|
|
|
|
বনধ তুলতে গুরুঙ্গদের ৭২ ঘণ্টা বেঁধে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
পাহাড় অচল হওয়ার আট দিনের মাথায় সরাসরি বনধ তোলার সময়সীমা বেঁধে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এ দিন মহাকরণে দাঁড়িয়ে মোর্চা নেতৃত্বের প্রতি তাঁর বার্তা: ৭২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে বনধ তুলুন, আলোচনার পথ খোলা রয়েছে। না হলে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে কঠোর ব্যবস্থা নেবে রাজ্য। আলোচনা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে নিজে আবার দার্জিলিং যেতে পারেন বলেও জানিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে গোর্খা টেরিটোরিয়াল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (জিটিএ)-এর ‘চিফ এগজিকিউটিভ’ পদে কাউকে মনোনীত করার জন্যও তিন দিন সময়সীমা বেঁধে মোর্চার উপরে চাপ বাড়ানোর চেষ্টা করেছেন মমতা।
মুখ্যমন্ত্রী চরমসীমা বেঁধে দেওয়ায় যথেষ্টই চিন্তায় মোর্চা নেতৃত্ব। কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ না করে ‘জনতা কার্ফু’ বলবৎ করার পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিমল গুরুঙ্গ। যদিও একই সঙ্গে ‘রাজ্য দমন নীতি চালাচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, “৭২ ঘণ্টা পরে উনি কী করবেন? উনি কি মানুষকে পেটাতে বলবেন? গুলি চালানোর নির্দেশ দেবেন?” প্রশাসনের একটি অংশ মনে করছে, গুরুঙ্গের এই কথার মধ্যে মরিয়া ভাব রয়েছে। কারণ, লাগাতার বনধকে সফল করতে গিয়ে এর মধ্যেই ঘরে-বাইরে ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে মোর্চা নেতৃত্বকে। ঘরের ভাঁড়ার বাড়ন্ত বহু মানুষের। তাঁরা ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন গুরুঙ্গকে। সন্ধ্যা নামতেই রেশন ডিলারের বাড়িতে ধর্নাও দিচ্ছেন অনেকে।
এই অবস্থায় মমতা যখন বলেছেন, “যথেষ্ট হয়েছে। পাহাড়ে বনধ রাজনীতি সরকার আর সহ্য করবে না,” তখন সেই হুঁশিয়ারি গুরুঙ্গদের আরও খানিকটা কোণে ঠেলে দিয়েছে বলেই প্রশাসনের ওই অংশের বক্তব্য।
মোর্চার অন্দরের খবর, আচমকা এ হেন চরমপত্র পেয়ে কিছুটা হলেও হকচকিয়ে গিয়েছেন গুরুঙ্গ। তবে মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিকে প্রকাশ্যে উপেক্ষাই করেছেন। মোর্চা-প্রধান পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় জানিয়ে দিয়েছেন, দার্জিলিঙে বনধ চলবে। মহাকরণ ছাড়ার আগে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুখ্যমন্ত্রী আবার বলেছেন, “আমি যা বলার বলে দিয়েছি। ৭২ ঘণ্টা পরে আবার আমার কথা বলব।”
অন্যতম প্রধান বিরোধী দল সিপিএম মনে করছে, এই অবস্থায় সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দলের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু এ দিন কোচবিহারে বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ৭২ ঘণ্টা সময়সীমা দিয়েছেন। অন্য দিকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন গুরুঙ্গ। দুই পক্ষের এমন অবস্থানে সমাধান সূত্র বের করা সম্ভব নয়।” |
হাইকোর্টের রায়ের যে অংশ পড়ে শুনিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী |
• যে বা যারা সংশ্লিষ্ট এলাকায় (এখানে পাহাড়) বিমান, রেল ও সড়ক পরিবহণ এবং নাগরিকদের অবাধ যাতায়াতে বাধা দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারকে উপযুক্ত ব্যবস্থা
নিতে হবে।
• টেলিফোন ও টেলিকম পরিষেবা, জল, দুধ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ, দমকল, সংবাদপত্র, হাসপাতাল ও অন্যান্য সরকারি দফতর চালু রাখতে হবে। এই পরিষেবায় যাতে বিঘ্ন না ঘটে, সে জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে। |
