মহানগরে খাল সংস্কারে প্রশাসন উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু সে উদ্যোগে সমন্বয়ের দস্তুরমতো অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে উত্তর ও পূর্ব কলকাতার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিকাশির ভবিষ্যতে অশনি সঙ্কেত দেখছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
সল্টলেককে মাঝে রেখে মহানগরের উত্তর ও পূর্ব অংশের বড় এলাকাকে বৃত্তের মত ঘিরে রেখেছে তিনটি খাল। বেলেঘাটা সার্কুলার ক্যানাল, কেষ্টপুর খাল এবং ইস্টানর্র্ ড্রেনেজ চ্যানেল। প্রথম দু’টির উৎস হুগলি নদী। তাদের মধ্যে সংযোগসাধন করেছে তৃতীয়টি। তিনটিকে ওই অঞ্চলের নিকাশি ব্যবস্থার মেরুদণ্ড বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তিন খালে সমান নাব্যতা ও জলবহনের ক্ষমতা বজায় রাখা জরুরি। তাঁদের হুঁশিয়ারি, সংস্কার করতে হলে তিনটিরই এক সঙ্গে করা উচিত, নতুবা পুরো এলাকার নিকাশি ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার সমূহ আশঙ্কা।
অথচ বাস্তবে সেই বিপজ্জনক কাজই হচ্ছে বলে অভিযোগ। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে সম্প্রতি বেলেঘাটা খাল সংস্কারে হাত দিয়েছে সেচ দফতর। অন্য দু’টোয়? |
সংস্কার হচ্ছে শুধু বেলেঘাটা খালে। —নিজস্ব চিত্র |
তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। রাজীববাবু শুধু বলেছেন, “কেষ্টপুর খালও সংস্কার করা হবে।” যদিও ওই খাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দ এখনও মেলেনি বলে জানিয়েছেন এক সেচ-কর্তা। আর সরকারি সূত্রের খবর, অদূর ভবিষ্যতে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেল সংস্কারের কোনও পরিকল্পনা নেই। নগরোন্নয়ন দফতরের সুপারিন্টেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার তেজেন্দ্রনাথ সোমের দাবি, “বছরখানেক আগে ইস্টার্ন ড্রেনেজ পরিষ্কার করা হয়েছে। এখন আর দরকার নেই।” প্রসঙ্গত, বেলেঘাটা ও কেষ্টপুর খালের দায়িত্ব সেচ দফতরের। ইস্টার্ন ড্রেনেজ নগরোন্নয়নের অধীন।
ঘটনা হল, ইস্টার্ন ড্রেনেজে সংস্কারের কাজ যে ভাবে সারা হয়েছে, তাতে এলাকাবাসী খুশি নন। বস্তুত এ নিয়ে সেচ দফতরে কিছু অভিযোগও জমা পড়েছে বলে এক সেচ-কর্তার দাবি। যা উড়িয়ে দিয়ে এক নগরোন্নয়ন-কর্তার পাল্টা অভিযোগ, “কেষ্টপুর খালেই পলি জমে জমে স্রোত প্রায় স্তব্ধ! আবর্জনায় ভরা ওই খালটির জন্য বরং সল্টলেকবাসীকে ভুগতে হচ্ছে।”
সরকারেরই দুই দফতরে এ হেন চাপান-উতোরের তলায় কার্যত চাপা পড়ে যাচ্ছে সমন্বয়ের গুরুত্ব। এতে কী বিভ্রাট হতে পারে, তা বোঝার আগে খাল-বিন্যাসের ত্রিমুখী ছবিটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। সেটা কী রকম?
সেচ-সূত্রের খবর: চিৎপুর লকগেট থেকে একটি ক্যানাল বেরিয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়েছে। একটা শাখা বেলেঘাটা খাল, যা মানিকতলা-রাজাবাজার-বেলেঘাটা হয়ে গিয়েছে চিংড়িহাটায়। অন্যটা কেষ্টপুর খাল, সেটি উল্টোডাঙার কাছে ভিআইপি রোড ও সল্টলেকের মাঝ দিয়ে নয়াপট্টি-কেষ্টপুর হয়ে বিদ্যাধরীতে পড়েছে। দুই জলধারাকে যুক্ত করেছে ইস্টার্ন ড্রেনেজ চ্যানেল। এটি নয়াপট্টির কাছে কেষ্টপুর খালে, আর চিংড়িহাটায় বেলেঘাটা খালে মিলেছে। ইস্টার্ন ড্রেনেজের এই দু’প্রান্তে রয়েছে দু’টি স্লুইস গেট।
এবং এ হেন ভৌগোলিক অবস্থানের সুবাদেই তিন খালের সংস্কারে সমন্বয় অতীব জরুরি বলে দাবি করছেন বিশেষজ্ঞেরা। তাঁদের মতে, কোনও একটি বা দু’টিতে জলস্রোত তুলনায় কমতি-বাড়তি হয়ে গেলে প্রায় বৃত্তাকার পুরো নিকাশি-ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। এক সেচ-ইঞ্জিনিয়ারের বক্তব্য, হুগলি নদীর সঙ্গে যুক্ত থাকায় বেলেঘাটা ও কেষ্টপুর খালে এমনিতেই জোয়ারের টানে বিস্তর পলি ঢোকে। তার উপরে খালপাড়ের জনবসতির যাবতীয় আবর্জনা পড়ে পড়ে প্রতিনিয়ত গভীরতা কমছে, কমছে জলধারণের ক্ষমতা। সুরাহা করতে হলে পলি সরিয়ে খালের আসল গভীরতা ফিরিয়ে আনতে হবে। তাই বলে অন্য দু’টিকে ছেড়ে শুধু বেলেঘাটা খালে জলপ্রবাহ বাড়ালে কাজের কাজ তো হবেই না, উল্টে বিপত্তি বাড়বে। “এটা কার্যত ভস্মে ঘি ঢালারই সামিল।” মন্তব্য করেছেন তিনি। কেন?
