পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামবাংলার আস্থা পাওয়ার পরে লগ্নি টানতে মুম্বই গিয়ে শিল্পপতিদের বার্তা দিয়ে এসেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মহাকরণের দাবি, সেই শিল্প-সম্মেলন সব অর্থেই সফল। তার রেশ ধরে রাখতে এ বার কৃষিক্ষেত্রেও বেসরকারি লগ্নির দরজা খুলে দিতে চাইছে রাজ্য সরকার। এ জন্য নতুন আইন তৈরির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। কী থাকছে সেই আইনে?
প্রস্তাবিত আইনে বলা হচ্ছে, দেশের কোনও বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে রাজ্যের এক বা একাধিক চাষি, কৃষক সমবায় সমিতি অথবা কৃষক সমিতি যৌথ চাষের ব্যাপারে চুক্তি করতে পারবে। চুক্তি হতে পারে কোনও ফসলভিত্তিক, চাষের এলাকাভিত্তিক অথবা একটি নির্দিষ্ট সময়কাল ধরে। এই যৌথ চাষের ফলে উৎপাদিত ফসল সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে বিক্রি করা বাধ্যতামূলক হবে।
পাশাপাশি, কৃষিপণ্য কেনাবেচার জন্য বাজার নির্মাণ করতে বেসরকারি সংস্থাকে লাইসেন্স দেবে সরকার। সেই বাজারে (প্রাইভেট মার্কেট ইয়ার্ড) ফসল কেনাবেচা করা, সংরক্ষণ করা এবং রফতানি করার অধিকার থাকবে ওই সংস্থার। এক স্থান থেকে কৃষিপণ্য অন্যত্র নিয়েও যেতে পারবে তারা।
কৃষিক্ষেত্রে এই সংস্কারের প্রস্তাব দশ বছর আগেই এসেছিল কেন্দ্রের কাছ থেকে। কৃষিতে বেসরকারি পুঁজি আনার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে কৃষি সংস্কার কর্মসূচি চালু করে কেন্দ্র। রাজ্যগুলিকে নতুন কৃষি বিপণন আইন এনে চুক্তি চাষ চালু করতে এবং বেসরকারি কৃষি বাজার নির্মাণের লাইসেন্স দিতে বলা হয়। এই কাজ করলে বার্ষিক অনুদান দেওয়ার কথাও ঘোষণা করে কেন্দ্রে। এ রাজ্যের ক্ষেত্রে যার পরিমাণ ছিল ৪০০ কোটি টাকা। |
কিন্তু তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রের সেই প্রস্তাব মানেনি। কারণ, ফ্রন্টের শরিক দলগুলির কৃষক সংগঠন এই বলে আপত্তি তোলে যে, এর ফলে বৃহৎ পুঁজির অনুপ্রবেশে রাজ্যের কৃষিব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাবে। এর পর ২০০৬ সালে বিপুল সংখ্যাধিক্য নিয়ে ক্ষমতায় এসে কৃষিক্ষেত্রে সংস্কার করতে উদ্যোগী হন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তবে বহুজাতিক সংস্থা মেট্রো ক্যাশ অ্যান্ড ক্যারি-কে পাইকারি ব্যবসা করার লাইসেন্স দিলেও মূল কাজটি শেষ পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার এখন কৃষি সংস্কারের পথে হাঁটতে চাইলেও কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের দু’টি বিষয় মানছে না। প্রথমত, চুক্তিচাষ শব্দটিতে আপত্তি থাকায় নাম পাল্টে চাষি-সংস্থা সমঝোতাকে বলা হচ্ছে যৌথ চাষ। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রের পাঠানো আইনের খসড়ায় চাষি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সরাসরি চুক্তির কথা বলা হলেও রাজ্যের প্রস্তাবিত বিলে সরকারের কিছু ভূমিকা রাখা হচ্ছে। ওই বিল অনুযায়ী ওই চুক্তিতে কৃষি বিপণন দফতরের অফিসারেরাও সই করবেন। পরবর্তী কালে কোনও কারণে চুক্তি নিয়ে বিবাদ তৈরি হলে সালিশি করার এক্তিয়ার থাকবে তাঁদের। সেই সালিশিতে সন্তুষ্ট না-হলে আদালতে যাওয়ার অধিকার সব পক্ষেরই থাকছে।
