|
|
|
|
বেলবনির বালিয়াড়িতে জেগে শুধু শহিদবেদি
সুব্রত গুহ • রামনগর |
বালিয়াড়ির মধ্যে একা দাঁড়িয়ে শহিদবেদি। আজও সেখানে কান পাতলে শোনা যায় বিপ্লবতীর্থ কাঁথি মহকুমার রামনগর থানার বেলবনি গ্রামের স্বদেশপ্রেমের গৌরবময় আখ্যান। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ পুলিশের বন্দুকের সামনে বুক পেতেই গ্রামেরই মাটি রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছিল। যে ঘটনাকে স্বয়ং মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ‘বীরোচিত এবং গৌরবময়’ অধ্যায় বলে উল্লেখ করেছিলেন। বিস্মৃতির অন্তরালে হারাতে বসেছে সে কথা। এলাকাবাসীর উদ্যোগে তৈরি শহিদবেদিতে অবশ্য বৃহস্পতিবার ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ৭২তম বর্ষ উপলক্ষে মালা দেন স্থানীয় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকরা। স্মৃতির সরণি বেয়ে পিছিয়ে চলে যান অনেকটা সময়। সেই ১৯৪২ সালে।
৮ অগস্ট মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী ডাক দিলেন ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের। স্বাধীনতার মুক্তি পেতে গোটা দেশের সঙ্গে উত্তাল হল অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলাও। কাঁথি মহকুমায় মাসাধিক কাল চলা সেই অহিংস আন্দোলনে কেঁপে উঠেছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শক্তি। আন্দোলন দমনে পুলিশ নির্বিচারে ধরপাকড় শুরু করল। |
|
অনাদরে। —নিজস্ব চিত্র। |
সঙ্গে অগ্নিসংযোগ, অবাধ লুঠপাট। ২২ সেপ্টেম্বর মহিষাগোটে স্বদেশী জমায়েতে পুলিশের গুলি চালনায় শহিদ হয়েছিলেন ৬ জন। তাঁদেরই দু’জন রামনগর থানার দক্ষিণ শীতলা গ্রামের সর্বেশ্বর প্রামাণিক ও ঘোল গ্রামের রমাপ্রসাদ জানা। এই দুই শহিদের স্মৃতি তর্পণ এবং পরবর্তী কর্মসূচি রূপায়ণে ‘সমর পরিষদে’র সবার্ধিনায়ক বলাইলাল দাস মহাপাত্রের নেতৃত্বে ২৭ সেপ্টেম্বর বেলবনি গ্রামে এক সত্যাগ্রহ শিবির শুরু হয়। ব্রিটিশ পুলিশ রাতের অন্ধকারে সেই শিবিরে এলে স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ছড়ায়। শঙ্খধ্বনির মাধ্যমে বিদ্যুৎগতিতে আশপাশের গ্রামে সেই খবর ছড়িয়ে পড়তেই হাজার হাজার মানুষ বেলবনি শিবিরে ছুটে আসেন। মানুষের ভিড় দেখে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পুলিশ প্রথমে লাঠি চালাতে শুরু করে। জনতাও পুলিশের সঙ্গে পালটা হাতাহাতি ও ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ে। ভয় পেয়ে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে।
পুলিশের গুলিতে বেলবনির ভজহরি রাউত, চন্দ্রমোহন দাস, লালপুরের বৈষ্ণবচরণ জানা, ভীমচরন দাসমহাপাত্র, কাদুয়া গ্রামের হেমন্তকুমার দাস, বংশীধর কর, মাধবপুরের চৈতন্য বেরা, কলাপুঞ্জা গ্রামের শিবপ্রসাদ ভুঁইয়া ও সোনাকনিয়ার রজনীকান্ত ঘোষ, ঘোল গ্রামের চন্দ্রমোহন জানা ঘটনাস্থলেই মারা যান। আহত হন আরও অনেকে। এরপর শুরু হয় বেলবনি গ্রাম জুড়ে পুলিশের নির্মম তাণ্ডব। ৫১টি বাড়িতে লুঠতরাজ চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। আগুনের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে দেয় কলাপুঞ্জা, ডাণ্ডা-বেলবনি, সোনামুয়ী ও উত্তর মুকুন্দপুর গ্রামের ঘরবাড়ি। আবালবৃদ্ধবনিতার সর্বস্ব হারানোর হাহাকারে পুঞ্জীভূত হতে থাকে ইংরেজ রাজত্বের প্রতি চরম ঘৃণা। যা পরবর্তীকালে দেশের স্বাধীনতার পথ তরাণ্বিত করে।
স্বাধীনতা লাভের পর অবশ্য হারিয়ে যেতে বসেছে বেলবনি গ্রামের স্বাধীনতা সংগ্রামের এই ইতিহাস। রামনগর থানার জনগণের শৌর্যবীর্য, সাহস, স্বদেশপ্রেম আর আত্মোৎসর্গের অত্যুজ্বল কীর্তির নির্মম সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে শুধু এলাকাবাসীর তৈরি শহিদবেদি। বৃহস্পতিবার, স্থানীয় বটতলা আনন্দময়ী হাইস্কুলের পড়ুয়া ও শিক্ষক-শিক্ষিকারা শোভাযাত্রা করে এসে শহিদবেদিতে মাল্যদান করেন। স্কুলের প্রধানশিক্ষক হৃষীকেশ দাস ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেন, “বতর্মান ও আগামী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনে রামনগরের বিশেষ করে বেলবনির গৌরবোচিত ভূমিকা তুলে ধরা দরকার। এর জন্য সরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন। কিন্তু প্রশাসনের কোনও মাথাব্যাথা আছে বলে তো মনে হয় না।” স্থানীয় বাসিন্দা পুলক বড়পণ্ডা, গোষ্ঠবিহারী জানা, অমূল্য করনরা জানান, স্বাধীনতার বহু বছর পর স্থানীয় মানুষজনের প্রচেষ্টায় একটি শহিদবেদি তৈরি হয়। লাগোয়া প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে বিস্তীর্ণ শহিদস্থল। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য অমিয়রঞ্জন মাইতি বলেন, “বেলবনি শহিদবেদি ও শহিদস্থলকে ঘিরে একটি সংগ্রহশালা তৈরির জন্য সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দীর্ঘ দিন ধরে দৌড়াদৌড়ি করেও লাভ হয়নি।” |
|
|
|
|
|