তোমার একলা মনে হয় না, কেননা তুমি ঢের বড় বড় বিষয় ভাবতে, আলোচনা করতে, সেগুলোকে নিয়ে একরকম বেশ কাটাও। আমরা সামান্য মানুষ, আমাদের একটু গল্পগুজব মানুষজন নিয়ে থাকতে এক এক সময় একটু একটু ইচ্ছে করে। আর যদি তুমি এখানে এসে নড়তে না চাও তবে তুমি যে যে মহৎ বিষয় নিয়ে থাকো তাই সব আমাদের একটু একটু দাও।
জীবনস্মৃতি-তে শিলাইদহ-পর্বে কন্যা বেলার এই অভিমানের কথাগুলো নেই। থাকার কথাও নয়। মাধুরীলতা, শমী কিংবা মৃণালিনী সামান্য মানুষ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিশাল স্মৃতির পটে এই ব্যক্তিগত জীবনের ছবি আঁকা না হওয়ারই কথা। কিন্তু আজ তাঁর মৃত্যুর বাহাত্তর বছর পরে সদ্য-প্রয়াত মেধাবী পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষের যে নির্বাচিত ‘জীবনস্মৃতি’ দেখলাম আমরা, সেখানে সেই ‘সামান্য’ মানুষগুলি বা আরও ‘সামান্য’ ঘটনাগুলি রবীন্দ্রনাথকে দেখার একটা নতুন চোখের জন্ম দিতে পারত।
ঘটনাগুলি ‘সামান্য’, কিন্তু সেই যে সব ‘ঢের বড় বড় বিষয়’, তারই সঙ্গে জড়িয়ে। যেমন, ‘দুই বিঘা জমি’ যিনি লেখেন তিনিই জমিদারি প্রথা তুলে দেওয়া, প্রজাস্বত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লেখেন, ‘আমার যেটুকু অভিজ্ঞতা তাতে বলতে পারি, আমাদের দেশের মূঢ় রায়তদের জমি অবাধে হস্তান্তর করার অধিকার দেওয়া আত্মহত্যার অধিকার দেওয়া।’ ‘রিলিজিয়ন অব ম্যান’ লেখেন যিনি, তিনিই ১৯২৬-এ রোমে মুসোলিনির সঙ্গে দেখা করে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। পরে রম্যাঁ রোলাঁ ফাসিস্ত মুসোলিনির সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথকে জানান। ফাসিস্ত ইতালির বিরুদ্ধে অ্যান্ড্রুজকে লেখা তাঁর খোলা চিঠি পরে প্রকাশিত হয় ‘ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান’ পত্রিকায়। |
কিন্তু তারও একটা পর আছে। চার বছর পরে ইতালির সঙ্গে ‘ঝগড়া মেটাতে’ চেয়ে মুসোলিনিকে লিখছেন রবীন্দ্রনাথই, ‘I earnestly hope that the misunderstanding which has unfortunately caused a barrier between me and the great people you represent, the people for whom I have genuine love, will not remain permanent.’ এবং, রল্যাঁ লিখছেন, ‘তখন রবীন্দ্রনাথ (তাঁর মধ্যে যা দেখে অবাক হয়ে গেলাম) লেগে গেলেন ফ্যাসিবাদের ন্যায্যতা প্রতিপাদন করতে: যদি কোনও জাতি প্রকৃতই নিজেকে চালাতে অক্ষম হয়, তাহলে জনসাধারণের মঙ্গলের জন্যে সাময়িকভাবে বিশেষ বিশেষ স্বাধীনতাকে দমনকারী অনমনীয় কর্তৃত্বের প্রয়োজন তাকে মানতেই হয়।’
সমস্ত বিতর্ক আর অসঙ্গতিকে ‘বিদূষণ’ বলে মার্কা মেরে দিয়ে বিশুদ্ধ রবীন্দ্রনাথকে দেখার যে ছক সেই ছক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেননি ঋতুপর্ণও। শিলাইদহ পর্বের যে ছবি তাঁর ‘স্মৃতি’তে, সেখানে প্রজাবৎসল রবীন্দ্রনাথ ‘জমিদারি পত্রসাহিত্য নয়’ বলে বাবামশায়ের কাছে মৃদু বকুনি খাচ্ছেন। জীবনস্মৃতি-র বাইরের রবীন্দ্রনাথ অবশ্য চন্দ্রময় সান্যাল নামে এক দুঁদে কর্মচারীকে খাজনাবৃদ্ধির সমস্যা সমাধান করার জন্য সোনার চেন উপহার দিচ্ছেন।
তার মানে এই নয় যে, রবীন্দ্রনাথের এই পরিচয়টাই সত্য আর প্রজাদের উন্নতির জন্য তাঁর সব উদ্যোগই মিথ্যে। কিন্তু পুরোটাই তো দেখা দরকার, নানা দিক থেকে দেখা দরকার, তা না হলে আরও একটি প্রেমের গল্প হতে পারে, ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয় না। অথচ ঋতু সেই পথেই হেঁটেছেন। তাঁর ‘ডিরেক্টর্স নোট’-এর প্রথম লাইন: ‘দিস ইজ নট আ ট্রাঙ্কেটেড বায়োগ্রাফি; নর অ্যান অ্যাটেম্ট টু ডিল উইথ দ্য কমপ্লেক্সিটিজ অ্যান্ড কনট্রাডিকশনস অব টেগোর।’ অন্তর্দ্বন্দ্ব, স্ববিরোধের জটিলতাগুলি সযত্নে এড়িয়ে গেলে তো রবীন্দ্রনাথকে আরও ‘ট্রাঙ্কেটেড’ করা হয়!
