মাঠের জন্য জমি কিনে দান শিক্ষকের |
দয়াল সেনগুপ্ত • খয়রাশোল |
ওদের জন্য সব সময়ই কিছু করতে ইচ্ছে করে তাঁর। আর এই ইচ্ছে থেকেই নিজের পকেটের পয়সায় কখনও তিনি সকলকে স্কুলের পোশাক কিনে দেন। আবার কখনও বা ওদের খালি পায়ে স্কুলে আসতে দেখে সকলকে জুতোও কিনে দেন। শুধু পোশাক বা জুতো কিনে দিয়ে থেমে থাকেননি খয়রাশোলের তামড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক (বর্তমানে টিচার ইনচার্জ) উত্তম গড়াই। এ বার সকল ছাত্রছাত্রীদের জন্য ওই শিক্ষকের উপহার হতে চলেছে একটা খেলার মাঠ, স্কুলে যাতায়াতের জন্য চওড়া রাস্তা। যদিও এখনও খেলার মাঠ বা রাস্তা তৈরির কাজ সম্পন্ন হয়নি। তবে ইতিমধ্যেই স্কুলের নামে ৫৮ শতক জায়গা নেওয়ার কাজ সম্পন্ন। রাস্তা ও মাঠ গড়ার ভাবনা সফল করতে ওই শিক্ষকের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন এলাকার বাসিন্দারাও।
১৯৫৫ সালে স্থাপিত তামড়া প্রাথমিক স্কুলে বছর তেরো আগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন উত্তমবাবু। এমনিতেই পিছিয়ে পড়া ব্লক খয়রাশোল। আরও পিছিয়ে পড়া এই ব্লকের পারশুণ্ডী পঞ্চায়েতের এই গ্রামের স্কুলের অন্যতম প্রধান সমস্যা স্কুলে যাতায়াত। সঠিক ও চওড়া রাস্তা না থাকার বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ ছিল উত্তমবাবুর। স্কুল ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কয়েকঘর বসতির মাঝখান দিয়ে যাওয়া একফালি সরু গলি। এটাই এখনও খয়রাশেলের তামড়া প্রাথমিক স্কুলে যাতায়াতের প্রাধান পথ। সেই গলি দিয়ে যাতায়াতের সময় প্রায়ই সমস্যা হয় ওই স্কুলের ১১৩ জন পড়ুয়ার। |
পড়ুয়াদের নিয়ে ব্যস্ত তামড়া প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক উত্তম গড়াই। —নিজস্ব চিত্র |
তার উপরে ওই ‘রাস্তা’র দু’ পাশে থাকা পরিবারগুলি থেকে কেউ গরু এনে সেখানে বেঁধে রাখলে তো সমস্যা আরও বাড়ে। মাস ছয়েক আগে স্কুলের সীমানা প্রচীর সংলগ্ন একটি বড় জমি বিক্রি হবে খবর পেয়েই (প্রায় ২৭ শতক) প্রথমে তা নিজের নামে কিনে নেন ওই শিক্ষক এবং পরে তা জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের মাধ্যমে স্কুলের নামে দান করেন তিনি। উদ্দেশ্য, স্কুলের রাস্তা তৈরি করানো। কিন্তু এতো বেশি পরিমাণে জায়গা পাওয়ার পর আরও একটি ভাবনা মাথায় আসে উত্তমবাবুর। তিনি বলেন, “রাস্তা তৈরির পরও বেশ খানিকটা জায়গা বেঁচে যাবে। তাই ভাবলাম আরও কিছুটা জায়গা পেলে বাচ্চাগুলোর একটা খেলার জায়গা হয়ে যাবে। তখনই এখানে যে সব গ্রামবাসীর জমি রয়েছে, তাঁদেরকে সামান্য করে জমি বাচ্চাদের জন্য দান করার জন্য আনুরোধ জানাই। এগিয়ে আসেন ৬ জন জমির মালিক।”
আরও প্রায় ৩২ শতক জমি একই ভবে স্কুলকে দান করেন তাঁরা। এখনও আরও কিছুটা জায়গা প্রয়োজন। তবে সেই জমি দানের মাধ্যমে আসবে না। কিনতে হবে। উত্তমবাবু বলেন, “গ্রামবাসীরা কিছু কিছু করে টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য সেই জমি কিনে স্কুলকে দেবেন বলে আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। সেটা পেলেই কাজ শুরু হবে।” কী বলছেন জমি দাতারা? চৈতন্যপ্রসাদ মণ্ডল, বিপদতারণ মণ্ডল বললেন, “একজন শিক্ষক যখন এতটা উদ্যোগী হতে পারেন, ছেলে-মেয়েদের জন্য এত করতে পারেন, তাই ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমরাই বা কেন এগিয়ে আসব না। তাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছি।”
শুধু স্কুলের উন্নতি নয়। পড়াশোনাকেও সমান গুরুত্ব দেন উত্তমবাবু। তবে কিছু দিন আগে স্কুলের প্রধান শিক্ষক অবসর নেওয়ায় কাঞ্চন মণ্ডল নামে একজন সহ-শিক্ষক-সহ মোট শিক্ষকের সংখ্যাটা দাঁড়ায় দু’য়ে। ফলে বেশ ক্ষানিকটা সমস্যায় পড়েন তাঁরা। ওই শিক্ষকের আশা আগামীদিনে শিক্ষক নিয়োগ হলে পরিস্থিতি বদলে যাবে। তারমধ্যে যতটা সম্ভব চেষ্টা করা হচ্ছে। সমগ্র বিষয় বিষয়টি নিয়ে সমান উচ্ছ্বসিত আভিভাবকেরাও। পম্পা ঘোষ, ববি বাউড়ি, বুধন পাল এবং তরুণ বাউড়িরা বলেন, “প্রথম থেকেই মাস্টারমশাই ওদের খুব ভালবাসেন। যত্ন নেন। স্কুলে না গেলে নিয়মিত খোঁজ নেন। এ বার রাস্তা, খেলার মাঠ করবেন বলছেন, সেটা অবশ্যই দারুন হবে আমাদের বাচ্চাদের জন্য। গ্রামের সকলের মতো আমরাও তাঁর পাশেই রয়েছি।” ওই শিক্ষকের উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন খয়রাশোলের(দক্ষিণচক্র) স্কুল পরিদর্শক ললিতা নামতীর্থ। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান রাজা ঘোষও বলেন, “আমরা সব সময় সমাজের অবক্ষয় নিয়ে গেল গেল রব তুলি। কিন্তু এতটা আতঙ্কিত হওয়ার কিছুই নেই। এখনও উত্তমবাবুদের মতো মানুষ সমাজে রয়েছেন।”
আর যাদের জন্য রাস্তা ও মাঠ তৈরি হওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে, তারা অবশ্য এত সব জনে না। মাঠ তৈরির কথা শুনেই চকচকে চোখ তুলে বৃষ্টি মণ্ডল, গৌরাঙ্গ পাল, অপর্ণা ঘোষেরা বলে, “তা হলে তো স্কুলে আসার মজাটাই বেড়ে যাবে!” |