দিলীপ সরকারের সুরে ‘শুকতারা আকাশের কোণেতে’ গানটির কথা বলতে গিয়ে আগের একটি লেখায় বলেছিলাম বিষয়টিতে সঙ্গীহারা নিশিজাগরণের উল্লেখ, কিন্তু সুরে সকাল-সকাল ভাব। গান সংক্রান্ত আলোচনায় গানের কথা নিয়ে যত কথা হয়, সুর নিয়ে তার ছিটেফোঁটাও হয় না। সংগীত ‘non-verbal medium’, কথা দিয়ে বোঝানো মুশকিল। ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও দিলীপকুমার রায় সংগীত নিয়ে ভাবনাচিন্তা করেছেন, লিখেছেনও। কিন্তু সাহিত্য বা চলচ্চিত্র বিষয়ক আলোচনায় যেমন খুঁটিনাটি দিক, শব্দ, বাক্যবন্ধ, ছন্দ, রূপকল্প, শট, সিকোয়েন্স, কম্পোজিশন ইত্যাদি নানান বিষয়ে শিক্ষিত মানুষ ক্রমান্বয়ে আরও সহজে আলোচনা করতে পেরেছেন, সংগীত নিয়ে পারেননি। এর একটা কারণ, স্বরলিপির সাহায্য না নিয়ে সংগীত প্রসঙ্গে যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনা অসম্ভব। স্বরলিপি সকলে পড়তে পারেন না। ফলে শুধু স্বরলিপির সাহায্য নিলে ক’জন পাঠক পড়বেন?
বের্টোল্ট ব্রেশ্ট-এর নাটক বাংলা অনুবাদে মঞ্চস্থ হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে ও বাংলাদেশে। কোনও কোনও নাটকে ব্রেশ্ট কুর্ট ভাইল ও হান্স আইজলারকে দিয়ে যে সংগীত করিয়েছিলেন, তাতে তাঁর ‘এলিয়েনেশন’ তত্ত্ব অনুসারে পাশ্চাত্যের প্রথাগত পদ্ধতির বদলে ‘এটোনাল মিউজিক’ ও জ্যাজের স্বরবিন্যাস ব্যবহার করা হয়েছিল। খোদ নাটকের মতো, সংগীতে, গানের সুরেও নতুন আঙ্গিক আনতে চেষ্টা করেছিলেন ব্রেশ্ট। আমাদের দেশে ব্রেশ্টের নাটক হলে আবহ সংগীত ও গানের সুরে আমরা কিন্তু আমাদের দেশের প্রথাগত সংগীতই প্রয়োগ করে থাকি, যেটা একেবারেই ব্রেশ্টীয় নয়। ‘তিন পয়সার পালা’ নাটকটি দেখে মোহিত হয়েছিলাম এক সময়ে। কিন্তু তাতে খানিকটা পালাগানের সুর আর খ্যামটার প্রয়োগ (‘ইচ্ছে করলে হাঙরেরও দাঁত দেখতে পাবে’) বেখাপ্পা লেগেছিল, কারণ ওই নাটকের আধুনিক আঙ্গিকের সঙ্গে ‘ঠাকুর থাকবে কত ক্ষণ/ ঠাকুর যাবে বিসর্জন’ (কয়েক বার আওড়ালেই যে-কেউ তাল আর ছন্দটা বুঝতে পারবেন) তালের গানটি আঙ্গিকের দিক দিয়ে বেমানান মনে হচ্ছিল। মূল জার্মান গানটির সুর-ছন্দ থেকে যে রূপ ও ভাব পাওয়া যায়, সেটির একটা নির্দিষ্ট ফাংশন আছে: প্রচলিত স্বরবিন্যাস থেকে দর্শক-শ্রোতাকে সরিয়ে আনা। প্রচলিত সাংগীতিক অভিজ্ঞতা মানুষকে অভ্যেসের স্বস্তি দেয়। ব্রেশ্ট চান মানুষের স্বস্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বাস্তবের সামনে দাঁড় করাতে। তাই, স্বরসাযুজ্যের অভ্যেস ঘুচিয়ে অপ্রত্যাশিত স্বরবিন্যাসের চ্যালেঞ্জ। |
