রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে তার নাম দেওয়া হয়েছে সম্পৃক্ত পুলিশি ব্যবস্থা। ‘স্যাচুরেটেড পোলিসিং’। প্রতি ২০০-৩০০ মিটার অন্তর পুলিশের দৃশ্যগোচর হওয়ার কথা এই ব্যবস্থায়। কিন্তু ঈদের আগের রাতে জনবহুল ও জমজমাট ধর্মতলা মোড় থেকে একটি এসইউভি-কে বেআইনি ভাবে শাটল গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করে দু’টি মেয়েকে তুলে অপহরণের চেষ্টার অভিযোগ প্রশ্ন তুলে দিল ওই পুলিশি বন্দোবস্ত নিয়েই। একই সঙ্গে মহিলারা এ শহরে কতটা নিরাপদ, বৃহস্পতিবার রাতের এই ঘটনায় সেই প্রশ্নটাও ফের সামনে চলে এল বলে মনে করছেন পুলিশ অফিসার ও কর্মীদের একাংশ। বৌবাজার থানায় একটি অপহরণের মামলা রুজু হয়েছে। তবে পুলিশেরই একাংশের দাবি, অপহরণ নয়, ভাড়া নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই এই কাণ্ড।
ঠিক কী হয়েছিল ওই রাতে?
প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, নিউ মার্কেট থেকে ঈদের কেনাকাটা করে রাত ১টা নাগাদ বাড়ি ফেরার জন্য ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন জোড়াসাঁকো এলাকার মদনমোহন স্ট্রিটের বাসিন্দা, মেছুয়া বাজারের ফল ব্যবসায়ী মহম্মদ সেলিম। সঙ্গে তাঁর দুই মেয়ে— এক জনের বয়স ১৮ বছর, অন্য জনের বয়স ১২। রাত বেড়ে যাওয়ায় রাস্তায় তখন যানবাহন কম। এসইউভি-টি দাঁড়িয়েছিল ধর্মতলার মোড়েই। মাথাপিছু ২০ টাকার বিনিময়ে চালক যেতে রাজি হওয়ায় দুই মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়েন সেলিম। শাটল গাড়ি ভেবে ওই এসইউভি-তে ওঠেন অন্য এক যুবকও। সেলিম বসেছিলেন চালকের পাশে।
অভিযোগ, চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউ বরাবর দ্রুত গতিতে যেতে যেতে গণেশচন্দ্র অ্যভিনিউয়ে ডান দিকে বাঁক নিয়ে চালক হঠাৎই ঠেলে ফেলে দেয় সেলিমকে। ব্যবসায়ীর দুই মেয়ে ভয়ে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকে। চালক তখন দ্রুত বেগে গাড়িটি ঘুরিয়ে ফের ধর্মতলার দিকে এগোচ্ছিল। বিপদ আঁচ করে চেঁচাতে থাকেন আরোহী অন্য যুবকও। চালক না-থামায় তিনি কোনও রকমে দরজা খুলে লাফিয়ে পড়েন বলে পুলিশ জেনেছে। ইতিমধ্যে চলন্ত গাড়ি থেকে পড়ে যাওয়ার আঘাত কিছুটা সামলে সেলিম মেয়েদের বাঁচাতে গাড়ির পিছনে ছুটতে শুরু করেছেন। ঈদের আগের রাতের জনবহুল রাস্তায় ওই দৃশ্য দেখে পথচারীদের একাংশও ওই এসইউভি-র পিছনে ছুটতে থাকেন। দু’টি মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়িটিকে ধাওয়া করেন দুই যুবকও। শেষমেশ টিপু সুলতান মসজিদের সামনে দিয়ে লেনিন সরণিতে ঢোকার মুখে গাড়ি থেমে যায়। গাড়ি থেকে জনতা মেয়ে দু’টিকে উদ্ধার করে। চালককে বেধড়ক মারধর শুরু হয়। গাড়িটি ভাঙচুর করে উল্টে দেয় ক্ষিপ্ত জনতা। পুলিশ পৌঁছে চালক বিনোদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করে। ব্যবসায়ী সেলিমের অভিযোগের ভিত্তিতে বিনোদের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা রুজু করা হয়েছে।
পুলিশের একাংশের দাবি, ভাড়া নিয়ে গণ্ডগোলের জেরেই এই কাণ্ড। বিষয়টি দু’টি মেয়েকে অপহরণ করার মতো ‘গুরুতর’ বিষয় নয়। চালক প্রথমে মাথাপিছু ২০ টাকা ভাড়া চাইলেও কিছু দূর যাওয়ার পর মাথাপিছু ৪০ টাকা চেয়ে বসে। সেই সময়ে ওই ব্যবসায়ী থানায় যাওয়ার হুমকি দেন। এবং তা নিয়েই যত গণ্ডগোল। চালক মত্ত অবস্থায় ছিল বলেও পুলিশ জানিয়েছে।
কিন্তু সম্পৃক্ত পুলিশি ব্যবস্থা যে ২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বলবৎ হওয়ার কথা, ধর্মতলার মোড় তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। সেখানে একটি এসইউভি-কে বেআইনি ভাবে শাটল গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করে চালক যাত্রী তুলতে পারল কী করে, সেটাও প্রশ্ন। পুলিশের একটি সূত্রের খবর, সম্পৃক্ত পুলিশি ব্যবস্থা একসঙ্গে যতটা জায়গা জুড়ে বলবৎ হওয়ার কথা, ততটা জায়গা জুড়ে তা বলবৎ হচ্ছে না। তাই প্রতি ২০০-৩০০ মিটার অন্তর পুলিশের দৃশ্যগোচর হওয়াটাও বাস্তবে সব জায়গায় সব সময়ে হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার রাতেও জনতাই আগে গাড়িটি ধরে ফেলে, পুলিশ পৌঁছয় অনেক পরে।
পুলিশ জেনেছে, ওই গাড়িটি একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির। চালক বেআইনি ভাবেই গাড়িটি যাত্রী তোলার কাজে ব্যবহার করছিল। লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “শুধু প্রাইভেট গাড়ি নয়, ট্যাক্সিও শাটলে যাত্রী তোলে। এটাও বেআইনি। কিন্তু অনেক সময়ে সাধারণ মানুষের অসুবিধার কথা মাথায় রেখে আমরা সে সব দেখেও দেখি না। কারণ, রাস্তায় পর্যাপ্ত যানবাহন অনেক সময়েই থাকে না। পর্যাপ্ত যানবাহন থাকলে এই বেআইনি ভাবে যাত্রী তোলা কিছুটা কমবে।”
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের কথায়, “ঈদের কেনাকাটার কথা মাথায় রেখে বৃহস্পতিবার আমরা বেশি বাস চালাই। তা সত্ত্বেও ধর্মতলায় ওই সময়ে বাস ছিল না কেন, তা তদন্ত করে দেখতে বলেছি। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে বাস তুলে নিয়ে কৃত্রিম সমস্যা তৈরির চেষ্টা করছেন। এটা তাঁরা ঠিক করছেন না। এই ভাবে বেশি দিন চলবে না।” |