শিল্প যখন ঠোঁটকাটা থাপ্পড়বান়
আজকের হিরো: গুতাই আর্ট ম্যানিফেস্টো
তিহাস ষাট বছর অন্তর বদলে যায়। গত মে মাসে নিউ ইয়র্কের গুগেনহেইম মিউজিয়ামে এক দল পুরনো জাপানি চিত্রশিল্পীর ছবির প্রদর্শনী। জাপানি ছবির জগতে দলটি ‘গুতাই’ নামে পরিচিত। মহাযুদ্ধ, পরমাণু বোমায় ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার পর ১৯৫৪ সালে জাপানি চিত্রশিল্পী জিরো ইয়োশিহারার নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ওই গুতাই আন্দোলন, এ বারেই তার ষাট বছর পূর্তি।
গুতাইয়ের এই হীরকজয়ন্তীতেই ইউরোপ-আমেরিকার শিল্পমহলে জমে উঠেছে তর্ক। কুড়ি-বাইশ বছর আগেও শিল্পের ইতিহাসে ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট’ বলতে পল ক্লি, কানদিনস্কি প্রমুখের কথাই ভাবা হত। গুতাই সেখানে ছিল ফুটনোট। ইউরোপীয় শিল্পের প্রভাবে প্রান্তিক জাপানি শিল্পীদের আন্দোলন। ২০১৩ নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে, শিল্পচর্চার ইতিহাসে কেন্দ্র, প্রান্ত এই হিসাব কেন? ইউরোপ, আমেরিকাই যে শিল্পকলার কেন্দ্র, কে ঠিক করে দিল? আন্দোলন গড়ে ওঠার দু’বছরের মধ্যে ১৯৫৬ সালে ইয়োশিহারা ‘গুতাই ম্যানিফেস্টো’ লিখে তাঁদের স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানিয়েছিলেন।
জাপানি ‘গুতাই’ শব্দটির অর্থ দুই রকম। কংক্রিট বা নিশ্ছিদ্র বাস্তব। অন্য অর্থে এমবডিমেন্ট বা প্রতিমূর্ততা। ‘শিল্পচেতনার নামে এত দিন যাবতীয় নকল, জালজোচ্চুরিকে আমরা ভালবেসেছি। পবিত্র বেদিতে, প্রাসাদে, অ্যান্টিক শপে ডাঁই হয়ে থাকা ওই সব জিনিসের হাত থেকে এ বার মুক্তি নেওয়া যাক,’ ম্যানিফেস্টোর শুরুতেই লিখেছিলেন ইয়োশিহারা।
শিল্প মানেই জালি কেন? ক্যানভাস, রং ইত্যাদি উপাদানের কথা তুলেছিলেন ইয়োশিহারা। জানিয়েছিলেন, মানুষের হাতে ওই সব উপাদান নষ্ট হয়, নিজস্বতা হারিয়ে তারা মিথ্যা সংকেতে পর্যবসিত হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক কোনও স্থাপত্য দেখলে কী মনে হয়? সময়ের ব্যবধানে বা দুর্যোগ, ভুমিকম্পে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সৌন্দর্য? না কি, সেটাই আসল? কৃত্রিম প্রলেপ বর্জিত, সত্য ও সুন্দর রূপ!
ছবি: সায়ন চক্রবর্তী
হিরোশিমা, নাগাসাকি পেরিয়ে রিক্ততার মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু এই জাপানি শিল্পীদের। ফলে, ধ্বংসের মধ্যেও তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন কৃত্রিমতা-বর্জিত সৌন্দর্য। বস্তু বা ‘মেটিরিয়াল’-এর ওপর সেখানে নেই ‘স্পিরিট’ বা চেতনার খবরদারি। পঞ্চাশ-ছুঁইছুঁই বয়সে ইয়োশিহারা ও তাঁর সহযাত্রীরা সকলে যাবতীয় খবরদারি থেকে ‘মেটিরিয়াল’কে মুক্ত করার পক্ষে। স্বাভাবিক! ১৯০৫-এ ওসাকা শহরে জন্মানো, অভিজাত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান ইয়োশিহারা যখন তরুণ, জাপান অন্যতম সেরা সামরিক শক্তি। প্রতিবেশী চিন, কোরিয়া সকলের কাছে ভয়ের, মহাযুদ্ধে অক্ষশক্তির অন্যতম। মহাযুদ্ধের পরই তাই প্রথম জাপানি আর্ট-ম্যানিফেস্টোয় বলা হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের কথা, বস্তুকে মুক্ত করার কথা। ‘গুতাই বস্তুকে বদলায় না, তাকে নতুন জীবন দেয়। চেতনা এখানে জোর করে বস্তুকে নতজানু করে না’, লিখছেন ইয়োশিহারা। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যই তখন সামুরাইদের দেশে নতুন মন্ত্র!