বাংলা গানটি কিন্তু সুরে তালে নিপাট প্রচলিত ধাঁচায়। কোথায় অস্বস্তি? কোথায় ব্রেশ্টীয় ‘এলিয়েনেশন’? সংগীত-প্রয়োগে নেই। কারণ, আমাদের দেশে সংগীত নিয়ে সিরিয়াস, যুক্তিনির্ভর আলোচনাও নেই। সংগীত ছাড়া আমাদের চলে না, অথচ সংগীতকে আমরা তার যোগ্য মর্যাদা দিতে জানি না।
দস্তুরমত সংগীতশিক্ষা না করে, খেটেখুটে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন না করে, সংগীতে কোনও রকম সৃষ্টিশীল কাজ আলাদা ভাবে না করেই আমাদের দেশের চলচ্চিত্রকাররা তাঁদের ছবিতে সংগীত পরিচালক হতে পারেন। পণ্ডিত ও ইন্টেলেকচুয়ালরা গম্ভীর মুখে সব দেখে যান, শুনে যান। সংগীতের এক অস্বীকৃত জিনিয়াস অলোকনাথ দে বা আজকের বুদ্ধদেব গঙ্গোপাধ্যায় যদি কোনও ছবি পরিচালনা করতেন, ইন্টেলেকচুয়ালদের হাবভাব হত কেমন? ‘বেশ তো করে খাচ্ছিল ‘সহকারী সংগীত পরিচালক’ হিসেবে; বলা নেই কওয়া নেই ছবি পরিচালনা করতে গেল কেন? কী জানে ও ছবির?’ কোনও চলচ্চিত্রকার তাঁর ছবির সংগীত পরিচালনা করলে কিন্তু অনুরূপ প্রশ্ন তাঁর সংগীতশিক্ষা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে উঠবে না।
সংগীত নিয়ে আজও কোনও বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা এ দেশে পাওয়া যাচ্ছে না। ওই মানসিকতাটাই এ দেশে প্রশ্রয় পায়নি বলে রবীন্দ্রনাথের দেড়শোতম জন্মদিন ঘটা করে পালিত হয়, ট্রাফিক সিগনাল থেকেও তাঁর গান বেরোতে থাকে, তাঁর গানের ধরন বা আদৌ সংগীত শেখার বালাই না রেখে যে-কেউ তাঁর গান রেকর্ড করে ফেলতে পারে; কিন্তু বাংলা গানে সুর-তাল-কাঠামোর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের অবদান কী তা নিয়ে কোনও বিশ্লেষণ ও চর্চা হয় না।
গানের সুর দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ কী ধরনের সৃষ্টিশীলতা দেখিয়েছেন, কোথায় কোথায় কী রকম নতুন ও নিজস্ব মাত্রা এনেছেন, তা নিয়ে এখনও বলার মতো কোনও কাজ হয়নি। তেমনি, আধুনিক বাংলা গানের সাংগীতিক বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র নিয়েও কাজ হয়নি আদৌ। আপাতত, সুরকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের আনা একটি অভিনবত্ব নিয়ে একটু মাথা ঘামাব আমরা।