আসলে, ঋতুপর্ণর এই রবীন্দ্রনাথে ‘দেখা’য় কোনও নতুন নেই, যা আছে তা ‘দেখানো’র নতুনত্ব। আর সেই ‘দেখানো’র সূত্রেই তাঁর আমি বার বার চলে এসেছে ক্যামেরার সামনে, ঢুকে পড়েছে ছবির ফ্রেমে। শ্যুটিং করতে বোলপুর যাওয়ার পথে জল জমেছে রাস্তায়। গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন ঋতুপর্ণ। আমরা দেখলাম তাঁকে আর গ্রামের মানুষকে, ওই ভয়ংকর জমা জল ঠেলে গোচারণ করতে। মনে পড়ে গেল, ছিন্নপত্রাবলী-র ২৯ নম্বর চিঠি, পাণ্ডুয়ার কুঠি যাচ্ছেন তিরিশ বছরের কবি, পাল্কিতে চেপে, ‘রাস্তা অতি ভয়ানক। সর্বত্রই এক-হাটু কাদা— এক এক জায়গায় পিছলের ভয়ে বেহারারা অতি সাবধানে এক-এক পা করে পা ফেলছে। তিন-চার বার তাদের পা হড়কে গিয়েছিল, তাড়াতাড়ি সামলে নিলে।...বরদা নৌকো আসার কোনো সম্ভাবনা না দেখে হুকুম দিলেন, পাল্কি মাথায় করে নদী পার হতে হবে। শুনে বেহারারা অনেকে ইতস্ততঃ করতে লাগল এবং আমার মনেও দয়া এবং কিঞ্চিৎ দ্বিধা উপস্থিত হতে লাগল।...বহু কষ্টে নদী পার হল।...বেশ খানিকটা নিদ্রাকর্ষণ হয়েছে এমন সময়ে হঠাৎ একটা বেহারার পা পিছলে গিয়ে পাল্কিটা খুব একটা নাড়া পেলে...।’ কিন্তু না, ওই ‘একটা’ বেহারার প্রতি ‘কিঞ্চিৎ’ দ্বিধান্বিত দয়া করার যে রবীন্দ্রনাথ তিনি ঋতুপর্ণর দেখা এবং দেখানো— দুইয়েরই বাইরে। অথচ ওই যাত্রাটা রবীন্দ্রনাথকে চেনার পক্ষে বেশি জরুরি ছিল, নোবেল-সংবাদ শান্তিনিকেতনে পৌঁছতে পিয়নের যাত্রাটার চেয়ে।
সত্যজিতের ‘রবীন্দ্রনাথ’ও এই অচেনা, স্ববিরোধী রবীন্দ্রনাথকে দেখায়নি। কিন্তু জন্মশতবর্ষের সেই ললিত আবেগের পরিমণ্ডলে সত্যজিতের দেখাটা ছিল নতুন। কবির চেয়ে বেশি কর্মী, বাঙালির চেয়ে বেশি আন্তর্জাতিক, স্রষ্টার চেয়ে বেশি মানুষের প্রতি দায়বদ্ধ এক মানুষ রবীন্দ্রনাথের সন্ধান করেছিলেন সত্যজিৎ। বিদেশের আর্কাইভ খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন যুদ্ধের নিউজ-রিল। সরকারি নিউজ-রিলের চেয়ে বেশি জোর দিয়েছিলেন বেসরকারি প্যাথে কোম্পানির প্যারিসের অফিসের আর্কাইভের উপরে, কারণ সেন্সরের সম্ভাবনা সেখানে কম। জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের উপলক্ষে তৈরি সেই ছবিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ভারতীয় রবীন্দ্রনাথকে অনুভব করা গিয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পরে সার্ধশতবর্ষ উপলক্ষে তৈরি আর একটি ছবিতে প্রত্যাশা ছিল নতুন করে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়ার।
এক নতুনকে পাওয়া হয়তো গেল। সারাক্ষণ শোক পেয়ে চলা বিমর্ষ এক রবীন্দ্রনাথকে, আর তাঁকে ভালবেসে তাঁরই ফ্রেমে নিজেকে বার বার অযথা ঢুকিয়ে ফেলা এক পরিচালককে। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ছবিটি দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল, ‘যাকে তোমরা ভালবাসা বল সে রকম করে আমি কাউকে কোনোদিন ভালোবাসিনি। বন্ধু বান্ধব, সংসার, স্ত্রী-পুত্র কোন কিছুই কোন দিন আমি তেমন করে আঁকড়ে ধরিনি। ভিতরে এক জায়গায় আমি নির্মম— তাই আজ যে জায়গায় এসেছি সেখানে আসা আমার সম্ভব হয়েছে। তা যদি না হতো, যদি জড়িয়ে পড়তুম তা হলে আমার সব নষ্ট হয়ে যেতো।’
আপন ফ্রেমের রবীন্দ্রনাথে বড় বেশি জড়িয়ে পড়েছিলেন ঋতু, বড় বেশি আঁকড়ে ধরেছিলেন। |