প্যাঁপোঁওওওও...সানাই বাজছে। বান্ধবীর বিয়ে। মানে আমাদের বন্ধুদের গ্রুপে প্রথম ওর বিয়ে হচ্ছে। আমরা সবাই তখন সেকেন্ড ইয়ার। ওর তো বিয়ে, কিন্তু আমাদেরও মনে কি কম গাবগুবাগুব? বিয়ের কেনাকাটা, তত্ত্ব সাজানো, আমাদের সাজের ডিটেল লিস্টি, বউদি-ছোটমাসিদের থেকে ব্লাউজ জোগাড় করে দু-পাশে টাক সেলাই। তার পর বিয়ের দিনে তো এক-একটি মূর্তিমান গাঢ় লিপস্টিকের ম্যানিকুইন, ওরফে ফুরফুরে প্রজাপতিও বলা যায়! বিদ্যাহস্ত বলছি, সবাই মনে মনে ‘ইস! এ রকম সেজেগুজে আমার কবে বিয়ে হবে রে!’ ভাবছিলাম। তার পর যে কত কী হল, বর এল, বিয়ে হল, ফিশফ্রাই লেনদেন-এ বরপক্ষের সঙ্গে দু’চার জোড়া চোখ চাওয়াচাওয়ি এবং শেষে শকুন্তলার গোল্ড-মেডেলিস্ট ইঞ্জিনিয়ার পতিগৃহে যাত্রা শেষে আমরা রাতজাগা ভাঙা গলায় বাড়ি এলাম।
অষ্টমঙ্গলায় বন্ধু কখন আসবে তার অপেক্ষা না করে আমরাই সব সকাল-সকাল পৌঁছে গেলাম ওর বাড়ি। মেয়ে এল। কিন্তু এ কী! মুখে না আছে ঝলকানি স্মাইল, না আছে চোখের তারায় কিচিরমিচির। সবাই বলল, আসলে বিয়ের পর প্রথম বাপের বাড়ি এসেছে, তাই মন খারাপ। কিন্তু আমার কেমন খটকা লাগল। এটা ঠিক দৈনন্দিন খটমটের গল্প নয়। আরও বড় কিছু।
একলা পেয়ে চেপে ধরলাম। কী কান্না মেয়ের! যেন প্রতারিত হয়েছে। যেন ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে গেছে। কত জিজ্ঞেস করি, কী হয়েছে? তোকে মেরেছে? ওরা খারাপ? নেশা করে? অন্য সম্পর্ক আছে? কী হয়েছে কী? বেশ কিছু ক্ষণ পর যা বলল, তাতে বুঝলাম ওর পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন। আমাদের মিস পারফেক্ট-এর কপালে এ রকম জুটল? যে কিনা হাত নোংরা ছিল বলে ছুরি-কাঁটা দিয়ে ইলিশ মাছ খেয়েছিল আর আমরা পেছনে লাগতে বাকি রাখিনি, তার বাড়ির সব লোক যেখানে সেখানে জোরে শব্দ করে নাক ঝাড়ে! এবং রেলিং, কার্নিশ, রাস্তা, কোনও মানামানি নেই। নাক ঢেকেচেপে ঝাড়ে না। নাক ঝেড়ে হাত ধোয় না।
ওদের নাকি খাবার টেবিলের পাশেই ওয়াশবেসিন। কেউ হয়তো খাচ্ছে, অন্য জন উঠে গিয়ে হাত ধুয়ে, জোরে আওয়াজ করে কুলকুচি করে এবং নাক ঝেড়ে চলে যায়, ঘোয়াক ঘোয়াক করে গয়ের তুলে মুখ ধোয়, আর সবচেয়ে বড় কথা, এই সব জল ছিটকেও আসে। ওর নাড়িভুঁড়ি গুলিয়ে ওঠে। ও এক বার মিনমিনিয়ে বলতে গিয়েছিল। বেদম অশান্তি হয়েছে। ‘বউমা, আমরা কিছু কম লেখাপড়া জানি না। তুমি একটু বেশি বাড়াবাড়ি করছ। আর আমরা তো সাউথ-এর মেয়ে নই যে সব লুকিয়েচুরিয়ে করব। (আমরা যারা দক্ষিণ কলকাতায় বড় হয়েছি তারা সারা জীবন এই খোঁটা খেয়ে থাকি, সাউথ-এর মেয়েরা ঠিক কেন খারাপ বুঝে উঠতে পারি না।) যেটা স্বাভাবিক সেটাকে লুকিয়ে করতে যাব কেন?’ হাইজিন বোঝাতে গিয়েছিল, তাতে ওকে স্ট্যাটিসটিক্স দেওয়া হয়েছে যে ওদের বাড়িতে কেউ নাকি অসুস্থ হয় না। আর সভ্যতা-ভদ্রতা কেবল নাকঝাড়া দিয়ে ডিফাইন্ড হয় না, সে জন্য পড়তে হয় এবং গোল্ড মেডেল পেতে হয়।
ওর হয়তো এতটা লাগত না যদি ওর বর এই গ্রুপে না পড়ত। সিনেমা গিয়েছিল দুজন। সারা ক্ষণ বর রুমালে নাক ঝাড়ল। বাড়ি ফেরার পথে রাস্তায় বার বার হোয়াক করে গলা খাঁকরে থুতু ফেলল। আর গোটা রাস্তা ওকে বোঝাল যে ও ‘ওভার-রিঅ্যাক্ট’ করছে। কিন্তু আমরা তো জানি যে ওর পক্ষে এই ধরনের ব্যাপারস্যাপার মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়া কী কঠিন। এই লোকটার চুমুই ওকে আজীবন সহ্য করতে হবে তো! ওই পরিবারটায় এটিকেট-হীনতাকে সাড়ম্বরে উদ্যাপন করা হয় বলে ওকেও তার অংশ হতে হবে, এটা ওর শিক্ষার পক্ষে হজম করা শক্ত। ও ডুকরে উঠেছিল আরও এক বার, ‘জানিস, সব জানার পর সিনেমা দেখে ফিরে রাত্রে ওর সিকনির রুমাল আর অন্তর্বাস ফেলে দিয়ে খুব ক্যাজুয়ালি বলল: কেচে দিয়ো তো!’ |