|
এ দিন দুপুরে মুখ্যসচিব ও স্বরাষ্ট্রসচিবকে পাশে নিয়ে মমতা বলেন, “আমি কাউকেই শত্রু ভাবি না। আমি মনে করি মানুষের স্বার্থে, দার্জিলিঙের স্বার্থে, শান্তির স্বার্থে ওঁরা (মোর্চা) বনধ প্রত্যাহার করবেন। যদি ৭২ ঘণ্টার মধ্যে বনধ প্রত্যাহার না করেন, তা হলে সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ মতো যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। তাঁরা যেন আমাদের কঠোর হতে বাধ্য না করেন।” তাঁর অভিযোগ, কয়েক জন তাঁদের রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য বনধ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর বক্তব্য, “ভেবেছিলাম ওঁদের সুবুদ্ধি হবে। কিন্তু তা তো দূরের কথা, এখনও পর্যন্ত তাঁরা প্ররোচনা এবং হুমকি দিচ্ছেন। যাঁরা দার্জিলিঙের একটি আসন নিয়ে এই সমস্ত দুষ্টুমি করছেন, তাঁদের মনে রাখতে বলব, ওটা আমাদের ভালবাসার জায়গা।” মোর্চাকে বিঁধে মুখ্যমন্ত্রীর কটাক্ষ, “ভাত দেওয়ার ক্ষমতা নেই কিল মারার গোঁসাই!” আন্দোলনকারীদের তিনি জানিয়ে দেন, দার্জিলিংকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। স্কুল-কলেজে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে। হাসপাতাল-রেশন দোকান খোলা থাকবে। চা বাগানেও কাজ হবে। দার্জিলিঙে যেমন উন্নয়নের কাজ হচ্ছিল, তা চলবে। মমতা বলেন, “কোনও বনধ বা হঠকারিতাকে আমরা সমর্থন করব না। ৭২ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি, আশা করছি দোকানপাটও খুলবে।
আর যদি তা না করে উল্টে প্ররোচনা দেওয়া হয়, তা হলে সংবিধান মেনে, হাইকোর্টের রায় মেনে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে। আমরা ‘এ টু জেড’ সব ব্যবস্থা নেব।” এর পর গুরুঙ্গকে পাল্টা চাপ দেন মমতা। বলেন, “জিটিএ চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেছেন। তার পরের জন যিনি আছেন, তাঁকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়েছে। তিনি কাজ শুরুও করতে পারেন। না হলে আমরা যথোচিত পদক্ষেপ করব।”
দার্জিলিঙের কেবল নেটওয়ার্ক বন্ধের প্রসঙ্গও এ দিন তোলেন মমতা। জানান, কয়েকটি চ্যানেলের নথিপত্র নিয়ে সমস্যা হয়েছে। সে সব দেখালেই চ্যানেলগুলি চালু করা যাবে। তাঁর কথায়, “আমি চাই পাহাড়ের সব ভাইবোন সব চ্যানেল দেখুন। কেউ যদি নিজস্ব চ্যানেলকে ব্যবহার করে, তা হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। সে ক্ষমতা সরকারের আছে।” ঘটনাচক্রে, সরকারের শীর্ষ কর্তাদের নির্দেশে এ দিন বিকেল থেকেই দার্জিলিঙে কেবল সম্প্রচার ফের চালুর অনুমতি দিয়েছে জেলা প্রশাসন। তবে যে দু’টি স্থানীয় চ্যানেলে খবর সম্প্রচার হয়, তাদের এখনও ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, অনুমতিপত্র খতিয়ে দেখার পরেই সম্প্রচার করতে দেওয়া হবে।
কেন্দ্রের প্রতিও মমতার আর্জি, তাঁরা যেন দার্জিলিঙের বিষয়ে মাথা না ঘামান। তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে অনুরোধ করছি, রাজ্যের ব্যাপারে মাথা ঘামাবেন না। রাজ্যকে কাজ করতে দিন।”
মুখ্যমন্ত্রী যখন মহাকরণ থেকে এই বার্তা দিচ্ছিলেন, তার একটু আগেই দার্জিলিং সদরের সিংমারিতে দলীয় অফিসের সামনে এক ট্রাক স্কোয়াশ বিলি করেছেন বিমল গুরুঙ্গ। ঘরে আনাজপাতি ফুরিয়ে গিয়েছে। স্কোয়াশ নিতে এসে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, খাবার কোথা থেকে জুটবে? এই অবস্থায়, মুখ্যমন্ত্রীর চরম বার্তা পেয়ে কার্যত হকচকিয়ে যান মোর্চা নেতৃত্ব। সঙ্গে সঙ্গেই অফিসে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন গুরুঙ্গ। মোর্চার অন্দরের খবর, সেখান থেকে দিল্লিতে থাকা রোশন গিরিদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। বিভিন্ন নেতার সঙ্গে আলোচনার পরে সিদ্ধান্ত হয়, মুখ্যমন্ত্রীকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেওয়া হলেও সুর চড়ানো হবে না। এমনকী, সরকারের তরফে জোর করে দোকানপাট, অফিস খোলানোর চেষ্টা হলে বাধা দিতে গিয়ে যাতে মোর্চার নেতা-কর্মীরা গোলমালে না জড়ান, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। |