কী রকম ছিল গুতাই শিল্প? ১৯৫৪ সাল থেকে ’৭২ সাল অবধি তার বিস্তার। দুই দশকে প্রায় ৫৯ জন শিল্পী। শিল্পকে মুক্তি দিতে প্রথম দিকে শো করেছেন রাস্তায়, হাটেমাঠে। উল্লেখ্য, শিল্পীরা কেউই রাজধানী টোকিয়োর লোক নন। ওসাকা, কোবে ইত্যাদি শহর থেকে উঠে-আসা। সঙ্গের ছবিটি যেমন তানাকা আতসুয়ো-র আঁকা। ভদ্রমহিলা গুতাই আন্দোলনের অন্যতম ডাকসাইটে শিল্পী, ৯১ বাই ৭৩ সেমি ক্যানভাসে লাক্ষারসে আঁকা উজ্জ্বল রঙে বৃত্তের সঙ্গে আঁকিবুঁকি কেটেছে বিভিন্ন রেখা।
অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট, অবশ্যই! কিন্তু ওই যে বৃত্ত, জাপানি বৌদ্ধ ধর্মে সেটি অনেক সময় ‘সাতোরি’কে বোঝায়। মানে প্রজ্ঞা, বোধি এবং মুক্তি। সাতোরিকে না বুঝে শুধু ধ্যান অভ্যাস করলে কোনও দিনই বোঝা যায় না জেন। ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্টে রং, রেখা, আকার ইত্যাদি ‘পিক্টোরিয়াল এলিমেন্ট’-এর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে আমরা আজও নিশ্চিত নই’, লিখেছিল ম্যানিফেস্টো। জেন বা জাপানি বৌদ্ধ ধর্মই আমাদের বুঝিয়ে দেয়, শূন্য শুধু শূন্য নয়।
শুধু তানাকা নন। বস্তুকে মুক্তি দিতে, শিল্পকলায় নতুনত্ব আনতে গুতাই শিল্পী কাজুও শিরাগা তখন ক্যানভাসে রং রেখে, তুলি ব্যবহার করতেন না। পা দিয়ে সেই রং জোরকদমে চটকে-থেঁতলে ছবিতে নিয়ে আসতেন বর্ণচ্ছটা। শোজো শিমামোতো আবার খেলনা-কামান তৈরি করেছিলেন। তাতে রং ভরে অ্যাসিটিলিন গ্যাসের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে স্প্রে-পেন্টিং। ইয়োশিহারা ম্যানিফেস্টোয় লিখছেন, ‘প্রথম দৃষ্টিতে অনেকে আমাদের শিল্পকে ‘ডাডাইজ্ম’ বলে ভুল করতে পারেন। কিন্তু আমরা অন্য কথা ভাবি। ডাডারা যে কথা ভাবেননি। বস্তুকে মুক্তি দেওয়ার সম্ভাবনা!’
অর্থাৎ, বিস্ফোরণে ধ্বস্ত জাপানের প্রথম ‘আর্ট ম্যানিফেস্টো’ মোটেই নিছক প্রান্ত থেকে উঠে-আসা ইস্তাহার নয়। ইয়োশিহারা সেখানে পরিষ্কার করে দিয়েছেন ডাডাদের সঙ্গে তাঁদের তফাত। সেই পঞ্চাশের দশকে কুর্নিশ জানিয়েছেন সমসাময়িক মার্কিন শিল্পী জ্যাকসন পোলককে। ক্যানভাসকে দেওয়ালে নয়, মেঝেতে রেখে, ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ দিয়ে ঘুরে ঘুরে স্প্রে করতেন পোলক। ‘জ্যাকসন পোলককে আমার শ্রদ্ধা। তেল রং হোক বা এনামেল পেন্ট, সেখানে বস্তুর চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়,’ লিখছেন ইয়োশিহারা। শিল্পের তা হলে দেশ থাকে না, ক্ষমতার কেন্দ্র-প্রান্ত বিভাজন সেখানে নিরর্থক!
শিল্পবেত্তাদের মতে, গুতাই-ই প্রথম কেন্দ্রহীন এক বিশ্ব-সংস্কৃতি অনুভব করেছিল। ইউরো-কেন্দ্রিক মানসিকতা একদা ভেবেছিল, শিল্পকলার কেন্দ্র প্যারিস। তার পর দেখা গেল, নিউ ইয়র্ক। কিন্তু নিউ ইয়র্কের পর? আর সম্ভব নয় নতুন কেন্দ্র। ইয়োশিহারা গুতাই শিল্পকলা নিয়ে পত্রিকাও বের করতেন, পোলকের মৃত্যুর পর দেখা গেল, তাঁর লাইব্রেরিতে সেই পত্রিকার দুটি সংখ্যা। ইয়োশিহারা সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান, সালভাদর দালি, পিকাসো থেকে কানদিনস্কি অনেকের ছবির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। মহাযুদ্ধের আগে, জাপানের রমরমা এবং পরমাণু বিস্ফোরণের পরেও ঘুরে দাঁড়ানোর একটা ছোট্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায় এখানেই। ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে ইউরোপীয় শিক্ষার ওপর জোর! ‘গুহাবাসী আদিম শিল্পকলা অথবা ইম্প্রেশনিজ্ম-এর পরবর্তী চিত্রকলা, এই দুই জায়গাতেই রঙের যথার্থ কুশলী ব্যবহার, সেখানে বস্তু নষ্ট হয়নি।’ কিংবা ‘রেনেসাঁসের শিল্পকলায় যে প্রাণপ্রতিষ্ঠা হয়েছিল, আজ তা মৃতবৎ, প্রত্নতাত্ত্বিক অস্তিত্ব ব্যতিরেকে আর কিছু নেই,’ ম্যানিফেস ষাট বছরের ব্যবধানে, গুতাই নিয়ে নতুন আগ্রহে একটা কথা আজ পরিষ্কার। গুতাই শিল্প একটা নতুন পরিসর খুঁজেছিল। ‘অ্যাবস্ট্রাক্ট আর্ট বা বিমূর্ত শিল্পের গুরুত্ব আমরা মনে করি, একটিই জায়গায়। মানুষের সৃষ্টি-ক্ষমতাকে আমরা বস্তুর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেশাতে চাই, যাতে বিমূর্ত পরিসরকেও আমরা নিশ্ছিদ্র বাস্তবতায় প্রতিমূর্ত করে তুলতে পারি’, লিখেছিল ম্যানিফেস্টো। সেই বিমূর্ততার খোঁজ আজও জারি আছে, আর জারি আছে তার বেপরোয়া প্রথাভাঙা ভঙ্গি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.