নদিয়ার মাটির পুতুল, কোচবিহারের শীতলপাটি, বাঁকুড়ার টেরাকোটার কদর বাড়ছে ফ্রান্স-আমেরিকা-জার্মানিতে। কিন্তু যাঁদের হাতের জাদুতে এরা বিশ্বজনের নজর কাড়ছে, সেই গ্রামীণ শিল্পী-কারিগরদের কপাল ফিরছে কই! তাঁরা তো সেই নিত্য অভাব-অনটনের অন্ধকারে খাবি খাচ্ছেন। তাঁদের দুর্দশা কাটাতে রাজ্য সরকারের সহযোগী হিসেবে এগিয়ে এসেছে ইউনেস্কো।
ওই সব গ্রামীণ শিল্পী-কারিগরের পাথরচাপা কপাল যে খুলছে না, তার মূল কারণ চিহ্নিত করে সেটার মোকাবিলা করাই সরকার-ইউনেস্কো যৌথ উদ্যোগের উদ্দেশ্য। হস্তশিল্পীদের চিরবঞ্চনার মূলে আছে মধ্যস্থতাকারীর দল, এক দালালশ্রেণি। শিল্পী-কারিগরেরা নিজেদের তৈরি চোখধাঁধানো হস্তশিল্পের সম্ভার যৎকিঞ্চিৎ অর্থের বিনিময়ে ওই সব মধ্যস্থতাকারীর হাতে তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সেই সব মধ্যস্বত্বভোগীর মাধ্যমে শিল্পপণ্য যাচ্ছে ব্যবসায়ীদের কাছে। বহু গুণ বেশি দামে সেই পণ্য বিক্রি হয়ে যাচ্ছে বিদেশে। দীর্ঘ কাল ধরে চলছে এই ব্যবস্থা। যাঁদের কারুদক্ষতায় মধ্যবর্তী দালালশ্রেণি মুনাফা লুটছে, লাল হয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা, সেই শিল্পী-কারিগরদের দুরবস্থার প্রতিকার হচ্ছে না।
অনটনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না-পেরে তাঁদের অনেকে বংশানুক্রমিক শিল্পসৃজন ছেড়ে দিনমজুরির কাজে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে অনেক হস্তশিল্পের বিলুপ্তির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সেই আশঙ্কা কাটাতে হলে প্রথমে শিল্পী-কারিগরদের অভাব-অনটন দূর করা দরকার। শিল্পী বাঁচলে তবেই বাঁচবে হস্তশিল্প। এটা বুঝেই ওই সব শিল্পপণ্যের ন্যায্য অর্থমূল্য সরাসরি শিল্পী-কারিগরদের হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে চাইছে রাজ্য সরকার। ইউনেস্কোর সাহায্যেই সেটা সম্ভব হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। সেই জন্য রাজ্যের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর প্রথম পর্যায়ে বাংলার নিজস্ব ১০টি হস্তশিল্পকে বেছে নিয়ে একটি প্রকল্প রূপায়ণে নেমেছে। ওই সব শিল্পকে ঘিরেই তিন বছর ধরে প্রকল্প চলবে বলে জানান ক্ষুদ্রশিল্প দফতরের সচিব রাজীব সিংহ।
সেই প্রকল্প কী রকম?
সরকারি সূত্রের খবর, বিভিন্ন জেলায় প্রাথমিক সমীক্ষা চালিয়ে এমন কিছু গ্রামকে বেছে নেওয়া হয়েছে, যেখানে হস্তশিল্পী পরিবারের সংখ্যা বেশি। ওই সব গ্রামের বিভিন্ন শিল্পে দক্ষ বাসিন্দাদেরই বাছাই করা হয়েছে। যেমন, ডোকরা শিল্পের জন্য দরিয়াপুর (বর্ধমান) এবং বিকনা (বাঁকুড়া) গ্রামের ১৫০ পরিবারকে চিহ্নিত করা হয়েছে। একই ভাবে কাঁথাশিল্পের উন্নতির জন্য বীরভূমের চণ্ডীদাস নানুরের ৩০০, কাঠের পুতুলের জন্য বর্ধমানের নতুনগ্রামের ১২০, মুখোশের জন্য পুরুলিয়ার ছারিদার ১০০, টেরাকোটার জন্য বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ার ১০০ পরিবারকে বেছে নিয়েছে সরকার। বাংলার শীতলপাটি, পটচিত্র, মাদুরকাঠি, মাটির পুতুল এবং কাঠের মুখোশ তৈরিতে দক্ষ কিছু পরিবারকেও রাখা হয়েছে ওই বাছাই তালিকায়।
ক্ষুদ্রশিল্প দফতরের এক কর্তা জানান, বাছাই করা কয়েক হাজার পরিবারের শিল্পী-কারিগরেরা শুধু নিরুপদ্রবে শিল্পসামগ্রী গড়বেন না। তাঁরা ‘কারবারি’ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণও পাবেন ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। দেওয়া হবে নকশা তৈরি এবং পণ্য বিপণনের তালিমও। সেই সব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকেই ধীরে ধীরে ‘গ্রামীণ হস্তশিল্প নীড়’-এর মর্যাদা দেওয়া হবে। দফতরের সচিব জানান, ওই সব গ্রাম ‘হস্তশিল্প নীড়’ হয়ে উঠলে ‘বিশ্ব ঐতিহ্যমণ্ডিত স্থান’ হিসেবে সেগুলির নাম ঠাঁই পাবে ইউনেস্কোর তালিকায়। সেই সুবাদে সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে ওই সব জায়গা ‘শিল্প পর্যটন কেন্দ্র’-এর মর্যাদা পাবে। দেশ-বিদেশের পর্যটকেরা এসে সেখানে থাকবেন। গ্রামীণ শিল্পী-কারিগরদের হাতের কাজ নিজের চোখে দেখবেন, হাতে নিয়ে পরখ করবেন। নিজেরা সরাসরি কথা বলবেন শিল্পীদের সঙ্গে। তার পরে দু’পক্ষের দর কষাকষিতে চূড়ান্ত হবে শিল্পপণ্যের দাম। নিজের তৈরি শিল্পপণ্যের অর্থমূল্য নিজের হাতে গ্রহণ করবেন গ্রামীণ শিল্পী।
কিন্তু শিল্পপণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে মধ্যস্থতাকারীদের এড়িয়ে গ্রামের শিল্পী-কারিগরের পক্ষে এ ভাবে ঠিক কত দূর এগোনো সম্ভব?
সচিবের জবাব, “মাঝখানের ওই বাধা দূর করার জন্যই ইউনেস্কোর সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে সরকার। মধ্যস্থতাকারীদের উপরে নির্ভরতা কমাতে শিল্পী-কারিগরদের পেশাগত বিষয়ে নানা ভাবে সাহায্য করবে ইউনেস্কো। বিশ্ববাজারের সঙ্গে কারিগরদের যোগসূত্র গড়ে তুলতে ইউনেস্কো সামিল করবে তাদের সহযোগী বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থা ও সংগঠনকে। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। মহাকরণের খবর, এই বিষয়ে ইউনেস্কোর সঙ্গে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের চুক্তি হবে শীঘ্রই। |