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় |
বিমল গুরুঙ্গ |
• ৭২ ঘণ্টার মধ্যে যদি বনধ প্রত্যাহার না করেন, তা হলে সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ মতো যা ব্যবস্থা নেওয়ার নেবে। আমাদের কড়া হতে বাধ্য করবেন না।
• জিটিএ-র নতুন চিফ এগজিকিউটিভ তিন দিনের মধ্যে কাজ শুরু করুন।
• ওরা বলুক, বনধ তুলে কথা বলতে চায়। সরকার কথা বলবে। কথা বলার অনেক লোক আছে। |
• ৭২ ঘণ্টা পরে উনি কী করবেন? মানুষকে পেটাতে বলবেন? গুলি চালানোর নির্দেশ দেবেন? এমন দমন নীতি কিন্তু পাহাড়ের মানুষ পছন্দ করবেন না।
• জিটিএ আইনে পরের চিফ এগজিকিউটিভ নির্বাচনের জন্য এক মাস সময় দেওয়া হয়েছে।
• সময় বেঁধে দিচ্ছেন, আবার আলোচনার কথাও বলছেন। আমরা এখনও রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় রাজি নই। |
|
এর পরেই গুরুঙ্গ ঘোষণা করেন, তাঁরা বনধ চালিয়ে যাবেন। তবে সরকার দোকানপাট, অফিস খুলিয়ে জনজীবন স্বাভাবিকের চেষ্টা করতেই পারে। কিন্তু তাতে লাভ হবে না। কারণ, পাহাড়বাসী নিজেরাই ‘জনতা-কার্ফু’ বলবৎ করবেন। যার অর্থ, পাহাড়ের কেউ রাস্তায় বার হবেন না।
তা সত্ত্বেও রেশন বিলি শুরু হলে তা সংগ্রহ করতে মানুষ রাস্তায় নামতে পারেন। আর মোর্চার অত্যুৎসাহীদের একাংশ তাঁদের রোখার চেষ্টাও করতে পারেন। মোর্চা সূত্রের খবর, সে ক্ষেত্রে সংঘাতের আশঙ্কা রয়েছে। তাই গুরুঙ্গের হুঁশিয়ারি, “আন্দোলন রুখতে দমন নীতি নেওয়া হচ্ছে। আগামী দিনে যদি পাহাড়ে অশান্তি হয়, তার দায় রাজ্য সরকারের উপরেই বর্তাবে।”
পাহাড় নিয়ে যে আলোচনার পথ খোলা রয়েছে, সেই বার্তাও এ দিন দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বলেছেন, “বনধ তুললে তবেই আলোচনা হবে। ওরা বলুক বনধ তুলে কথা বলতে চায়। সরকার কথা বলবে।” একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, “আমি দার্জিলিং গিয়েছি ২৫ বার। দরকার পড়লে আবার যাব।”
এই বার্তা সত্ত্বেও গুরুঙ্গরা কিন্তু রাজ্যের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। বরং চরমসীমার প্রসঙ্গ তুলে তাঁর প্রশ্ন, “৭২ ঘণ্টা পরে উনি কী করবেন? উনি কি মানুষকে পেটাতে বলবেন? গুলি চালানোর নির্দেশ দেবেন? ওঁকে মনে রাখতে হবে, সারা দেশ এ সব দেখছে। এমন দমন-নীতি মানুষ পছন্দ করবেন না।” গত বিধানসভা ভোটে পাহাড় ও লাগোয়া এলাকার বেশ কিছু আসনে তৃণমূলকে সমর্থনের বিষয়টি টেনে এনে মোর্চা সভাপতি দাবি করেন, “উনি মনে রাখবেন, গত বিধানসভা ভোটে বেশ কিছু আসন মোর্চার সমর্থনে জিতেছেন ওঁরা।” এ দিন গুরুঙ্গ বাঙালিদের বিচক্ষণতারও প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, “মমতা মনে রাখবেন, পাহাড়ে কী হচ্ছে, তা বাঙালিরাও দেখছেন। তাঁরা অত্যন্ত বিচক্ষণ। তাঁরা ভালই বোঝেন, কোনটা ঠিক কোনটা ভুল।”
বনধ তুললে মুখ্যমন্ত্রী তো আলোচনায় বসতে রাজি। অনির্দিষ্টকাল বনধও তো চলতে পারে না। তা হলে কেন আলোচনায় বসছেন না? গুরুঙ্গের জবাব, “এক দিকে সময় বেঁধে দিচ্ছেন, আর এক দিকে আলোচনায় বসার ইচ্ছেও রয়েছে বলে জানাচ্ছেন। এটা কেমন ব্যাপার! এখন আমরা রাজ্যের সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি নই।” মোর্চা সভাপতির দাবি, “আমাদের প্রতিনিধিরা দিল্লিতে নানা মহলে ভাল সাড়া পাচ্ছেন। দেখা যাক কী হয়!” |
পুরনো খবর: রাজ্যের কেবল বন্ধের পাল্টা গুরুঙ্গের মোবাইল-হুঁশিয়ারি |
|
|
|
|
|