশও দিচ্ছেন, কেউ যেন খালি হাতে ফিরে না যান। তাঁদের আশঙ্কা, হেঁসেল বন্ধ হলে নিচুতলার কর্মী-সমর্থকদের চাপা ক্ষোভ প্রকাশ্যে এসে পড়তে পারে। বন্ধ চালানোর ‘জেদ’ ধরে রাখতে মোর্চা নেতাদের অনেকেই রাতে বন্ধ ‘উপেক্ষা’র রাস্তায় হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন। |
বস্তুত, বিমল গুরুঙ্গও বুঝতে পারছেন পাহাড়বাসীর ক্ষোভ বাড়ছে। যে কোনও মুহূর্তে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। দলের একাধিক শাখা অফিস থেকে মোর্চার সদর দফতরে ‘সতর্কবার্তা’ দেওয়া হয়েছে। সম্ভবত, সে জন্য শনিবার সকাল থেকে খোদ মোর্চা সভাপতিকে পাহাড়বাসীর হাতে আনাজ, চাল পৌঁছে দেওয়ার জন্য আসরে নামতে দেখা গিয়েছে। দার্জিলিং পাহাড়ের মোর্চার সদর দফতর যেখানে, সেই সিংমারিতে এক ট্রাক স্কোয়াশ আনিয়ে তা নিজে বিলি করেছেন গুরুঙ্গ। মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যেই সেই ট্রাক বোঝাই স্কোয়াশ ফুরিয়ে গিয়েছে। তা না পেয়ে অনেকেই ক্ষোভও দেখিয়েছেন। দেরিতে খবর পেয়ে, এসে অনেকেই দেখেছেন, আনাজের ট্রাক ফিরে গিয়েছে। ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁরা চেঁচামেচি জুড়ে দিয়েছেন, এ ছবিও দেখা গিয়েছে খাস দার্জিলিঙে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে মোর্চা প্রধানকে তখন বলতে হয়েছে, “আজ বেশি দেওয়া গেল না। মাথা পিছু চারটে করে স্কোয়াশ দিয়েছি। সোমবার থেকে অন্য এলাকার বাসিন্দাদের কাছে স্কোয়াশ এবং কুমড়ো বিলি করা হবে। পাহাড়ে যে সব সব্জি উৎপাদন হয় তা সংগ্রহ করে বিলি করা হবে। চিন্তা করবেন না, চাল এবং অন্য খাদশস্যও বিলি করব।”
দার্জিলিং পাহাড়ে সারা বছরই স্কোয়াশ, বিন, কুমড়ো, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর প্রচুর পরিমাণে হয়। কিন্তু, টানা বন্ধের ফলে তা প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। অনেক জায়গায় সব্জি তুলেও ঘরে রাখতে হচ্ছে চাষিদের। ফলে, চাষিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। তার উপরে মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে সরকারের তরফে রেশন বিলির ঘোষণা করায় মোর্চা নেতাদের উদ্বেগও বেড়ে গিয়েছে। মোর্চা সূত্রের খবর, তড়িঘড়ি তাই বিভিন্ন এলাকায় সব্জি পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন তাঁরা।
পাহাড়ের তিন মহকুমার রেশন ডিলারদের কয়েকজন জানান, দিনের বেলায় সে ভাবে লোকজন চাল চাইতে আসছেন না। কিন্তু সন্ধ্যা হলেই থলি হাতে চুপিচুপি দূর-দূরান্তের গাঁয়ের মানুষ এসে একটু চালের জন্য মাথা কুটছেন। কয়েকটি এলাকায় ডিলারদের ঘরে গুদামে মজুত চালও প্রায় শেষ। ডিলারদের অনেকেই জানান, এলাকার মোর্চা নেতাদের অনেকেও চাল দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, কয়েকটি গ্রামে বাসিন্দারা চাল-আনাজ সম্পূর্ণ ফুরিয়ে গেলে ‘যেমন করে হোক’ তা জোগাড়ের ব্যবস্থা করার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন বলে ডিলারদের কয়েকজন অভিযোগ করেছেন।
দার্জিলিং পাহাড়ে এমন দীর্ঘ বন্ধ নতুন নয়। আড়াই দশক আগে, জিএনএলএফ-এর জমানায় টানা ৪০ দিনের বন্ধ দেখেছেন পাহাড়ের মানুষ। তা হলে এ বার এমন হল কেন? জিএনএলএফের একাধিক নেতা জানান, তাঁরা বন্ধ শুরুর আগে পাহাড়বাসীকে দু’মাসের খাবার মজুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু, মোর্চার তরফে মাত্র দু’দিন সময় দিয়ে অনির্দিষ্টকালের বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছে। সেই দু’দিন আবার সমতলে সব দোকানপাট খোলা ছিল না। সেই সঙ্গে এ ক’দিনে পাহাড়ের অধিকাংশ এটিএমেই টাকা ফুরিয়ে গিয়েছে। তাই নিম্নবিত্তদের পাশাপাশি, মধ্যবিত্ত ও উচ্চ আয়ের পাহাড়বাসীর মধ্যেও টানা বন্ধ নিয়ে ক্ষোভ জমছে।
দার্জিলিং পাহাড়ের একটি আবাসিক স্কুলে এখনও রয়েছেন বেশ কয়েকজন শিক্ষাকর্মী। হস্টেলে কয়েকজন দূরান্তের ছাত্রও রয়েছে। ওই শিক্ষাকর্মীদের কয়েকজন জানান, ১৫ অগস্ট বন্ধ শিথিল হলে তাঁরাও সমতলে নেমে যাওয়ার কথা ভাবছেন। কারণ, এখন তাঁদের রুটি, স্কোয়াশের সব্জি আর ডাল ও আলুর তরকারি ছাড়া বিশেষ কিছুই জুটছে না।
কিন্তু, স্কোয়াশও তো এক সময়ে ফুরিয়ে যাবে। তখন? সিংমারিতে মোর্চা অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকজন খালি হাতে ফেরার সময়ে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, “বিমলজি স্কোয়াশ বিলি করছেন, ভাল খবর। কিন্তু যদি বন্ধ আরও বেশি দিন চলে তখন স্কোয়াশ কোথায় পাব? তখন উনি প্রত্যেক পাহাড়বাসীকে খাবার বিলি করতে পারবেন তো?” |