পোর্টব্লেয়ার আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী। লেফটেন্যান্ট আর্চিবাল্ড ব্লেয়ার ছিলেন এই ‘পোর্টব্লেয়ার’-এর প্রতিষ্ঠাতা। ১৮৯৬ সালের অক্টোবরে এখানেই তৈরি শুরু হয় সেলুলার জেল-এর। তিন তলা এই জেলখানাটির তারা মাছের ডানার মতো দেখতে সাতটি ডানা একটা সেন্ট্রাল টাওয়ারকে ঘিরে ছড়ানো। ছশো তিরানব্বইটি কক্ষ বা সেল-এর মধ্যে প্রত্যেকটি একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন। একটির দরজা অন্যটির বিপরীত দিকে। ফলে, কয়েদিরা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কহীন ভাবে থাকত। বিচ্ছিন্ন কক্ষ বা সেল থেকেই জেলের নাম হয় ‘সেলুলার জেল’। ১৯০৬ সালে এই জেলের নির্মাণের কাজ শেষ হয়।
এই জেলখানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ফাঁসিঘর। একসঙ্গে তিন জন কয়েদিকে এখানে ফাঁসি দেওয়া হত। ১৯৪৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর নেতাজি এই জেল পরিদর্শন করেন। আন্দামান ও নিকোবরের নতুন নাম দেন, ‘শহিদ ও স্বরাজ দ্বীপপুঞ্জ’। তাঁরই নির্দেশে এই ফাঁসিঘরে মৃতুদণ্ড কার্যকর বন্ধ হয়।
সেলুলার জেল তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল নৃশংস কয়েদিদের নির্বাসন দেওয়া, পরে তা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বন্দিশালায় রূপান্তরিত করা হয়। যেমন ছিল প্যারিসের বাস্তিল দুর্গ। তাই সেলুলার জেলকে বলা হয় ‘ভারতের বাস্তিল’। এই সেলুলার জেলে বিপ্লবী বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, বা উল্লাসকর দত্তরা যেমন এসেছিলেন আলিপুর বোমার মামলার আসামি হয়ে, তেমনই এসেছিলেন উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, গণেশচন্দ্র ঘোষ, দামোদর সাভরকর প্রমুখ তিনশো ছত্রিশ জন স্বাধীনতা সংগ্রামী। যাঁদের নাম সেন্ট্রাল টাওয়ারের ঠিক নীচে লেখা আছে। |
সিঙ্গাপুর যখন জাপানিরা দখল করে নিল, ইংরেজরা আন্দামান নিয়ে চিন্তায় পড়ল। ১৯৪২ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশরা নিশ্চিত হল তারা আর আন্দামান দখলে রাখতে পারবে না। ২৩ মার্চ ভোর পাঁচটার মধ্যে জাপানি নৌবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ইওশিমোরার নেতৃত্বে প্রায় বিনা বাধায় দ্বীপভূমির দখল নিল জাপানিরা। সে সময় যে সব ভারতীয় পুলিশ ওই দ্বীপে ছিল তারা কার্যত জাপানিদের দাস হয়ে পড়ে। জাপানিরা তাদের ক্ষমতা প্রদান করার ফলে তারা দ্বীপভূমির মানুষের ওপরেই নির্যাতন শুরু করে। তাদের প্ররোচনাতেই ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লিগের সদস্যরা ব্রিটিশ গুপ্তচর সন্দেহে বন্দি হয়। জাপানিরা তাদের সেলুলার জেলে রেখে অকথ্য নির্যাতন চালায়। অনেককে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। নারী, শিশুদেরও সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে হত্যা করে।
অবশেষে জাপানের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী হিদেকি তোজো ১৯৪৩ সালের ৬ নভেম্বর আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জকে নেতাজির আজাদ হিন্দ বাহিনীর হাতে সমর্পণ করেন। ৩০ ডিসেম্বর জিমখানা গ্রাউন্ডে ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন নেতাজি। বেজে ওঠে আজাদ হিন্দ ফৌজ-এর জাতীয় সঙ্গীত কদম কদম বঢ়ায়ে যা/খুশি কা গীত গায়ে যা...। কর্নেল এ জি লোগোনোদনকে আন্দামান নিকোবরের চিফ কমিশনার নিযুক্ত করে নেতাজি সে দিন বলেছিলেন, ‘...যাঁরা ব্রিটিশ সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অপরাধে দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত আর তাঁদের মধ্যে শয়ে শয়ে যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত হয়ে এই দ্বীপে বন্দিত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন। ফরাসি বিপ্লবের প্রাক্কালে প্যারিসের বাস্তিল দুর্গ থেকে যেমন প্রথম রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, ভারতের মুক্তিসংগ্রামের প্রাক্কালে তেমনই অশেষ যন্ত্রণাভোগকারী দেশপ্রেমিকদের মুক্তি দান করা হল...। বিপ্লবীদের স্মৃতিতে আন্দামানের নাম রাখলাম, ‘শহিদ’ আর নিকোবরের নাম হল ‘স্বরাজ’।’
১৯৪৩ সালের ২৯ থেকে ৩১ ডিসেম্বর নেতাজি এই তিন দিন এখানে কাটিয়ে ছিলেন নানা কাজে। ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতের একমাত্র ভূখণ্ড এই দ্বীপপুঞ্জ, যা আজাদ হিন্দ বাহিনীর পদস্পর্শে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল।
১৯৪৫ সালের ৬ অগস্ট হিরোশিমা এবং ৯ অগস্ট নাগাসাকি শহর পরমাণু বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। অক্টোবরে ব্রিটিশরা জাপানিদের হাত থেকে আন্দামান কেড়ে নেয়। ‘কৃষ্ণা’ ও ‘বারবুডা’ নামক দু’টি রণতরীতে চাপিয়ে যুদ্ধবন্দি জাপানি সেনাদের মালয় নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৪২ সালে জাপানিরা সেলুলার জেলের চারটি ডানা ভেঙে ফেলেছিল। ওই ভাঙা অংশে এখন গড়ে উঠেছে আন্দামানের সবচেয়ে বড় হাসপাতাল, নাম ‘গোবিন্দবল্লভ পন্থ হাসপাতাল’।
১৯৭৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই ঐতিহাসিক সেলুলার জেলকে ‘ন্যাশনাল মনুমেন্ট’ হিসেবে জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন। |
তথ্য: আন্দামান বিচিত্রা (২য় খণ্ড) |