মানুষ প্রদর্শনকামী প্রাণী। কেবল ফিল্ম-তারকা বা মডেলগণ নহে, সাধারণ মানুষও প্রতি পদে নিজেকে সাজাইয়া অন্যের সম্মুখে হাজির করিতে উদ্গ্রীব। শুধু রূপের ক্ষেত্রেই এই স্পৃহা থামিয়া নাই। ঘরে ঢুকিলেই চোখে পড়িবে এমন স্থানে ক্লাস ফাইভের আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় প্রাপ্ত যুগ্ম তৃতীয় স্থানাধিকারীর ট্রফিও সাড়ম্বরে সাজাইয়া রাখা হয়, বাড়িতে অতিথি আসিলে চার বৎসরের বালককে তখনই হাত নাড়িয়া গান গাহিতে বাধ্য করা হয়, পিতামাতা ‘এই প্রদর্শনীর সামগ্রীটিকে কেমন গড়িয়াছি!’ মর্মে অহংদীপ্ত হাস্য করেন। ইদানীং সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটগুলি হু-হু করিয়া জীবনের সিংহভাগ দখল করিয়া, মানুষের এই প্রদর্শন-বাসনার সম্মুখে শত শত নূতন তোরণ খুলিয়া দিয়াছে। এখন কেহ ইচ্ছা করিলে নিজ দিনলিপিটিকেও সর্বসমক্ষে উন্মোচিত রাখিতে পারে, কেহ নিজের শরীরকে, কেহ নিজের ব্যক্তিত্বকে। মানুষের নিজেকে খুলিয়া দিবার প্রবণতা এতই অধিক, না চাহিতেই সে সকল গোপনীয় ও ব্যক্তিগত কণাগুলি উজাড় করিয়া প্রকাশ্য দুনিয়ায় ঢালিয়া দিতেছে, যাহাতে সম্পূর্ণ অচেনা মানুষও তাহার কলঘরে ঢুকিয়া, অন্তরের অন্দরে উঁকি দিয়া তাহার বিচার করিতে পারে। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাইতেছে স্বীকারোক্তির সাইট বা ব্লগ, ঘৃণা প্রকাশের সাইট, নিজ উদ্ভট অভ্যাস লইয়া আলোচনার ক্ষেত্র, এমনকী অনেকে ওয়েবক্যামের সম্মুখে আত্মহত্যা করিতেছে, যাহাতে তাহার জীবনের এই শেষ কাজটি কোটি কোটি মানুষ ইচ্ছা করিলে দেখিতে পারে, অনন্ত কাল, অনন্ত বার। আমেরিকায় এক পুরুষ তাহার স্ত্রীকে গুলি করিয়া হত্যা করিল এবং সেই রক্তাক্ত মৃতদেহের ছবি তুলিয়া ফেসবুকে পোস্ট করিল, নিম্নে লিখিল, ‘সম্ভবত জেলে যাইব বা মৃত্যুদণ্ড পাইব, হে ফেসবুক-জনতা, তোমাদের ভালবাসি, তোমাদের অভাব বোধ করিব, আমাকে তোমরা খবরে দেখিতে পাইবে। স্ত্রী অত্যাচার করিতেছিল, তাই আর সহ্য করিলাম না, আশা করি আমাকে তোমরা বুঝিবে।’ ইহার পর সেই পুরুষ পুলিশের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
ফেসবুক বা অনুরূপ মঞ্চগুলি মানুষকে এক আত্মগুরুত্বের স্বাদ দিয়াছে, যাহা অভূতপূর্ব। নিমেষের মধ্যে সহস্র ভার্চুয়াল বন্ধু পাইয়া সে ভাবিতেছে, জনপ্রিয় হইলাম। রাষ্ট্রপতি যেমন আনমনে পথে ঘুরিয়া বেড়াইতে পারেন না, মহানায়ক যেমন পাঁচমাথা মোড়ে আড্ডা মারিতে পারেন না, নিতান্ত ছাপোষা মানুষ নিজেকে সমস্তরের তীব্র-নেত্রপাতঋদ্ধ মনে করিলে, তাহার যে কোনও ক্রিয়াই একটি ‘পারফর্ম্যান্স’ হিসাবে নিজের নিকটে প্রতিভাত হইবে। তখন সে স্থির করিবে, এই জগতে আর একটি আলোড়ন ফেলিয়া দিবার জন্য আমার বৃহৎ পাপটি সর্বগোচরে আনা অতীব প্রয়োজন। হয়তো সর্বগোচরে আনিবার উত্তেজনা তাহাকে দিয়া পাপটি তড়িঘড়ি করাইয়া লইবে! আর থাকে অভ্যাস। উঠিতে-বসিতে সকলই ভাগ করিয়া লইতেছি, আত্মীয়স্বজন বা বাস্তব মিত্রদের অপেক্ষা অধিক মূল্যবান ভাবিতেছি ফেসবুক-বন্ধুদের, তবে এই বৃহৎ ঘটনা ও তাহার সাফাই, জীবনের এই সন্ধিক্ষণ, তাহাদের গোচরে না আনিয়া কেমন করিয়া পারি? পূর্বে, উগ্রপন্থী গোষ্ঠী হত্যা-চিত্র পোস্ট করিয়াছে, কিন্তু তাহা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে। ব্যক্তিগত জীবনের অঙ্গ হিসাবে নহে। আন্তর্জালের কুপ্রভাব প্রসঙ্গে বহু পণ্ডিত বলিতেন, নিজ যৌনতার ছবিও লোকে স্বেচ্ছায় পোস্ট করিতেছে, ‘আমাকে দেখুন’ বিজ্ঞাপনের ইহার অধিক প্রকট রূপ আর কী হইতে পারে? মানুষ দেখাইতেছে, তাহার প্রদর্শন-লোলুপতার সীমা নির্দিষ্ট করা যাইবে না। |