যে-কোনও পরদাকে ‘সা’ মেনে আমরা শুধু শুদ্ধ স্বরগুলিকে যদি নিই, তা হলে সেই স্কেলের শুদ্ধ গান্ধারকে ‘সা’ মেনে আগের শুদ্ধ স্বরগুলি গাইলে বা বাজালে আমরা ভৈরবী রাগটিকে পেয়ে যাব। স্বরপরম্পরার আপেক্ষিকতার নিরিখে এটি সম্ভব। নতুন ‘সা’ থেকে সরগম করে গাইলে ব্যাপারটা আরও স্পষ্ট হবে। আগের শুদ্ধ ‘মা’ হয়ে যাবে নতুন কোমল ‘রে’, আগের ‘পা’ হয়ে যাবে নতুন কোমল ‘গা’, ইত্যাদি। ‘ও যে মানে না মানা’ গানটির সুরে (আমরা যদি আন্তর্জাতিক ধাঁচে ‘পা’ ও ‘সা’-এর সম্পর্কটা মেনে নিই) রবীন্দ্রনাথ শুদ্ধ গান্ধারে আসছেন ‘মানা’তে। আগের ছকটি মাথায় রাখলে আমরা এই পরদায় নতুন সম্ভাব্য স্কেলের ‘সা’টিকে পাব। এ বারে তিনি এমন ভাবে স্বরগুলিকে প্রয়োগ করছেন যে আপেক্ষিক বিবেচনায় ভৈরবী রাগটির আভাস আসছে। ঘটনাটি ঘটে যাচ্ছে চুপিসারে, কোনও রকম ‘এই-দ্যাখো-ভৈরবী এই-দ্যাখো-ভৈরবী’ মার্কা ঘোষণা ছাড়াই। কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর ‘সন্ধ্যামালতী যবে’ গানটি ভীমপলশ্রীর ছাঁদে শুরু করে ‘ভৈরবী সুরে’ কথাটিকে ফেলছেন আক্ষরিক অর্থেই ভৈরবীর মেজাজে। ‘ধ প/ম গ/রে’ এই অবরোহী তানের টুকরোয় বেঁধে। রবীন্দ্রনাথের পদ্ধতি আলাদা। এই গানের সুরে তিনি আগাগোড়া আভাসে বিশ্বাসী। তাঁর আপাত-শুদ্ধস্বরের রচনায় (ব্যতিক্রম কোথাও কোথাও তীব্র মধ্যমের প্রয়োগ, তাও সুস্থিত নয়, ‘পা’-এর সঙ্গে জুড়িতে) সুরের মূল ফ্রেজ-টি ‘গা’-তে শেষ হচ্ছে। আমাদের রাগসংগীতের ব্যবহারিক রীতিতে আমরা যে রাগ-ই গাই (মারওয়া’র মতো দু-একটি রাগের ব্যতিক্রম ছাড়া) ‘সা’ই হয় আমাদের মোকাম। এই গানে শুদ্ধ ‘গা’-এ এসে পৌঁছনোর পৌনঃপুনিকতার কারণে এবং ওই পরদা থেকে আগের শুদ্ধ স্বরগুলিকে ব্যবহার করে ভৈরবীর রং পাওয়া যাচ্ছে বলে শুদ্ধ ‘গা’ই হয়ে উঠতে চাইছে ‘মোকাম’। এই স্বর থেকে মূল শুদ্ধ স্বরগুলিকে প্রয়োগ করলেই পরিবর্তিত স্কেলে আপেক্ষিক ভাবে আমরা ভৈরবীর আভাস পেয়ে যাচ্ছি, ফলে নতুন সপ্তকের হিসেবে আগের শুদ্ধ ‘গা’ যা আপেক্ষিক হিসেবে নতুন ‘সা’ যুক্তিসংগত ভাবেই মোকাম হয়ে উঠতে চাইছে। নতুন একটা রচনাপদ্ধতি রবীন্দ্রনাথ তৈরি করে নিয়েছিলেন এই ভাবে। এর দরুন মূল ‘সা’ থেকে ভৈরবীতে সুর না করেও তিনি তাঁর রচনায় সকালের এই রাগের আভাস দিতে পেরেছেন। আমাদের সম্মিলিত অবচেতনে রাগের সুরগুলি রয়েছে এখনও। তাই গানটির লিরিকে শেষরাতের আভাস থাকলেও সুরে পেয়ে যাই ভোর ও সকালের রং। একই পদ্ধতিতে রবীন্দ্রনাথ ‘মধু-গন্ধে ভরা’ ও ‘আমার রাত পোহালো’ গান দুটিতে সুর প্রয়োগ করেছিলেন।
লক্ষণীয়, উপমহাদেশে খুব কম সুরকারই এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেছেন তাঁদের রচনায়। ব্যতিক্রম সংগীতাচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ও দিলীপ সরকার। রম্যগীতির ‘কে এলে গো গান হয়ে’ গানটিতে জ্ঞানপ্রকাশ প্রয়োগ করেছিলেন এই পদ্ধতি, আর দিলীপ সরকার এটি প্রয়োগ করেছিলেন ‘শুকতারা আকাশের কোণেতে’র সুরে। |