মহাকরণ সূত্রে বলা হচ্ছে, চাষিদের স্বার্থ রক্ষা করার কথা ভেবেই প্রস্তাবিত আইনটি তৈরি করা হচ্ছে। কোনও বিবাদের ক্ষেত্রে গোড়াতেই যাতে আদালতে যেতে না-হয়, সে জন্য যেমন সরকারি মধ্যস্থতার সুযোগ রাখা হচ্ছে, তেমনই স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হচ্ছে মনে হলে চাষিরা যাতে যে কোনও সময় চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারেন, সেই ব্যবস্থাও থাকছে। এ প্রসঙ্গে কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় বলেন, “চাষিদের স্বার্থরক্ষাই আমাদের প্রধান দায়িত্ব। যৌথ চাষ এবং বেসরকারি বাজার নির্মাণের ক্ষেত্রেও সেটা দেখা হবে।”
কিন্তু বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চাষি বা সমবায় সমিতির চুক্তির মাঝে সরকারে কেন থাকবে, সেই প্রশ্ন উঠছে। কেন্দ্র এমন আইনে সন্তুষ্ট হয়ে অনুদান দেবে কিনা, সেটাও প্রশ্ন। তা ছাড়া, আইন যদি শুধু চাষির স্বার্থই রক্ষা করে তা হলে বেসরকারি সংস্থাগুলি লগ্নিতে কতটা আগ্রহী হবে? এর আগে গোটা রাজ্যে ৬৫টি কিষাণ মান্ডি তৈরি করার কথা ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই মান্ডিগুলির জন্য বেসরকারি পুঁজি আনার চেষ্টাও হয়েছিল। কিন্তু সরকারি নিয়ন্ত্রণের কারণেই যে কোনও সংস্থা ওই মান্ডির ব্যাপারে আগ্রহী হয়নি, সে কথা কবুল করছেন রাজ্যের কৃষি কর্তারাই। তবে একই সঙ্গে তাঁদের বক্তব্য, প্রস্তাবিত যৌথ চাষের ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ অনেক কম থাকবে। প্রাইভেট মার্কেট ইয়ার্ডে তো বেসরকারি সংস্থাগুলি সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়াই ব্যবসা করতে পারবে।
যৌথ চাষকে স্বীকৃতি দিতে নতুন আইন আনা হবে, না চলতি ‘পশ্চিমবঙ্গ কৃষি পণ্য এবং বিপণন নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৭২’ সংশোধন করা হবে, তা নিয়ে রাজ্য প্রশাসনে মতান্তর রয়েছে। আধিকারিকদের একাংশের মতে, নতুন আইন করতে হলে বর্তমান আইনটি রাষ্ট্রপতির অনুমতি নিয়ে বাতিল করতে হবে। যা সময়সাপেক্ষ। তবে নতুন বা সংশোধন যা-ই হোক, যৌথ চাষের অনুমোদন দেওয়া হলে কেন্দ্রের কাছ থেকে ৪০০ কোটি টাকা অনুদান এবং কৃষিক্ষেত্রে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেসরকারি লগ্নি পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে আশাবাদী কৃষি বিপণন দফতরের কর্তারা। সব কিছু ঠিক থাকলে বিধানসভার পরবর্তী অধিবেশনেই এই আইন তৈরি হয়ে যাবে বলে মহাকরণ সূত্রের খবর।
কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ফসলের উৎপাদনশীলতা থেকে সংরক্ষণ (কোল্ড চেন ব্যবস্থা), কৃষিজাত দ্রব্যের প্রক্রিয়াকরণ থেকে তা রফতানি কোনও ক্ষেত্রেই গত দু’দশকে এ রাজ্যের তেমন কোনও অগ্রগতি হয়নি। কারণ, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা থেকে বিপণন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে যে পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন, কোনও সরকারের পক্ষে তা সম্ভব নয়। তাই বেসরকারি লগ্নির পথ খুলে দেওয়া দরকার। ১৩টি বড় রাজ্য ইতিমধ্যেই যে কাজ করে ফেলেছে।
তা ছাড়া, এই সংস্কারের সুবাদে কেন্দ্রের কাছ থেকে কৃষি বিপণনের বিকাশের জন্য অনুদান পেলে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে বেহাল কোষাগার নিয়ে জেরবার রাজ্য। |