দক্ষতা বাড়াতে কর্মীদের মনের খোরাক অফিসেই |
বেতো ঘোড়ায় চড়ে যে দৌড়ে জেতা যায় না, আজকের চুলচেরা প্রতিযোগিতার বাজারে তা বিলক্ষণ বুঝছে কর্পোরেট দুনিয়া। আর বুঝছে বলেই কর্মীদের স্বাস্থ্যের জন্য শুধু ‘দায়সারা’ চিকিত্সা বিমায় থেমে থাকছে না তারা। বরং জোর দিচ্ছে শরীর-মনে তাঁদের তরতাজা রাখার উপর। চেষ্টা করছে কাজের ফাঁকে বিনোদনের বড়ি গুঁজে দিতে। যাতে মনে অবসাদ বাসা না-বাঁধে। চাপ আর দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে ফুরফুরে মেজাজে নতুন চ্যালেঞ্জের জন্য তাল ঠুকতে পারেন কর্মীরা। আর তার দৌলতে ফুলেফেঁপে ওঠে ব্যবসার অঙ্ক।
বেসরকারি সংস্থায়, বিশেষত বেশ কিছু বহুজাতিকে এ ধরনের উদ্যোগ একেবারে নতুন নয়। যেমন, কর্মীদের খেলাধুলো, গান-বাজনা, সিনেমা দেখা, এমনকী অফিসে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানোর সুবিধা দেয় গুগ্ল, কোকা-কোলা, এয়ারটেলের মতো সংস্থা। অফিস করিডরেই দু’চার ওভার ক্রিকেট কিংবা বিপণন বিভাগে বিনোদনের অনুষ্ঠান তাই একেবারে অপিরিচিত দৃশ্য নয়। কিন্তু এখন তাদের মতো অতটা না-হলেও এ নিয়ে সচেতনতা বাড়ছে সরকারি দফতরগুলিরও।
কলকাতায় এক ছাদের তলায় বিভিন্ন মানসিক অসুবিধার থেরাপি দেয় মিনু বুধিয়ার অ্যাডলাইফ কেয়ারিং মাইন্ডস। সরকারি ক্ষেত্রে এ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “সম্প্রতি সিআইএসএফ-এর ক্যাম্পাসে কর্মশালা করেছি। এর আগে কর্মশালা হয়েছে শহরের সমস্ত থানার ওসি-দের নিয়ে। এখন সরকারি দফতরেও নজর দেওয়া হচ্ছে মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যার দিকে।”
আসলে কর্মীদের কাছ থেকে ভাল মানের কাজ ঠিকঠাক পরিমাণে পেতে যে তাঁদের মন ভাল রাখা জরুরি, তা বুঝতে পারছে সরকারি-বেসরকারি দুই ক্ষেত্রই। আর সেই কারণেই অফিসের খোলনলচে অন্তত কিছুটা বদলানোর চেষ্টা করছে তারা। |
এ প্রসঙ্গে টমাস কুক-এর মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান এড্রিয়ান উইলিয়ামস বলেন, “অফিসের কাজের বাইরে অন্যান্য কর্মকাণ্ডের সঙ্গে কর্মীদের যুক্ত করা প্রয়োজন। কাজের উপযুক্ত পরিবেশের সঙ্গে চাই বিনোদনও। তবেই তাঁদের কাজের গুণমান ও পরিমাণ বাড়বে।”
অবশ্য ক্রমাগত চাপ আর চাকরি নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণে কর্পোরেট দুনিয়ায় মনের অসুখ যে-ভাবে বাড়ছে, তাতে অফিসের পরিবেশ বদলানো ছাড়া তেমন উপায় নেই বলেই মনে করছেন মনোবিদেরা। বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের সমীক্ষা অনুযায়ী, কর্পোরেট জগতের ২২% কর্মী অবসাদে ভোগেন। তাঁদের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই এর কারণ অফিসের চাপ। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, ৪৫% মানুষ স্রেফ ওই মানসিক চাপের জন্যই অফিস কামাই করেন। ঘুমের সমস্যায় ভোগেন ৭৮%।
বাড়ি আর অফিস সমান তালে সামলাতে গিয়ে এই চাপে আরও বেশি নাজেহাল হচ্ছেন মহিলারা। মনোবিদ জয় রঞ্জন রামের দাবি, গত পাঁচ বছরে অন্তত ৩০% হারে বেড়েছে অবসাদে আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা। তিনি বলেন, “কাজের জগতের চাহিদা মেটাতে গিয়ে অনেক সময়েই পরিবারের দিকে নজর দেওয়ার সময় কম পান মহিলারা। ফলে তৈরি হয় নিজেকে দোষী ভাবার প্রবণতা। সমস্যার শুরু সেখানেই।” শুধু মহিলারা নন, হালফিলে ঘরে-বাইরে সব কিছু নিখুঁত করার চাপ পুরুষদেরও দিশাহারা করে দিচ্ছে বলে মনে করেন মনোবিদ দিনাজ বিলিমোরিয়া।
আর এই সমস্ত কারণেই মনের অসুখের সমস্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২০ সালের মধ্যেই হৃদরোগের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অসুখ হবে অবসাদ। বদলে যাওয়া পারিবারিক ও সামাজিক পরিস্থিতির পাশাপাশি অফিসের চাপও যার অন্যতম কারণ।
ঠিক সেই কারণেই এ নিয়ে নড়ে বসতে বাধ্য হচ্ছে কর্পোরেট দুনিয়া। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞ তুষার বসু জানাচ্ছেন, “সচেতনতা বাড়ছে। অফিসের চাপ সামলাতে নিয়মিত স্ট্রেস ম্যানেজমেন্ট শেখাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা।” এই চাপ থেকে বেরিয়ে আসতে বিলিমোরিয়ার পরামর্শ, “সবাইকে সব কিছু করতে হবে, এমন কোনও কথা নেই। নিজেদের উপর ওই প্রত্যাশা চাপিয়ে দেওয়া অযৌক্তিক।” এমনিতেই বাইরের হাজারো চাপ রয়েছে। তাই অন্তত নিজের উপর চাহিদা চাপিয়ে সমস্যা না-বাড়াতেই পরামর্শ দিচ্ছেন তিনি। |