ঠিক যেন ঘড়ির অ্যার্লাম। রাতে ঘড়ির কাঁটা দু’টো ছাড়ালেই রাস্তা থেকে ভেসে আসে, ‘‘উঠো উঠো আল্লাহ কে পেয়ারে, নবিকে দুলারে, সেহেরি কা ওয়াক্ত হো গয়া।’’ সুর করে করে পাড়ায় পাড়ায় কতগুলো ছেলে ঘুম ভাঙানি ডাক দিয়ে যান। সেই ডাকেই ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়েন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা। পেট পুড়ে খেয়ে নেন রাতের শেষ খাবার। তারপর সারা দিন উপবাস। শেষ রাতের খাবার এই ‘সেহেরি’ই তাঁদের সারাদিনের শক্তি জোগায়।
রমজান মাস জুড়ে বাঁকুড়া শহরের মুসলিম মহল্লগুলোতে এক দল ছেলে ছোকরা নিয়ম করে শেষ রাতে পাড়ায় ঘুরে ঘুরে পড়শিদের সেহেরির জন্য ঘুম ভাঙাচ্ছেন। এ বছর নয়, বছরের পর বছর ধরেই এমনটা হয়ে আসছে। আর তাঁদের সঙ্গে খুশি ভাগ করতে কোনও কোনও হিন্দু ঘরের বন্ধুরাও রাতে পথে নেমে পড়েছেন। টানা একমাস ধরে রাত জেগে ঘুম ভাঙানি ডাক দিয়ে রমজান মাসের শেষে হাসিমুখে যে যা দেবে তাই দিয়েই ওঁরা খুশির ঈদ পালন করেন।
বাঁকুড়া শহরের স্কুলডাঙা এলাকার ইরফান খান, সেখ নাসিম, সেখ রিন্টুদের মতো জনা ১২ যুবক মিলে সেহরি জাগানোর দল গড়েছেন। তাঁরা বলেন, “সারা বছর আমরা এই রমজান মাসের জন্য অপেক্ষা করে থাকি। |
আমাদের বাপ-দাদুরাও এ ভাবে সেহরি জাগানোর কাজ করতেন। পুরো রমজান মাসজুড়ে আমরা রাত জাগি। দলের ছেলেরা রাতের খাবার সেরে স্কুলডাঙার একটি ক্লাব ঘরে জমা হই। রাত দু’টো পর্যন্ত চলে আড্ডা আর ক্যারাম খেলা। তারপর দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে সেহরি জাগাতে বেরিয়ে পড়ি।”
ইরফান, নাসিমদের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছেন স্কুলডাঙার অভিজিৎ দাস, অমিত মালাকাররাও। তাঁদের কথায়, “সেহরি জাগানোর মজাটাই আলাদা। সারা রাত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা ও হুল্লোড় করার আকর্ষণ ঠেকাতে পারি না। রমজানের শেষে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি ঘুরি। কেউ ৫ টাকা দেন, কেউ ১০ টাকা, কেউ আবার ১০০ বা তারও বেশি টাকা দেন। যে যা দেন, তাতেই আমরা খুশি।” নাসিম, রিন্টুরা জানান, আগেও তাঁদের পূর্ব পুরুষেরা রাত জাগানির জন্য কোনও বাঁধা ধরা পয়সা নিতেন না। এটাই নিয়ম। তবে রাতে পাড়ায় পাড়ায় ঘোরার ঝক্কিও কম নয়। টর্চ আর লাঠি হাতে রাখতেই হবে। রাস্তায় সাপের ভয় যেমন রয়েছে, তেমন কুকুরের দৌরাত্ম্যও কম নয়। তার উপর এ বার বৃষ্টি কখন নামে, এই আশঙ্কায় ছাতা রাখতে হচ্ছে। জল-কাদা মাড়িয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরলেও ঈদ এগিয়ে আসায় মুখগুলো এখন খুশির উজ্বল হয়ে উঠেছে। ওই টাকায় কী করবেন? ওঁরা সবাই এক সঙ্গে বলে ওঠেন, “গত বছর সাউন্ডবক্স বাজিয়ে খুব মজা করেছিলাম। একবার পাড়ার মুখে ভাল গেট তৈরি করেছিলাম। আলোকসজ্জাও করেছি অনেক বার। এ বার ঠিক করেছি, টানা দু’দিন ধরে সবাই এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব।”
শুধু এই স্কুলডাঙাতেই নয়, ঈদগামহল্লা, কেঠেরডাঙা, কবরডাঙার মতো মুসলিম পাড়াগুলিতেও একই রকম দল গড়ে যুবকরা সেহরির জন্য জাগানোর কাজ করেন। স্কুলডাঙার বাসিন্দা হাসেম খান, সাদির খানদের এখন সংসার হয়েছে। তাই আর তাঁরা সেহরি জাগানোর কাজে যোগ দেন না। তাঁদের কথায়, “১০ বছরের বেশি আমরা পাড়ায় লোকেদের রাতে ঘুম ভাঙিয়েছি। এখন ওদের ডাকে যখম ঘুম ভাঙে পুরনো দিনের অনেক কথা মনে পড়ে যায়। মন খারাপ করে।” |