ওঁর যুক্তি: বেলেঘাটা খালে স্রোত বাড়লে চিংড়িহাটার স্লুইস গেট খুলতেই হবে। অথচ তুলনায় অগভীর ইস্টার্ন ড্রেনেজ ওই বাড়তি জল ধরে রাখতে পারবে না। তখন তার জলতল নিকাশি লাইনের ‘লেভেল’ ছাপিয়ে যাবে, ফলে তা নিকাশির জল টানতে ব্যর্থ হবে। আবার নয়াপট্টির স্লুইস গেট খুলে ইস্টার্ন ড্রেনেজের অতিরিক্ত জলকে কেষ্টপুর খাল দিয়ে বইয়ে দিলেও বিপদ। কারণ কেষ্টপুর খালেও প্রয়োজনীয় গভীরতা নেই। সে ক্ষেত্রেও সল্টলেক-সহ আশপাশে নিকাশি বিপর্যস্ত হতে পারে। অন্য দিকে প্রাক্তন সেচ-সচিব অঞ্জন চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ইস্টার্ন ড্রেনেজের স্রোত মূলত কেষ্টপুর খালমুখী। তাই কেষ্টপুর খালে জলের লেভেল বাড়লে তাতে ইস্টার্ন ড্রেনেজের জল ঢুকবে না। “বেশি বৃষ্টিতে এমনটা হতেই পারে। তখন কিন্তু স্লুইস গেট বন্ধ রেখেও সামলানো যাবে না!” হুঁশিয়ারি অঞ্জনবাবুর। |
অর্থাৎ দু’দিক থেকে সাঁড়াশি বিপদ। ইস্টার্ন ড্রেনেজের দু’প্রান্তে পাম্প বসিয়ে বাড়তি জল তুলে ফেলার পরিকল্পনাও কার্যকর হয়নি। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, তিন খালের সংস্কারে সামঞ্জস্য না-আনা ইস্তক বিপদ কাটবে না। তিন খালের যুগপৎ সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে সেচমন্ত্রী রাজীববাবুও বলছেন, “এ নিয়ে নগরোন্নয়ন দফতরের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে।”
বৈঠকের কোনও ফল কিন্তু এখনও মালুম হচ্ছে না। এ দিকে জোরকদমে চলছে বেলেঘাটা খাল সংস্কার। সেচের চিফ ইঞ্জিনিয়ার(১) ধীমান মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, সাড়ে ৮ কিলোমিটার লম্বা খালটিতে বসেছে ন’টি ড্রেজিং মেশিন। সংস্কার ও সৌন্দর্যায়নে খরচ ধরা হয়েছে ১০৪ কোটি টাকা। আগামী নভেম্বরের মধ্যে কাজ শেষ হওয়ার কথা। তার পরে পাড় বাঁধাই। ওখানে কি জলযান চলবে?
সেচমন্ত্রী বলেন, “এই মুহূর্তে তেমন পরিকল্পনা নেই। মানুষের স্বাস্থ্য ও সুস্থ পরিবেশের স্বার্থেই খালটি সংস্কার হচ্ছে।” এক বিশেষজ্ঞের মন্তব্য, “খালের জলে সেকেন্ডে দু’ফুট বেগ থাকলে ভাল হয়। তাতে জলের লেভেল ঠিক থাকে, মশার লার্ভাও জন্মাতে পারে না।” তাঁর আক্ষেপ, খালের স্রোত রুদ্ধ বলেই সল্টলেকে মশার উপদ্রব বেশি।
গত মরসুমে ডেঙ্গি-হানায় পর্যুদস্ত উপনগরীর মানুষ অবশ্য তা বিলক্ষণ জানেন। |